ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুখে গণতন্ত্রের বুলি আর নজর উত্তরপাড়া, বিদেশী প্রভুদের দিকে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মুখে গণতন্ত্রের বুলি আর নজর উত্তরপাড়া, বিদেশী প্রভুদের দিকে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিএনপি নেত্রী (খালেদা জিয়া) মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে ‘উত্তরপাড়া ও বিদেশী প্রভুদের’ দিকে চেয়ে থাকেন। কখন তারা তাঁকে ক্ষমতায় নিয়ে গিয়ে বসাবেন! কিন্তু বিএনপি নেত্রীর সেই স্বপ্ন কোনদিন পূরণ হবে না। এদিকে একই অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, খালেদা জিয়া ইবোলা ভাইরাসের মতো সন্ত্রাস জঙ্গীবাদের যে ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশে, কড়া এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে সেই ভাইরাস নিশ্চিহ্ন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, খালেদা জিয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসও করেন না। আর উনি যদি মনে করেন দু’তিনটা বোমা ফাটিয়ে, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলেই সরকার পড়ে যাবে- তবে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কোন সুযোগ নেই, সংবিধানে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের (সর্বোচ্চ শাস্তি) বিধান রয়েছে। অতীতে যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল তাদেরকেও খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। অনেককে দেশ ছেড়ে (মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন) যেতে হয়েছে। তাই এসব পরিণতির কথা ভেবে কেউ আর সেদিকে পা দেবেন বলে আমি মনে করি না। রবিবার বিকেলে রাজধানীর খামারবাড়িস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রী জনগণকে অবরুদ্ধ করে রেখে নিজেই গুলশানের কার্যালয়ে নিজেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। উনি দেশকে দোজখখানা বানাতে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছেন কিসের আশায়? নির্বাচনে না আসার নিজের ভুলে এখন উনি জনগণের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। দেশের জনগণ আর এসব জঘন্য কর্মকা- বরদাস্ত করবে না। মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার জন্য একদিন খালেদা জিয়াকেও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আর যারা এসব নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গে জড়িত তাদেরও কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন দলটির প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক রাহাত খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, এম এ আজিজ, আহমদ হোসেন, কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও আমিনুল ইসলাম আমিন। ড. হাছান মাহমুদ ও অসীম কুমার উকিলের পরিচালনায় সভার শুরুতেই ভাষা শহীদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছেন, দেশ ধ্বংস করছেন। এটাই কী তাঁর গণতন্ত্রের নমুনা? আসলে উনি গণতন্ত্রের নামে দেশে জঙ্গীতন্ত্র ও সন্ত্রাসতন্ত্র চালু করেছেন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী জঙ্গী গোষ্ঠীর তৎপরতার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের চলমান নাশকতার একটি যোগসূত্র স্পষ্ট। আইএস (ইসলামিক স্টেট) যেভাবে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে, আইএসআই’র (পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা) মদদে খালেদা জিয়ারাও একই স্টাইলে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছেন। বিএনপি নেত্রীর প্রতিহিংসার আগুনে আজ পুরো দেশকেই জ্বালিয়ে দিতে চাইছেন। তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রী অবরোধ ডেকে নিজেই নিজেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। এই মহিলার বুকে বিন্দুমাত্র দয়া-মায়া নেই। খেটে খাওয়া মানুষ, নিরীহ বাস-ট্রাক চালক, শিশু এমনকি অন্তঃসত্ত্বা মা পর্যন্ত খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার আগুন থেকে রেহাই পায়নি। আন্দোলনের নামে মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে হত্যার রাজনীতি অতীতে কখনও দেশের মানুষ দেখেনি, যা বিএনপি-জামায়াত জোট করেছে। আসলে এতিমের টাকা আত্মসাতের মামলা থেকে নিজেকে রক্ষার জন্যই উনি এসব জঘন্য কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, নানা আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে খালেদা জিয়া এভাবে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে যাচ্ছেন। নিজের দেশের জনগণের পরিবর্তে উনি পরদেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর এত আশা সেই দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রীও বিএনপি নেত্রীকে নাশকতা-সহিংসতা ও মানুষ হত্যা বন্ধ করতে বলেছেন। বিএনপি নেত্রী এসব বাস্তবতা বুঝতে পারছেন কি-না, তা জানি না। যে প্রভুদের দিকে উনি তাকিয়ে আছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু আমরা যুদ্ধ করেই দেশকে স্বাধীন করেছি। