ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

আবার সেই পুরনো সুর

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আবার সেই পুরনো সুর

রাজনীতির বাতাসে আবার সংলাপের সুর ধ্বনিত হচ্ছে। ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের বিতর্ক, জাতিসংঘ মহাসচিব বা তাঁর দূত, মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ কিংবা ইইউ হয়ে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল, কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ‘সংলাপ’ সংক্রমণে যেভাবে আবার আক্রান্ত হচ্ছেন তাতে মনে হয় এ কোন সাধারণ সংক্রমণ নয়। এর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এ্যাফেক্ট আছে। নইলে একসঙ্গে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে একই শব্দের সম্মিলিত প্রতিধ্বনি হয় কি করে? গঙ্গা-যমুনায় কত পানি বইল, উত্তর গোলার্ধ দক্ষিণ গোলার্ধে পৃথিবী কতবার পাক খেল, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরত পেরিয়ে শীত যাই যাই করছে-সব বদলাচ্ছে। অপরিবর্তনীয় থাকছে শুধু সংলাপ। সংলাপেই সমাধান-। আসলেই কি তাই? তাহলে শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর নানা দেশে গণতন্ত্র সঙ্কটে কেন? দেশ ভেদে স্বরূপ আলাদা হলেও সঙ্কট আছে সবখানে। যা খেয়াল করার তাহলো, উত্তরণের ফর্মুলা একেক দেশে একেক রকম। কোথাও ‘আরব বসন্ত’ নামে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উচ্ছ্বাস, কোথাও দুর্নীতি নির্মূল করে ‘অহিংসার’ চমকে গণতন্ত্রকে সংহত ও শক্তিশালী করার ফাঁপা আওয়াজ। কোথাও সংলাপ, সমঝোতার বায়বীয় তোড়জোড়। আসলে এ বিশ্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা নিজেরাই এখন ভ্রান্তিতে পড়েছে। কৃষি উৎপাদনে সীমাবদ্ধতা আর শিল্প উৎপাদনে বিনিয়োগ স্থবিরতা-এ দ্বৈত সঙ্কটের চক্রে পড়ে জুয়া আর ফটকাবাজির পেছনে ছুটছে তারা। উৎপাদনের মৌলিক জায়গা থেকে ছিটকে পড়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে আধিপত্য ও দখলদারিত্বকে অন্যতম অস্ত্র করায় দেশে দেশে নানা ধরনের ক্যামফ্লেজ নিতে হয় তাদের আজকের পৃথিবীতে। এ জন্য ‘গণতন্ত্র’ লেবাস সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক এবং কুশলী নিয়ন্ত্রক হিসেবে গুরুগম্ভীর গণতন্ত্রপ্রেমী সৃষ্ট করা তাদের বাঁ-হাতের কাজ। আর বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বিক্রিযোগ্য বুদ্ধিজীবী ক্যালকুলেটর দিয়ে গুনেও শেষ করা যায় না- সেখানে গণতন্ত্র গেলানো কতখানি সহজ তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার হয় না। সংলাপের বেশ ধরে ঘোরাফেরা করছে। ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে সে দেশের ফরেন মিনিস্টার স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের নির্বাচনী নিময়-কানুন মেনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার বিপক্ষে তাদের অবস্থানের কথাও জানিয়েছেন। অনেক কিছু বলে শেষে ইতিবাচক সংলাপে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পুরনো সুরে কণ্ঠ মিলিয়েছেন। তাঁর দেয়া তথ্য থেকেই জানা যায়, দু’হাজার ছয় থেকে দু’হাজার এগারো সাল পর্যন্ত ব্রিটেন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর এ মুহূর্তে ব্রিটেন হচ্ছে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস ও সি-ফুড ক্রেতা। এও জানিয়েছেন, ব্রিটেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনুদান দেয়া দেশ। বাংলাদেশের জনগণের জন্য এ সহায়তা ব্রিটেন অব্যাহত তো রাখবেই, এর একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যও কাজ করবে। শুধু অনুদান নয়, বাংলাদেশে ব্রিটেনের প্রায় দু’লাখ বিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়োগ রয়েছে এবং এক শ’র বেশি কোম্পানি বাংলাদেশে সফলভাবে কাজ করছে। তারা বাংলাদেশের জনগণকে উন্নয়ন সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করতে চায় না। এর চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে। সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপারে নিজেদের নীতিনির্ধারণী কক্ষে বসে ক্ষুদ্র বাংলাদেশ নিয়ে এ মহতী ভাবনা। আহা কত ভাল! ‘গুরুতর ও পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার নীতিলঙ্ঘন’- বাংলাদেশ সম্পর্কে ইউরোপীয় কমিশনের এমন এক সিদ্ধান্তে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক খাতের শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা ঝুঁকিতে বলে শঙ্কিত হচ্ছেন অনেকে। বাংলাদেশের তথাকথিত গুরুগম্ভীর বিশেষজ্ঞদের জিএসপি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হলেও