ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব পথ রোমে যায় না

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সব পথ রোমে যায় না

এককালে প্রবাদ ছিল, সব পথ রোমে যায়। ইতালির রোমকে নিয়ে এই প্রবাদ একুশ শতকে এসে বদলে গেছে। একালে বলা যায়, সব পথ রোমে যায় না। আর তা হয় না বলেই, বাংলাদেশে পরাজিত শক্তির দেশ ধ্বংস প্রকল্পও অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। ধ্বংসের বীভৎস গান যারা গাইছেন, মানুষকে পুড়িয়ে মারছেন, অর্থনীতিসহ জনজীবনকে পর্যুদস্ত করছেন; তারা সবই করছেন একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীন দেশকে আবারও পরাধীনতার নিগড়ে বাধার আয়োজন নিয়ে বহুদিন ধরেই সচেষ্ট ঘাতককুল সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। কিন্তু জনসমর্থন না থাকা এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তাদের কোন প্রচেষ্টাই সফলতার দিকে ধাবিত নয়। সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গীবাদের যতই বিস্তার ঘটানো হোক, এদেশের মানুষের স্বভাবজাত যে বৈশিষ্ট্য, তাতে এই অপশক্তিগুলো হালে পানি পাবে, তা নয়। একাত্তরে যে শক্তিশালী সশস্ত্র পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে নয় মাসের যুদ্ধে বাঙালী পরাজিত করেছিল, তাদের সহযোগীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে গত চার দশক ধরেই। কিন্তু তারা হালে পানি না পেয়ে জনগণকে শত্রু চিহ্নিত করে তাদের ওপর ক্রমাগত আঘাত হেনে চলেছে। একতরফা যুদ্ধ ঘোষণা করে নানা পন্থায় অরাজকতা ও অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করছে। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, এই বাংলাদেশে তাদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাস্তিদান সবই চলছে। আর এই বিচার কেন চলছে, সেই ক্ষোভ নিয়ে তারা দেশজুড়ে প্রায়শই তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে। কিন্তু জনগণ তাদের অরাজকতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান তৈরি করায় তারা পদে পদে পিছু হটে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ অবস্থান নিয়েছে। তাই দলীয় জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে চোরাগোপ্তা পেট্রোলবোমা মেরে মানুষকে দগ্ধ করছে। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেই একাত্তরের কায়দায়। তাদের এই অপকর্ম জনসমর্থনহীন বলেই হামলাকারীরা গণধোলাইয়ের শিকার হচ্ছে। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে দেশে যা চলছে, তা এককথায় ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ চালানো। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনীতির পথ থেকে সরে এসে নাশকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গীপনাকে মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়ে অরাজকতার নীলনক্সা বাস্তবায়ন করছে। লক্ষ্য তাদের যুদ্ধাপরাধীদের যে কোন মূল্যে মুক্ত করা এবং তা সম্ভব হলে বাংলাদেশকে তাদের দলীয় লক্ষ্য হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠন করা। তাদের বিশ্বাস পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করা গেলে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস সমন্বিত দল জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে সামনে বর্ম হিসেবে রেখে দেশকে পশ্চাদমুখী করে ধর্মের নামে শোষণ, শাসন, ত্রাসন অব্যাহত রাখতে পারবে। সেই স্বপ্ন পূরণে তাদের নেতৃত্বদান করছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। জামায়াতের রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে তিনিই এখন কা-ারি। বেগম জিয়ারও স্বার্থ রয়েছে। জামায়াতের সশস্ত্র শক্তিকে পুঁজি করে তিনি তার নিজের ও পলাতক পুত্রের বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পাবেন। তাই ‘সংলাপ’ ‘সংলাপ’ বলে যে প্রলাপ চালাচ্ছেন, তার মূলে নিজেকে অপরাধমুক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। দুর্নীতির মামলায় সাজা হলে তার পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া দূরে থাক, রাজনৈতিক দলপ্রধানের দায়িত্বপালনও দুষ্কর হয়ে উঠবে। এই দুই শক্তিই পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। আর তাই দেখা গেছে, জামায়াত কখনও শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যায় না। তাদের প্রতি সহানুভূতি বা সহমর্মিতা জানিয়ে হোক আর নাই হোক বেগম জিয়াও শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর পথে যাননি। বরং ‘অফিস কাম রেসিডেন্সে’ মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন। সারা জাতির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি গেয়ে উঠতে পারেননি ‘...একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি।’ পাকিস্তানী চেতনার সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি যায় না। চেতনায় পাকিস্তান ধারণ যার, তার পক্ষে বাঙালীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করা কষ্টকল্পিত। ‘পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ’ শব্দের মধ্যে বরং তারা তাদের প্রাণপ্রবাহ খুঁজে পায়। মাসতিনেক আগে এক সমাবেশে বেগম জিয়া বলেছিলেন, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। শুনে অনেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। তবে অনেকেই একে বেগম জিয়ার ‘সত্যতার লেশহীন’ বক্তব্য হিসেবেই মূল্যায়ন করে এমনটাই মন্তব্য করেছেন যে, এই বক্তব্যকে অস্বীকার করে ফেলতে সময় নেবে না। কারণ সত্যকে দ্রুত অপসৃয়মাণ করে ফেলায় ওনার জুড়ি নেই। বিদেশী পত্রিকায় পত্র লিখে বাংলাদেশকে জিএসপিসুবিধা না দেয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। পরে সংসদে দাঁড়িয়ে তা অস্বীকার করেন। বলেন যে, তিনি এই চিঠি লেখেননি। এটা অত্যন্ত সত্য কথন। কারণ, এমন চিঠি লেখার দক্ষতা না থাকার কথাটাই তিনি বলেছেন। তার নামে তার দলের লোকজনের লেখা চিঠিটি ছাপার কাহিনী পরে প্রকাশিতও হয়েছে। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী না হলে কে হবেন তার দল বা জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী, সে প্রশ্নটি ওঠেনি কোন দিক হতে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও পলাতক পুত্র তারেককে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন করেছেন। দলের অন্য কোন নেতা কিংবা তার পক্ষাবলম্বনকারী ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ রাজনৈতিকভাবে এতিম কেউই প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নয়। যে পুত্রকে এদেশের মানুষ চায় বিচারে সাজা শেষে কারাজীবনে, তাকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসানোর জন্যই বেগম জিয়া স্বাভাবিক রাজনীতির পথ থেকে সরে গিয়েছেন। সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে সরকারকে হটিয়ে পুত্রকে ক্ষমতায় বসানোর স্বপ্নে মশগুল হয়ে অবরোধ ও হরতালের আড়ালে গণআতঙ্ক তৈরি করে যাচ্ছেন। কিন্তু এই পুত্রটিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করা স্বাভাবিক পন্থায় দূর অস্ত। মানি লন্ডারিংয়ের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারেকের প্রবেশাধিকার নেই। দুর্নীতির অভিযোগে যার স্কন্ধদেশে অনেক মামলা। এমনকি ‘আর রাজনীতি করবেন না’ বলে মুচলেকা দেয়াজন এদেশে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে বলেই জঙ্গীবাদের ক্রোড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের বিরুদ্ধে গত ৬ বছর ধরে বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্র শুধু নয়, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির জনককেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আর তাই বেগম জিয়া চার দেয়ালের গ-িতে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া বাড়িতে বসে হিন্দী সিনেমার ডনদের মতো ফোনে, মেইলে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। পেট্রোলবোমা মেরে দেশে অরাজকতা তৈরি করে ঘোলাজলে মাছ শিকার তথা ক্ষমতার চৌহদ্দিতে স্থান নেবেন এমন ধারণায়। নিজে কর্মী ও নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে কাঁটাতারের বেড়াঘেরা ‘অফিস কাম রেসিডেন্সে’ অবস্থান করছেন। স্বপ্ন দেখছেন, এখান থেকেই তিনি বঙ্গবভনে গিয়ে শপথ নিচ্ছেন, অথচ সারাদেশে কোন নেতাকর্মীই রাজপথে নেই। মাঠে-ঘাটেও মেলে না। আছে ২০১৩তে গৃহযুদ্ধ ঘোষণা করা জামায়াত-শিবির এবং তাদের ছত্রছায়ায় আইএসআই পরিচালিত জঙ্গী সংগঠনগুলো। পাকিস্তান অতীতেও মার্কিনী চাপে