ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ঢাকার দিনরাত

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে এলো। ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষের ঢল নেমেছিল। অবশ্য সেদিনও সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচী বহাল রাখা হয়েছিল। এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। আগে জাতীয় দিবসগুলোকে রাজনৈতিক কর্মসূচীর বাইরে রাখা হতো। কিংবা রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানো হতো না। এখন সবকিছুতেই রাজনীতির ফ্লেবার মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা। এমনকি ঈদের দিনও প্রীতি সমাবেশে নেতানেত্রীরা রাজনৈতিক বক্তব্য দেন- এমনটা বিগত কয়েক বছর ধরে দেখে আসছি। যাই হোক, ভাষার মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানে সামান্য কটি কথা বলতে চাই। প্রতিক্ষণ জীবনধারণের জন্য পানি ও বাতাসের অপরিহার্যতার সমতুল্য মাতৃভাষা। আবার জীবনের দাবি বা প্রয়োজনকে স্বীকার করে নিয়ে মাতৃভূমির নাড়ি ছেঁড়া ধন যখন ভিন্ন ভাষা পরিম-লে গিয়ে পড়ে এবং সে-ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে, তখনও তার সত্তার গভীরে জলহাওয়ার মতোই জ্বলজ্বলে থাকে মাতৃভাষাই। মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষা মানুষ পায় জন্মসূত্রে; জন্মের পর যে ভাষা আমাদের কানে পশে, যে ভাষায় বুলি ফোটে এবং জ্ঞান হয়, যে ভাষাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের শেখা হয়ে যায় সেই তো আমাদের আপন ভাষা। মা আর মাসি যেমন এক নয়, তেমনি মায়ের ভাষা ও পরভাষা এক হতে পারে না। তাই মাতৃভাষার উচ্চতার কাছে অন্য ভাষা নিশ্চিতরূপেই খর্বকায়। সে কারণে সত্যিকারের জ্ঞানার্জনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প কিছু হতে পারে না। জ্ঞানের পূর্ণতার জন্যেও নয়। অথচ পৃথিবীর কোন একটি জাতির কোন একটি ভাষার বইয়ে তো আর বিশ্বের সব জ্ঞান-বিজ্ঞান মেলে না। সক্রেটিস, আইনস্টাইন, শেক্সপিয়ার, জেমস জয়েস, রবীন্দ্রনাথ- এঁদের মায়ের ভাষা এক নয়। তবে বিশ্বজননীর সন্তান এঁরা সবাই, সে অর্থে তাঁদের মাতৃভাষা আবার অভিন্ন- সেটি মানবভাষা, মানব জাতির জ্ঞানের ভাষা। বিশ্বজ্ঞানের যে নিরন্তর প্রবাহ তাতে এঁরা এবং এমনি হাজারো মনীষী জ্ঞান সংযুক্ত করে গেছেন। সেসব জ্ঞান পরিপূর্ণরূপে অর্জনের মাধ্যম মাতৃভাষাই; বাঙালীর কাছে বাংলা, রুশীর কাছে রুশ। পাশ্চাত্যের এক ভাষাবিদ বলেছিলেন, একভাষিতা নিরক্ষরতার মতোই মন্দ, কারণ তা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। কথাটাকে উপেক্ষা করা চলে না। যদিও পাশাপাশি এ সত্যও অনস্বীকার্য যে মাতৃভাষার সমভিব্যাহারেই আমাদের অপর ভাষার জ্ঞান গ্রহণ করা সমীচীন। কারণ আপন ভাষার উচ্চতাকে ছুঁতে অক্ষম ভিনভাষা। জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা বুঝে নিতে পারব তারা মাতৃভাষার উচ্চতার গুরুত্ব অনুধাবনে সমর্থ হয়েছিল বলেই সেই উচ্চতাকে আশ্রয় ও অবলম্বন করেই তারা এগিয়ে গেছে সামগ্রিক উন্নতির সোপানে। আপন উচ্চতাকে ধারণ করে আপনার উন্নতি- এটাই মোক্ষম কথা। ভাষা তো নদীর মতো সতত প্রবহমান। তাতে বহু স্র্রোত এসে মেশে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের চিন্তা-ভাবনা-অনুভূতি ভাষার স্রোতের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। কবিই তো সমাজে দ্রষ্টার ভূমিকায় থাকেন। পরভাষায় মত্ত মধুসূদন অসঙ্কোচে স্বীকারোক্তি করেছেন- হে বঙ্গ ভা-ারে তব বিবিধ রতন, তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি। উপেক্ষা অবহেলা আর নয়, চাই সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে আগামীর পরিকল্পনা। মাতৃভাষার উচ্চতাকে মান্য করে এ ভাষাতেই জ্ঞানার্জনের গোড়াপত্তন করা। কাজটি দীর্ঘ ও ধারাবাহিক। বলতেই হবে ভাষার জাদু নয়, চিন্তার মূল্যই মূল্যবান করে বলাটাকে। বলাবাহুল্য সেই চিন্তাবিদই জাতির জন্য জরুরী যিনি চিন্তা করেন বাংলায়, স্বপ্ন দেখেন বাংলায়। বাংলার জন্য বাংলায় চিন্তা করলে নিশ্চয়ই আমাদের চিনে নিতে অসুবিধে হবে না জাতীয় পথরেখা ও