ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অস্ট্রেলিয়ায় টাইগার মিলন!

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অস্ট্রেলিয়ায়  টাইগার মিলন!

ফজলুল বারী, সিডনি থেকে ॥ টাইগার মিলন এখন অস্ট্রেলিয়ায়! বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলের পিছু পিছু চলে এসেছেন টিম বাংলাদেশের আন্তরিক, অন্ধ এক সমর্থক। বাঘের সাজ পোশাকে গ্যালারিতে দৌড়ে লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা উঁচিয়ে তিনি সাপোর্ট দেন দলকে; প্রতিনিধিত্ব করতে দেশকে। কিন্তু দল তো জানে না তাদের এই সমর্থকের জীবন চলে কী করে। জানা সম্ভবও না। বাংলাদেশের মাঠের-গ্যালারির এখন এমন দু’জন টাইগার সমর্থক আছেন- একজন টাইগার মিলন, অপরজন টাইগার শোয়েব আলী। মিলন এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পেয়েছেন। শোয়েব আলী পাননি। মিলনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেছে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের। মিলনের দায়িত্ব তাঁরা নিয়ে নিয়েছেন। তাঁর আর এদেশে পুরো বিশ্বকাপ চলাকালীন থাকা-খাওয়া-চলাফেরার কোন সমস্যা হবে না। মিলনের পুরো নাম ফাহিমুল হক। টাইগার মিলন নামের আড়ালে হারিয়ে গেছে তাঁর আসল নাম। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে বাড়ি। বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। অবসরে গেছেন। মিলনরা চার ভাই এক বোন। বড়ভাই থাকেন আমেরিকায়। এর পরেরজন টুকটাক ব্যবসা করেন। ঢাকার শান্তিনগর মোড়ে জেমস পার্লার নামের একটি সেলুনের ব্যবসা আছে মিলনের। তাঁর অনুপস্থিতিতে ব্যবসাটি দেখেন ছোটভাই। ক্রিকেট দলের প্রতি ভালবাসায় এভাবে ছুটে বেড়ানোকে পাগলামো মনে করে রাগে কথা বলেন না তাঁর মেজ ভাই! কিন্তু এ যে এক অদ্ভুত নেশা! কোন বাধাই যে মানে না! ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা জন্মানোর কারণÑ এক সময় ক্রিকেট খেলতেন ঢাকার দ্বিতীয় বিভাগের লীগে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর দলে। দলে উইকেট কিপারের পাশাপাশি ওপেনিং ব্যাটসম্যানের ভূমিকা ছিল তাঁর! একবার অসুখে পড়ে খেলার পাঠ চুকে গেলেও বাংলাদেশ দলের একজন অন্ধ সমর্থকের ভূমিকাটি বাদ দেয়া যায়নি। বাংলাদেশ দলের পিছু পিছু দেশের বাইরে প্রথম যান শ্রীলংকায়। বাঘ সেজে লাল-সবুজ পতাকা হাতে তাঁর বাঘের হুঙ্কারে টাইগার মিলন নামটি তখনই চালু হয়ে যায়। এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দলের খেলা দেখতে অস্ট্রেলিয়া আসতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে তাঁর সিডনি আসার টিকেট কিনতে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা লেগেছে। মিলন বলেন, অনেক দিনে মাসে মাসে ১০ হাজার টাকা করে জমিয়েছেন এ টাকা! কতদিন যে ঢাকায় এখানে সেখানে হেঁটে গেছেন! এভাবে রিক্সা ভাড়ার টাকাও জমিয়েছেন! কিন্তু সিডনি এসে তো কাউকে চেনেন না, জানেন না! সিডনি এয়ারপোর্টে নেমে ট্রেনে আসেন সেন্ট্রাল স্টেশনে। এক বাংলাদেশী ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলে তাঁকে সমাদর করে কোক খেতে দেন। তাঁর ফোনে কথা বলেন পরিচিত এক ভাবির সঙ্গে। সেই ভাবিই তাঁকে স্টেশনে এসে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান তাঁর বাসায়। মেলবোর্নে এক সুহৃদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাঁর সেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে সময় লাগে না। প্রবাসে এটি বাঙালীদের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র। এর জন্য জায়গামতো পৌঁছে যেতে বা যোগাযোগ করতে পারলে বিদেশে কোথাও ঠেকে থাকে না কোন বাংলাদেশী। মেলবোর্নের ব্যবস্থাটি হয়ে যেতেই মিলনকে ফোনে খবরটি দিতে গেলে তিনি আবেগাক্রান্ত হয়ে বলেন, আপনি আমাকে চেনেন না, জানেন না। এভাবেই তো বাংলাদেশীদের অকুণ্ঠ ভালবাসা-সমর্থন পাবার কারণে আমি দেশের দল আর ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসায় এভাবে ছুটে বেড়াতে পারছি। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্নে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে খেলা বাংলাদেশের। এর আগেই মেলবোর্ন পৌঁছে যাবেন মিলন। এক প্রবাসী বাংলাদেশী তাঁকে সেখানে রিসিভ করা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, মাঠে নেয়া-আনার দায়িত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশের পরবর্তী খেলা নিউজিল্যান্ডের নেলসনে। আপাতত সে খেলা দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁর নেই। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় তাঁকে সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা দেয়া হয়েছে। কাজেই নিউজিল্যান্ড গেলে ৯ মার্চ এডিলেডে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা দেখা তাঁর আর হবে না! বাংলাদেশ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে গেলে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় খেলাগুলো দেখা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিও তিনি নিতে চাইছেন না। দল নিয়ে মিলনের আরও কিছু কথাÑ দলের বিশেষ কোন খেলোয়াড় না, সব খেলোয়াড়কেই তাঁর ভাল লাগে। দল হারলে কেমন লাগে? মিলনের উত্তরÑ আমার দায়িত্ব তো দলকে জেতানো। সে জন্য দলকে উৎসাহিত করতে বলে চার-ছক্কায় বা উইকেটে হালুম-হালুম বলে দলকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি। দল হারলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তখন ভাবী আমি মনে হয় দলকে সঠিকভাবে উৎসাহিত-সাপোর্ট দিতে পারিনি। এরপর আবার নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। ভাবীÑ খেলায়তো হারজিত আছেই। আর দল জিতলে যে কী খুশি লাগে তা বলে বোঝাতে পারব না। নিজেকে তখন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। মিলনের আশা এ বিশ্বকাপে অনেক ভাল করবে বাংলাদেশ। অনেক ভাল ভাল প্লেয়ার আছে আমাদের দলে। নিজের বাঘ সাজার টি-শার্ট, পেন্টে বাঘের রং করে নিয়েছেন মিলন। খেলার আগে শুধু মুখে রঙ মাখেন। এটি একা একাই মাখেনÑ মেকাপ নেন। এতে তাঁর বেশি সময় লাগে না। খেলার পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেন মুখের রঙ!
×