ইইউর বাণিজ্য বিষয়ক মুখপাত্র জন ক্যান্সি এ নিয়ে আমতা আমতা করছেন। তিনি পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের পর জিএসপি সুবিধা সাময়িকভাবে স্থগিত করার কথা বলেছেন। তবে কী অনুসন্ধান করাবেন তা বলেননি। স্থগিত প্রক্রিয়া শুরু হবে নোটিস জারির মধ্য দিয়ে, নোটিস দেয়ার তারিখ থেকে ছ’মাসের মধ্যে কমিশন বাংলাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে। এ সময়ের মধ্যে স্থগিতের আদেশ জারি হবে না। অনুসন্ধান শেষে ইউরোপীয় কমিশন যদি মনে করে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা সাময়িক প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত সঠিক হবে, তাহলেই তারা সে নির্দেশ দেবে। এ তো গেল জিএসপি প্রসঙ্গ। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বাংলাদেশে গত পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের চার দিন পর ৯ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ক্যাথরিন এ্যাশটন এক বিবৃতিতে নির্বাচন স্বচ্ছ অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য হয়নি উল্লেখ করেছেন। তিনি নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। ইইউ কিভাবে বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে প্রভাবিত করতে পারে সে প্রসঙ্গে ইইউর কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘সব কিছুই বিবেচনায় রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা সাময়িক স্থগিত করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত।’ তাঁরা এও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এত তাড়াহুড়ো করা উচিত হবে না।’ ইইউর জিএসপি নীতি অনুযায়ী গুরুতর ও পদ্ধতিগত শর্ত লঙ্ঘনের মতো ঘটনাতেই কেবল আমদানি শুল্কের জিএসপি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হতে পারে। খুবই দুর্বল স্বর। অর্থাৎ নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা তাদের জন্য জরুরী। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বলেই চলেছে, তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। পাশাপাশি সংলাপের প্রতি জোর দিচ্ছে। বিশ্ব পুঁজির নিয়ন্তা এসব দেশ বাংলাদেশ প্রশ্নে স্পষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত। এদের নিজেদের গণতন্ত্রই যথেষ্ট সমস্যায় আছে। যেভাবে এরা গরিব দেশগুলোকে শর্তের বেড়াজালে আটকিয়ে সরকার পরিবর্তনের কাজটি এতকাল সম্পন্ন করে এসেছে সে পরিস্থিতি এখন তাদের নিজেদেরও কম-বেশি সামলাতে হচ্ছে। অগ্রসর পুঁজির এ দেশগুলোর সরকার বদলে মূল ভূমিকায় এখন ব্যাংক মালিকরা। আন্তর্জাতিক ব্যাংক মালিকরা এসব দেশে যেসব শর্ত চাপাচ্ছেন তাও যথেষ্ট কঠোর। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা এখন নিজেদের তৈরি সঙ্কটে নিজেরাই আটকেছে। এর নিয়ন্ত্রকরা নিজেদের প্রয়োজনে অন্যসব দেশে সন্ত্রাস-সহিংসতা সৃষ্টি, লালন ও পরিপুষ্ট করেছে। মধ্যযুগীয় ভাবধারা ও ধর্মীয় উন্মাদনার গোড়ায় পানি ঢেলে পত্রপল্লবে বিকশিত করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় এতে কৃত্রিম রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়। যাতে চাপা পড়ে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের সত্যিকারের লড়াই। এর আসল উদ্দেশ্যই হলো গণতান্ত্রিক জীবন গড়ার জন্য জনগণের সংগ্রামকে বাধা দেয়া। এই কৃত্রিম গণতান্ত্রিক সঙ্কটে কিছু নিষ্ঠাবান গণতন্ত্রপ্রেমী মহীরুহের মতো আমদানি হন। তাঁরা বজ্রকণ্ঠে ‘সংলাপ’ ‘সমঝোতা’র মতো যে শব্দগুচ্ছ অনর্গল আওড়ান তাও মোড়কবন্দী হয়ে ওই পশ্চিম থেকেই আমদানি হয়। তবে আগেই বলেছি নিয়ন্তারা নিজেরাই এখন অনেকটা দিশেহারা। প্রান্তের বিভিন্ন দেশে এত বেশি কৌশলী কর্মসূচী ছড়িয়েছে যে, তারা নিজেরাই অনেক সময় ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারছে না কোথায় কী ঘটছে। কিভাবে সামলাবে। বাংলাদেশের বেলায়ও সম্ভবত সেরকম কিছু হচ্ছে। নিকট অতীতের ঘটনাবলীতে বিদেশী কূটনীতিক প্রতিনিধিদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আচরণ এ মতের সপক্ষই সমর্থন করে। তবে সাধারণ জ্ঞানে এটুকু অন্তত বোঝা যায়, নিজেদের তারা যত শক্তিশালী হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে তত শক্তি এদের নেই। ভেতরে বিশাল ক্ষয় শুরু হয়েছে, নিপুণ কৌশলে তা আড়াল করতে চাইলেও যাঁদের চোখ আছে তাঁরা ওই ক্ষয় অবশ্যই দেখতে পান। ছোট দেশের সরকাররা শক্ত করে মাথা তুললে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে ওই ক্ষয়িষ্ণু কাঠামো। অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা এরকমই।
×