জঙ্গীদের কারাগারে নিয়ে যায়নি। বরং তাদের গোপনে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। এই চক্রের সহায়তা নিয়ে ছায়ানট, উদীচী, গোপালগঞ্জে এবং ২১ আগস্টে ও ১৭ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে, রিমোট কন্ট্রোলে। তখন ছিল হাওয়া ভবন (এখন গুলশান ভবন)। সেই ভবন থেকে পরিকল্পনা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার নৃশংস প্রচেষ্টা চালিয়ে ২১ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনায় হাওয়া ভবন, গোয়েন্দা সংস্থা ও চোরাচালানিখ্যাত মন্ত্রীকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের ভোটারসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল। আতঙ্ক ও ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল। দেশজুড়ে জেএমবি, বাংলাভাই, হরকত-উল-জিহাদ, লস্করই তৈয়বাসহ নানা নামের এলাকাভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এদের অর্থ ও অস্ত্র যোগান দিত হাওয়া ভবন; যার একটা অংশ আসত আইএসআই হতে। যে আইএসআই ২০০১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসার জন্য অর্থ সাহায্য করেছে বলে পাকিস্তান সংসদেই বলা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সাধারণ জনগণকে টার্গেট করেছেন বেগম জিয়া জামায়াতের সহায়তায়। কিন্তু তার এই কর্মসূচী খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সমর্থন করছে না; যারা একাত্তরে পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। গণতন্ত্রের কথিত আন্দোলনে খালেদা জিয়া হচ্ছেন জামায়াতীদের হাতের শিখ-ী। একইসঙ্গে এই জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে প্রধান একটি দল হিসেবে বিএনপির মৃত্যুগীতও গাওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিএনপি পরিচিত হবে জামায়াতী-বিএনপি হিসেবে। ধর্মের নামে জামায়াতের জঙ্গী, হিংস্র, কুৎসিত, ফ্যাসিস্ট চেহারা বিএনপিও তখন অসহায়ভাবে দেখবে। কারণ জামায়াত চায় না তারেক ক্ষমতায় আসুক। যেমন চায় না বিএনপির সিনিয়র নেতারাও। তারেককে ক্ষমতায় বসাতে খালেদার এই নাশকতাকে তাই বিএনপির নেতাকর্মীরাও সমর্থন করছে না। কেবল তারেক রহমান অনুসারী ছাড়া। জনগণের চোখ-কান খোলা। তারা সতর্কও। আর সে কারণেই তারেককে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কোন আন্দোলন, সংগ্রামও হয় না। বেগম জিয়া দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুলশানে ‘অফিস কাম রেসিডেন্সে’ বসে যে ষড়যন্ত্রের শিকা পাকাচ্ছেন, সেই শিকায় ঠাঁই পাবে একাত্তরের পরাজিত শক্তিই, যাদের তিনি কারাগার থেকে মুক্ত করতে চান; যাদের ভরসায় তিনি দেশজুড়ে নাশকতা চালিয়ে গণমানুষকে নারকীয় শিক্ষা দিয়ে ক্ষমতার মসনদে পুত্রকে বসাতে চান এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তানী চেতনাকে বিকশিত করতে পাকিস্তানের সমর্থনে একটি কনফেডারেশন করে ভারতবিরোধী জজবা অব্যাহত রাখতে চান। কিন্তু এই স্বপ্ন যে আদতে দুঃস্বপ্ন। কারণ জনমত অনুকূলে না থাকলে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বেশিদূর যাওয়া যায় না। কিন্তু চেষ্টা যে তিনি করছেন এবং প্রচ- পরিশ্রমও চালাচ্ছেন এই খাতে। সেখানে সহমর্মী হিসেবে পেয়েছেন বি. চৌধুরী, ড. কামালের মতো রাজনৈতিক এতিমদের। যাদের সঙ্গে জনগণের কোন সম্পর্ক নেই। খালেদা জিয়াকে ‘দেশনেত্রী’ অভিধা দিয়েছেন যারা তারাও জানেন না যে, বেগম জিয়া এদেশের নেত্রী হিসেবে দেশের প্রতি সামান্য দয়া-দরদ ধারণ করেন না। বরং পাকিস্তানীদের প্রতি যৌবনকালের যে প্রীতি সেখান থেকে সরে আসতে পারেননি। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচী নিয়ে খালেদা জিয়া মাঠে নেমে যেভাবে পিছিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে তার সব পথ গণতন্ত্রের দিকে নয় জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের পথে হেঁটেছে। তাই গণতন্ত্র নামক সোনার হরিণটি গলা টিপে মেরে ফেলতে নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করে আজ অনুতপ্ত। সেই অনুতাপ থেকেই তিনি মানুষ নিধনে নেমেছেন। বেগম জিয়ার পথ আজ রাজনীতিমুক্ত হয়ে সন্ত্রাসের দিকে ধাবিত। তাই স্পষ্ট করে বলা যায়, খালেদার পথ গণতন্ত্রের দিকে যায়নি। যেমন সব পথ রোমে যায় না। আর যাবার কোন সম্ভাবনাও নেই। [email protected]
×