ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সন্ধান ;###;বিপুল অস্ত্র উদ্ধার;###;বিমান ধ্বংস ও ছিনতাইসহ জঙ্গী তৎপরতার ট্রেনিং দেয়া হতো

বাঁশখালীর দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গী আস্তানা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাঁশখালীর দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গী আস্তানা

জোবাইর চৌধুরী, নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঁশখালী ॥ চট্টগ্রামের বাঁশখালির সাধনপুর ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে মিলেছে জঙ্গী আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান। গত শনিবার বিকেল থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত পরিচালিত অভিযান ও তল্লাশিতে আবিষ্কৃত হয় আস্তানাটি। সেখানে গবাদি পশু পালন ও পোল্ট্রি ফার্মের আড়ালে চলে আসছিল জঙ্গী প্রশিক্ষণ। হাটহাজারী থেকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হওয়া ১২ জঙ্গীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ অভিযান চালায় র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ওই আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ৫ জঙ্গীকে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জঙ্গী আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির সন্ধান পাওয়া যায় বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি নামক দুর্গম পাহাড়ে। সেখানে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় একে-২২ রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলা বারুদ ও সামরিক সরঞ্জাম। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩টি একে-২২, ৬টি বিদেশী পিস্তল, ১টি রিভলবার, ৩টি দেশীয় তৈরি বন্দুক, ৬টি একে-২২-এর ম্যাগজিন, ৯টি পিস্তলের ম্যাগজিন ও ৭৬১টি বিভিন্ন ধরনের গুলি। এছাড়া উদ্ধার হয় ৩টি চাপাতি, ২টি ওয়াকিটকি, মার্শাল আর্টের সরঞ্জাম ১৪ জোড়া, জঙ্গল বুট ২ জোড়া, পিটি সু ৪ জোড়া, ৩৮ সেট প্রশিক্ষণের পোশাকসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। স্থানীয় ও র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ১২ জঙ্গীকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত শনিবার বিকেল থেকে অভিযান শুরু হয় বাঁশখালির সাধনপুর দুর্গম লটমনি পাহাড়ে। সেখানে আবিষ্কৃত হয় জঙ্গী আস্তানা। গবাদি পশু ও মুরগি খামারের আড়ালে চলছিল জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ কাজ। এর আগে হাটহাজারী থেকে গ্রেফতার জঙ্গীদের তথ্যে নিশ্চিত হয়েই র‌্যাব-৭ অভিযান পরিচালনা করে। র‌্যাব-৭-এর একটি বিশেষ দল প্রথমে ওই এলাকায় অবস্থান নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। এরপর চালানো হয় অভিযান। সেখানে অবস্থিত মৌলানা মোবারকের গরু, ভেড়া ও মুরগির ফার্মকে ঘিরে বিশেষ জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পান তারা। অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় ৫ জঙ্গীকে। তারা হলো- মোঃ মোবাশ্বের হোসেন (১৭), মোঃ আবদুল খালেক (২১), আমিনুল ইসলাম (২২), হাবিবুর রহমান (১৯) ও আমির হোসেন (২৫)। আটক জঙ্গীদের বাড়ি ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায়। গ্রেফতার ৫ জনের তথ্য অনুযায়ী পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে মজুদ করে রাখা পলিথিন মোড়ানো অস্ত্রগুলো ড্রামের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে জঙ্গীরা এই অস্ত্রগুলোর সন্ধান দিলেও গহীন অরণ্যের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আশপাশে আরও অস্ত্র মজুদ থাকতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা। কারণ, বিগত সময়ে আন্দোলনের নামে বাঁশখালিতে ব্যাপক নাশকতামূলক কর্মকা- পরিচালিত হয়েছে। র‌্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও মনে করছেন, বাঁশখালির এ দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় আরও অস্ত্র থাকতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তারা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। র‌্যাব সূত্র জানায়, জঙ্গীরা সেখানে বিভিন্ন দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার নাম করে এনে জঙ্গী মানসিকতায় গড়ে তুলছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নিহত এবং নির্যাতিত মুসলিমদের ছবি দেখিয়ে কোমলমতি কিশোরদের উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাদের কাজ। এরপর চলে সামরিক কায়দায় তাদের প্রস্তুত করার কার্যক্রম। অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ এমনকি বিমান ভূপাতিত ও বিমান ছিনতাইয়ের প্রশিক্ষণও দেয়া হত এই কেন্দ্রে। কিভাবে রশির মাধ্যমে দুর্গম গন্তব্যে পৌঁছানো যায় এবং ফায়ারিংয়ের সঠিক নিশানা করার মতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ওই আস্তানায় রয়েছে বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো এবং দেখানো হয়। জঙ্গী আস্তানাটি বাঁশখালী-সাতকানিয়ার পাহাড়ী সীমান্তে হওয়ায় প্রশিক্ষণ নিতে আসা জঙ্গীরা সাতকানিয়া পাহাড় হয়ে এই স্থানে প্রবেশ করত বলে স্থানীয়দের অভিমত। তবে এখানে অবস্থিত মৌলানা মোবারকের গরু, ভেড়া ও মুরগির ফার্মের অধিকাংশ মালামাল বাঁশখালী সীমান্ত দিয়ে ওই ফার্মে আনা-নেয়া করা হতো। মৌলানা মোবারক বাঁশখালি ছনুয়া এলাকার বাসিন্দা হলেও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তিনি সাধনপুর এলাকায় চলে আসেন। সাধারণ জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা এই মৌলানা ফার্মের ব্যবসার আড়ালে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তুললেও তার সঙ্গে আরেকটি নাম উঠে এসেছে। তিনি পার্শ্ববর্তী চকরিয়া উপজেলার মোঃ আজিজ। পাহাড়ী এলাকায় জমি ক্রয়-বিক্রয় সরকারী গেজেট অনুসারে নিষেধ হলেও প্রায় ২ বছর পূর্বে জনৈক মাকছুদের (বর্তমানে মৃত) কাছ থেকে ৩ কানি জায়গা ক্রয় করেন মৌলানা মোবারক ও আজিজ। ক্রয় করার পর সেখানে প্রায় অর্ধশত কানি পাহাড়ী জায়গা দখল করে নেন তারা। গবাদি পশু পালনের আড়ালে সুবিশাল জঙ্গী আস্তানা গড়ে তুললেও পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় তাদের কার্যক্রম প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে যায়। তাছাড়া পোল্ট্রি ফার্মের মালামাল আনা নেয়া ছাড়া জঙ্গীদের আসা যাওয়ার গোপন পথটি সাতকানিয়া পাহাড়ী এলাকা হয়ে। তাই জঙ্গীদের আসা যাওয়াও ছিল স্থানীয়দের অগোচরে। এদিকে, র‌্যাবের বিশেষ অভিযানে ৫ জঙ্গীসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও অস্ত্র সরঞ্জাম উদ্ধার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে ওই আস্তানা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মৌলানা মোবারক ও আজিজ। এ দু’জনই সেখানে খামার পরিচালনা করছিল। দেশ বিরোধী নানা অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্ব থাকায় এলাকাবাসী তেমন বেশি কিছু অবগত নয় এই দু’জনের ব্যাপারে। র‌্যাব সেভেন-এর পরিচালক (মিডিয়া) লে. কর্নেল মুফতি মাহবুব অস্ত্র উদ্ধার ও জঙ্গী আস্তানার সন্ধান সম্পর্কে বলেন, এলিট ফোর্স র‌্যাব জঙ্গী দমনে সারা দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী একটি মাদ্রাসা থেকে অভিযান চালিয়ে ১২ জঙ্গীকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বাঁশখালির লটমনি দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গীদের প্রশিক্ষণের আস্তানা থাকার তথ্য পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী বাঁশখালিতে র‌্যাবের একটি দল অবস্থান নেয়। রবিবার ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৫ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। আটকদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে তাদের মূল উদ্দেশ্য ও টার্গেট কি? জঙ্গীদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, জঙ্গীদের সঙ্গে আলকায়দা ও আইএসের একটি যোগসূত্র রয়েছে। তবে জামাতের সঙ্গেও তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসবে।
×