গন্তব্য। চেনা চেহারায় ঢাকা মহান একুশ পেরিয়ে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রবিবার থেকে আবার দেয়া হয়েছে তিন দিনের হরতাল। গত কয়েক সপ্তাহে আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রথমে তিন দিন হরতাল দিয়ে পরে আবার দুদিন বাড়ানো হচ্ছে। একবারে সব কটা কর্মদিবসে হরতাল না দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়া হচ্ছে হরতাল। রবিবার প্রচ- যানজটের সৃষ্টি হয় ঢাকায়। এমনি কি রাত নটার দিকে ধানম-ির প্রধান সড়কে নিউমার্কেট থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত বড় ধরনের যানজটে মানুষ আটকা পড়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। ঢাকায় মানুষের সঙ্গে বাড়ছে যানবাহনও। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহন সাত লাখ ৯৭ হাজার ১৮৪টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল, তিন লাখ ১১ হাজার; প্রাইভেট কার এক লাখ ৯৫ হাজার, মাইক্রোবাস সাড়ে ৫৫ হাজার। প্রতিদিন রাস্তায় নামছে ১৮০টি নতুন যান। কিন্তু যানজট কমছে না। ঢাকাবাসী হিসেবে বলতেই পারি গণপরিবহনের সঙ্কটই ঢাকার প্রধান সমস্যা। কোটি মানুষের সহস্রকোটি ঘণ্টা জ্যামেই কেটে যায়। যার আর্থিক মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। ব্যক্তিগত গাড়ি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, ৪৩ বছরেও গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নাগরিকদের দায়িত্বশীলতার অভাবও এই শহরের একটি সঙ্কট। তবে ঢাকার সম্ভাবনার একটা দিক হলো ঢাকার জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থান দিতে গিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি সর্বদা চাঙ্গা থাকবে। বিশাল এই ভোক্তা শ্রেণী দেশের অসীম সম্ভাবনা। জীবিকার প্রয়োজনে যাদের প্রতিদিন মহানগরীর বড় বড় সড়ক ব্যবহার করতে হয় তারা হাড়ে হাড়ে টের পান শব্দদূষণ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী। গাড়ির হর্ন, বিভিন্ন প্রচারণার মাইক, মিটিং-মিছিল ইত্যাদি মিলিয়ে ঢাকা শব্দদূষণের এক নরকপুরী। অসহনীয় শব্দ উৎপন্ন করে থাকে কনক্রিট করার মেশিনগুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সর্বোচ্চ ৬০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ মানুষের জন্য সহনীয়। অথচ ঢাকার সায়দাবাদ ও মহাখালী এলাকায় শব্দ উৎপন্ন হয় একশ’ ডেসিবলের ওপরে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের কর্তৃপক্ষ থাকলেও এর কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো নয়। ঢাকার প্রতিটি রাস্তায় ও রাস্তার পাশের বাসায় বসবাসকারী মানুষের বসবাস করতে হয় স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দকম্পাংকের মধ্যে। গবেষকদের মতে হঠাৎ করে ১৪০ ডেসিবল শব্দমাত্রা আমাদের কানে বা শ্রবণেন্দ্রীয়ে প্রচ- ব্যথা তৈরি করতে পারে। আর ১৯০ ডেসিবল মাত্রা শ্রবণ শক্তি একেবারে নষ্ট করে দিতে পারে। বর্তমানে ঢাকার শব্দদূষণের মাত্রা যে পর্যায়ে আছে, এভাবে চলতে থাকলে একসময় ঢাকার মানুষের শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি হৃদরোগের সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। বাধাগ্রস্ত হতে পারে শিশুর মানসিক বিকাশ। এমনকি শিশুর মেধার বিকাশ ব্যাহত হতে পারে মারাত্মকভাবে। গাড়ির কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানা থেকে নির্গত সূক্ষ বস্তুকণা দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। সঙ্গে আছে ধূমপায়ীদের প্রকাশ্যে ধূমপান। পরিবেশবাদীদের ধারণা, বছরে ঢাকার বাতাসে প্রায় ৪ হাজার টন দূষিত বস্তুকণা কেবল গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে মিশছে। ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ সহনশীলতার মাত্রার চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি। এখনই যদি এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে একসময় ঢাকা কার্বনের শহরে পরিণত হতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। ঢাকায় অতিথি গত সপ্তাহে ঢাকার ভিআইপি অতিথি হিসেবে এসেছিলেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালী নেত্রী বাংলাদেশের জন্য পরম গর্বের একটি দিন একুশে ফেব্রুয়ারির সময়ে ঢাকায় থাকবেন, শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন- সব কিছুর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা সৌন্দর্য ছিল। তবে তিস্তার পানির ন্যায্য ভাগটি বাংলাদেশ পায়নি এই মমতারই কারণে এটা অনেকেই ভুলে যাননি। ঢাকার উদ্দেশে তখনও হয়ত বিমানে ওঠেননি মমতা। আমাদের এক রসিক বন্ধু ঝটপট স্ট্যাটাস দিলেন ফেসবুকে- দিদি কি সন্ধ্যায় আসবার সময় ঘটিতে একটু জল আনবেন? তিস্তার যে তেষ্টা পেয়েছে খুব। এ্যাপার্টমেন্ট কালচার ঢাকায় একটি বহতল ভবনে কুড়ি থেকে শত পরিবার বাস করেন। জীবন যান্ত্রিক, তাই প্রতিবেশীকে জানার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই আমাদের এ্যাপার্টমেন্ট কালচারে। লিফটে দেখা হয় একে অন্যের সঙ্গে, কেমন আছেন এটুকু কুশল শুধোনোর মন নেই। আর একটা ব্যাপার খেয়াল করছি সবাই প্রাইভেসি নিয়ে এতই সজাগ প্রতিবেশী নামক আপদকে কেউ নিজের জীবনে আনতে চায় না; বাড়তি ঝামেলা করার সময় ইচ্ছা কোনটাই নেই। প্রতিবেশীকে কে বিশ্বাস করে আজকের যান্ত্রিক যুগে? আপনি আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেলেও আপনার প্রতিবেশী সন্দেহবশত হয়ত ভাববে কী মতলবে খাতির করতে চায়? আমরা এখন শুধু নিজেদের ছাড়া কাউকে চিনি না, কারও জন্য স্বার্থ ত্যাগও করি না, এ্যাপার্টমেন্ট সোসাইটির মূল কাজ ঝগড়া মিটানো, প্রতিবেশীদের মাঝে বন্ধন গড়ে তোলা নয়। আমাদের শহুরে জীবন থেকে ‘পাড়া’ শব্দটার মতন তাই ‘প্রতিবেশী’ শব্দটাও হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী চেনেও না তাদের প্রতি আচরণেরও তোয়াক্কা করা হয় না। এক ফ্ল্যাটের রান্নাঘর থেকে অন্য ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে ছুড়ে ফেলা হয় ময়লার পোটলা। এ নিয়ে নালিশ করলে উল্টো দু’কথা শুনিয়ে দেবেন কিংবা উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দায়িত্ব সারবেন। সেদিন রাত একটা ঘুম ভেঙ্গে গেল দারোয়ানকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকাডাকি করায়। স্বামী-স্ত্রী কোথাও দাওয়াতে গিয়েছিলেন হয়ত। ফিরতে রাত হয়ে গেছে। দারোয়ান গেটে তালা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরে ঢুকতে পারছেন না তারা। এখন তাদের ডাকাডাকিতে যে অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল তার কী হবে! অন্যকে পীড়া না দিয়ে এ্যাপার্টমেন্টের সভ্যরা যেন জীবনযাপনই করতে পারে না। এদের সভ্যতা ভব্যতা শেখাবে কে? এই লেখা পড়ে হয়তা তারা কিছুটা লজ্জা পেলেও পেতে পারেন যাদের হাঁকডাকে ভোরে বা গভীর রাতে তার প্রতিবেশীদের সমস্যা হয়। ঢাকার বাড়ি ভাড়া বাড়ানো নিয়ে ভুক্তভোগীদের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের পরিচিত এক ভদ্রলোক উত্তরার একটি সেক্টরে বসবাস করছেন। জানুয়ারিতেই তার নতুন বাসার ভাড়া দু’হাজার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সন্তানের বিদ্যালয় ও নিজের অফিস কাছে হওয়ায় তার জন্য বাসাটি সুবিধাজনক স্থানে ছিল। কিন্তু একসঙ্গে দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়ার চাপ সহ্যের ক্ষমতা তাঁর নেই। এখন কী করবেন তিনি? কিন্তু আমরা ক’জন জানি, ১৯৯১ সালের ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ অনুযায়ী দুই বছরের আগে বাসা ভাড়া বাড়ানোর নিয়ম নেই। ভাড়া বাড়ানোর প্রতিকার চেয়ে তিনি আদালতে যেতে পারেন। কিন্তু তাঁর কাছে বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র নেই, ভাড়ার রসিদ নেই; এমনকি বাড়ির মালিক যে ভাড়া বাড়ানোর কথা মৌখিকভাবে বলেছেন, এর কোনো প্রমাণও নেই। কারণ ঢাকার বাড়ির বহু মালিক এসবের কিছুই ভাড়াটিয়াকে দেন না। ফলে আদালতে গেলেও তিনি অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন না। আবার আদালতে গেলেই বাড়ির মালিক যেভাবেই হোক, ওই বাসা থেকে তাঁকে বিদায় করবেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ [email protected]
×