ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাংকে ৭১৭ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাংকে ৭১৭ কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকিং শুধু বড়দের জন্যই নয়, স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও এই কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘স্কুল ব্যাংকিং’। ২০১০ সালে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রম শুরু হলেও স্কুলের শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সালে। ওই বছরে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেশের ব্যাংকগুলোতে ৩০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা আমানত রাখে। চার বছরের ব্যবধানে ডিসেম্বর শেষে খুদে সঞ্চয়ীদের ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েছে ৭১৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। প্রথম বছরে ২৯ হাজার ৮০ শিক্ষার্থী এ্যাকাউন্ট খোলে। ডিসেম্বর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার ৩০৩টি। জানা গেছে, ২০১০ সালের নবেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিংয়ের জন্য নিয়মাবলী জানিয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সঞ্চয়ের মাধ্যমে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। এর পরের চার বছরে এর বিস্তৃতি রীতিমতো বিস্ময়কর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হিসাব খুলতে একটি নীতিমালাও তৈরি করে দেয়। শুরুতে ১০ টাকা দিয়ে হিসাব খোলা হলেও পরে এই হিসাব খুলতে ১০০ টাকা জমা রাখতে বলা হয়। এসব হিসাব সাধারণ চলতি হিসাবেও রূপান্তরের সুযোগ আছে। কোন কোন ব্যাংক আলাদা কাউন্টার বা ডেস্ক খুলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য এখন এ সেবা দিচ্ছে। এমনকি ব্যাংকগুলো কোন একটি নির্ধারিত দিনে স্কুলে গিয়েও শিক্ষার্থীদের হিসাব খুলে দিচ্ছে। নিয়মটা হচ্ছে এরকমÑ ৬ থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীরা স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খুলতে পারবে। ছাত্রছাত্রীর পক্ষে পিতা-মাতা বা আইনগত অভিভাবক হিসাবটি পরিচালনা করবেন। সাধারণ হিসাব খুলতে যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো ফরম রয়েছে, সঙ্গে আছে একটি গ্রাহক পরিচিতি (কেওয়াইসি) ফরম। সেগুলো পূরণ করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের জন্ম নিবন্ধন সনদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জোহরা তাইবার নামে খোলা হয়েছে একটি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট। প্রতিমাসেই এ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে কিছু টাকা। তার বাবা আলী আজম খাঁন বলেন, ছোটবেলায় বাবাকে দেখতাম বাঁশের খুঁটিতে টাকা জমাতে। আমি নিজেও মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়েছি। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার জন্যও একটি হিসাব খুলে দিয়েছি। রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সানজিদা সুলতানার এরকম একটি হিসাব রয়েছে বেসরকারী এনসিসি ব্যাংকে। সানজিদা বলল, আমি টাকা জমাচ্ছি ভবিষ্যতে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাব এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকে কোন অর্থ নেব না বলে। গত কোরবানির ঈদে যে টাকা সালামি পেয়েছে, তা নিজেই ব্যাংকে গিয়ে জমা করেছে সানজিদা। আর তা জমা করতে গিয়ে সানজিদা ব্যাংকিং নিয়মগুলোও শিখেছে বলে জানায়। এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের এ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান খান জনকণ্ঠকে বলেন, স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাব থেকে স্কুলের বেতন বা পরীক্ষার ফি ট্রান্সফার করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। তবে এর জন্য স্কুলের সঙ্গে ব্যাংকের চুক্তি থাকতে হবে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাব পরবর্তী সময়ে অন্য হিসাবে রূপান্তর করা যাবে। তাই ছাত্রজীবনের শুরুতে একটি ব্যাংক হিসাব খুললে সারাজীবন হিসাবটি থেকে ব্যাংকিং সেবা নেয়া যাবে। জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ স্কুলশিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতেই স্কুল ব্যাংকিং। স্কুল শিক্ষার্থীদের এসব হিসাবে যে কেউ টাকা জমা রাখতে পারে। কিন্তু টাকা তুলতে পারবে নমিনি হিসাবে থাকা বাবা অথবা মা। তবে স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেট টেলার মেশিন) লেনদেনের জন্য এটিএম কার্ডও নিতে পারে শিক্ষার্থী। তার জন্য অবশ্য নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় রাখতে হবে শিক্ষার্থীকে। আর ১৮ বছর বয়স হলে সব শিক্ষার্থীই টাকা তুলতে পারবে। হিসাবগুলোয় সরকারী ফি ছাড়া অন্য কোন সেবা মাসুল ব্যাংকগুলো নেয় না। স্কুল ব্যাংকিংয়ে রয়েছে বিভিন্ন সুবিধা। স্কুল শিক্ষার্থীদের হিসাব থেকে বেতন-ফি পরিশোধও হচ্ছে। যেসব ব্যাংকে ইন্টারনেট ব্যাংকিং আছে, অভিভাবকরা সেসব ব্যাংকে অনলাইনেই এসব হিসাব থেকে বেতন-ফি পরিশোধ করতে পারছেন। এটিএম কার্ডেও এটা পরিশোধ করা যাচ্ছে। ফলে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অভিভাবকদের স্কুলে বেতন-ফি দিতে হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকিং বিষয়টির সঙ্গে সবাইকে পরিচিত করতে চেয়েছিলাম, তখন পাঠ্যপুস্তকে তা তুলে ধরার বিষয়টি এসেছিল। গুরুত্ব পায় হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়ার। তারপরই সিদ্ধান্ত নিই। এতে কোমলমতি ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ে অভ্যস্ত হতে পারবে, আমানতকারী হতে পারবে বলে উল্লেখ করেন আতিউর রহমান। তিনি আরও জানান, ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করা হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া হয়েছে, আবার প্রতি তিন মাস পর পর্যালোচনাও করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সম্প্রতি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা এবং তাতে অর্থ জমা করার প্রবণতা বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের সঞ্চয় ছিল ৬১২ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় ছিল ৪০৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ৫৬টি ব্যাংকে মোট হিসাবের সংখ্যা ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪৬৫টি। বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবের সংখ্যা ৪ লাখ ২৯ হাজার ৯৯৫টি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ১ লাখ ১ হাজার ৪৬৮টি। গত বছরের মার্চ থেকে জুন- এই তিন মাসেই খোলা হয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২১১টি হিসাব। সর্বশেষ ডিসেম্বর শেষে ৭১৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা জমা পড়েছে স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাবে। এই সময়ে খুদে শিক্ষার্থীদের এ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার ৩০৩টি। কেবল শহরে নয়, গ্রামেও স্কুল ব্যাংকিং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। গ্রাম এলাকার ব্যাংকগুলোতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা খুলেছে ৩ লাখ ২৪ হাজার ২০১ হিসাব। আর শহরে খুলেছে ৫ লাখ ৭৬ হাজার হিসাব। অথচ প্রথম দিকে দেড় লাখ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খুলতে সময় লেগেছিল আড়াই বছর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের নবেম্বর থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৪৫টি ব্যাংকে মোট ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয়েছে। ওই সময় হিসাবগুলোতে মোট স্থিতি ছিল ৯৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
×