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময়ও অনেকে বাধা দিয়েছিল, আমরা সব বাধা অতিক্রম করেই নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে- কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনারা যখন বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তখন দেশের মানুষ ভেবেছিল তাঁরা খালেদা জিয়াকে হরতাল-অবরোধের নামে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা বন্ধ করতে বলবেন। এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করতে বলবেন। এত তাঁরা ন্যায়-নীতির কথা বলেন, টকশোতে টেলিভিশন ফাটিয়ে ফেলেন, কিন্তু খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এসব কোন কথাই তাঁরা বলেননি। হয়ত তাঁরা মনে করছেন, এভাবে খালেদা জিয়া ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে গেলে দেশে কিছু একটা ঘটবে, অনেকের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়তে পারে। কিন্তু তাদের সেই আশাও কোনদিন পূরণ হবে না। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট গঠিত নাগরিক কমিটির প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, সুশীলদের নিয়ে ১৭ জনের একটি কমিটির তালিকা দেখলাম। যাদের অধিকাংশই সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন। কর্মরত থাকা অবস্থায় অনেককেই পদোন্নতির জন্য, মুখ্য সচিবসহ নানা পদের জন্য আমাকে তদ্বির করতে দেখেছি। সরকারী চাকরি শেষেই তাঁরা সুশীল হয়ে আজ আমাদের সবক দিচ্ছেন, নানা কথা বলছেন। কিন্তু দেশের মানুষ আজ খুবই সচেতন। কেউ মিথ্যা কথা বলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। আর সুদখোর, ঘুষখোর ও চাটুকারদের দিয়ে কখনও কোন দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন করতে, আমরা তা প্রমাণও করেছি। প্রধানমন্ত্রী দলের নেতাকর্মীসহ দেশের সচেতন মানুষকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের শিক্ষা দিয়েছে কারোর কাছে মাথানত না করা। সেই আদর্শ নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বৃত্ত ও নাশকতাকারীরা যে যেখানেই রয়েছে, খুঁজে বের করে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে সোপর্দ করুন। প্রত্যেক এলাকা এলাকায় কে বোমা মারছে, কে বানাচ্ছে, কে অর্থের যোগান দিচ্ছে- তা খুঁজে বের করুন। সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। যাতে আর কেউ এভাবে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করতে না পারে। একাত্তরের হানাদার বাহিনীর মতোই খালেদা জিয়া দেশে গণহত্যা চালাচ্ছেন। তাই এত মানুষ হত্যার অভিশাপ থেকে খালেদা জিয়াও রেহাই পাবেন না। তাঁর বিচার একদিন বাংলার মাটিতে হবে। যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে, নাশকতা চালাচ্ছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতেই হবে। কেউ-ই রেহাই পাবে না। বিএনপি নেত্রী ধর্ম-কর্ম কিছুই মানেন না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব এজতেমা, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর দিনেও উনি হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ খুন করাচ্ছেন। উনি ধর্মে-কর্মেও বিশ্বাস করেন না। উনি বাড়ি ছেড়ে অফিসে বসে আছেন সরকার পতনের আশায়। ওই অফিসে এমন কি আছে যে উনাকে বসে থেকে পাহারা দিতে হচ্ছে? স্বামীর জন্মদিনে এমনকি নিজের ছেলের কবর পর্যন্ত জিয়ারত করতে যাননি। উনি কী মানুষ? তিনি বলেন, নিজের নাতনির পরীক্ষার জন্য মালয়েশিয়া পাঠান, আর কোমলমতি দেশের ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা দিতে বাধা দিতে প্রতি কর্মদিবসে উনি হরতাল-অবরোধ দিয়েই যাচ্ছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিএনপি নেত্রীকে কে অধিকার দিয়েছে এভাবে মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে, ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবনকে ধ্বংস করতে? তিনি বলেন, গুলশানের কার্যালয়টি তো একটি বিলাসবহুল বাড়ি। ঝাড়বাতি, দামী কার্পেটসহ সবই আছে। সেখানে বসে উনি মানুষকে হত্যা করছেন। উনার খাবার-দাবারের কোন অসুবিধা নেই, সবই যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে অপরিচিত কারোর খাবারের কারণে তাঁর যদি কোন ক্ষতি হয় তখন তো আমাদেরই দোষী করা হবে। আর বাড়ি ছেলে অন্যত্র থাকা বিএনপি নেত্রীর কাছে নতুন কিছু নয়। এ সময় তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ নানা সময়ে হঠাৎ করেই খালেদা জিয়ার আত্মগোপনে যাওয়ার ইতিহাস তুলে ধরেন। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে বিশ্বাস করেন না বলেই শ্রদ্ধা জানাতে যাননি। অতীতে পাকিস্তানীরা সেখানে মসজিদ বানিয়েছিল, হয়ত কোনদিন ক্ষমতায় আসলে উনিও (খালেদা জিয়া) শহীদ মিনারের স্থলে মসজিদ বানাতে পারেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দেশ, দেশের জনগণ ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যারা সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদ ও নাশকতার সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে যারা সংলাপের কথা বলেন, তারা বাস্তবে দেশের অগ্রগতিরই বিরুদ্ধে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীদের নেত্রী হয়ে খালেদা জিয়া ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তার পাশে বিএনপির নেতাকর্মীরাও আজ নেই। বিশ্বের কোন দেশেই কোনদিন সহিংসতা, নাশকতা ও জঙ্গীবাদের কাছে গণতন্ত্র জিম্মি হয়নি। বরং গণতন্ত্রেরই বিজয় হয়েছে, খালেদা জিয়াও পরাজিত হবেন। মতিয়া চৌধুরী খালেদা জিয়াকে ‘ফোর টোয়েন্টি নেত্রী’ আখ্যায়িত করে বলেন, শুধু দেশের মানুষের সঙ্গেই নয়, বিদেশীদের সঙ্গেও বিএনপি নেত্রী ফোর টোয়েন্টিগিরি করেছেন। পৃথিবীর কোথাও জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ কোনদিন জিততে পারেনি, বাংলাদেশেও পারবে না। বরং খালেদা জিয়া ইবোলা ভাইরাসের মতো যে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের ভাইরাস দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন, কড়া এ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে সেই ভাইরাসকে নিশ্চিহ্ন করা হবে।
×