বর্তমানে সুশীল সমাজের অনেকের ধারণা পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারির সময় ১৯৫৯ সালে অমর একুশে দিবস পালন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৯ সাল থেকে অমর একুশে দিবস পালনের জন্য ডাকসুর ভিপিকে আহ্বায়ক ও জিএসকে আহ্বায়ক করে হলগুলোর ভিপি, জিএস এবং ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ও সাধারণ সম্পাদককে সদস্য করে গঠিত কমিটি কর্মসূচী প্রণয়ন করত। বর্তমানে ডাকসু না থাকাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কমিটি গঠন করে অমর একুশে কর্মসূচী প্রণয়ন করে।
ডাকসুর পক্ষ থেকে ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশের মাসের আগমন বার্তাÑ বিবৃতি আকারে সংবাদপত্রে প্রদান করা হতো। ডাকসু কর্মসূচীতে ভোরে ডাকসু অফিসের সামনে কালো পতাকা উত্তোলন করে সমবেত ছাত্র ও জনসাধারণকে নিয়ে খালি পায়ে প্রভাতফেরি করে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি গেয়ে আজিমপুর কবরস্থানে যাওয়া হতো। সেখানে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবার মিছিল করে শহীদ মিনারে এসে ফুল প্রদান করা হতো। আর সন্ধ্যায় কার্জন হলে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এর ব্যতিক্রম কখনই ডাকসু আমলে হতো না। পরবর্তীতে এ নিয়মের পরিবর্তন হয়। নিয়মানুসারে রাত বারোটা এক মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক শহীদ মিনারে ফুল দানের নিয়ম চালু হয়। তাঁদের পর রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ফুল প্রদান করে।
এরপর মার্শাল ল আমলে ১৯৫৯ সালে প্রথম অমর একুশে পালনের ব্যাপারে আমি প্রত্যক্ষ জড়িত থাকাতে সেই দিনগুলোর সঠিক ও প্রকৃত ঘটনাবলী তুলে ধরে ভ্রান্তি দূর করার সামান্য প্রচেষ্টা করছি।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে সাংবিধানিক সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের কাজকর্ম স্থগিত করে এক ফরমান জারি করে। এর ফলে রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায় এবং আমিও ঢাকা থেকে পালিয়ে যাই। ২৭ অক্টোবর মার্শাল ল-তে মন্ত্রিসভা গঠিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি মোঃ ইব্রাহিম আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার জন্য করাচী যাওয়ার আগমুহূর্তে আমি উপাচার্য ভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। যেদিন মার্শাল ল জারি হয়, সে রাতে ডাকসু অফিস মিলিটারিরা সিল করে দেয়। তাঁর সহায়তায় ডাকসু অফিস খোলার পর আমিও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করি। এরপরই ১৯৫৯ সালের শহীদ দিবস পালন করার দায়িত্ব ডাকসুর ওপর ন্যস্ত হয়। আমাদের ভিপি বদরুল আলম কোসেকের সম্মেলনে চীনে থাকা অবস্থায় দেশে মার্শাল ল জারি হওয়ায় দেশে না ফিরে পশ্চিমের কোন এক দেশে চলে যান। আর এ সময় অন্য কোন ডাকসু সদস্য ডাকসু অফিসে আসত না। তাই এ দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে।
১৯৫৯ সালের ৩০ জানুয়ারি হল সংসদ ও ছাত্র সংগঠনের ভিপি ও জিএসদের এক সভা ডাকি। সভায় অনেকে এসে শহীদ দিবস পালন সম্বন্ধে মতামত দিতে বিরত থাকেন। তাই আমি বাধ্য হয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমি উদ্যোগ গ্রহণ না করলে চিরকাল সুশীল সমাজ আমাকে ধিক্কার দিত। সাহস করে ৩১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদার উদযাপনের আহ্বান জানিয়ে আমার স্বাক্ষরে এক বিবৃতি সকল দৈনিক সংবাদ কাগজে পাঠিয়েছিলাম। এ সময় ‘মর্নিং নিউজ’ ছাড়া সকল জাতীয় দৈনিক কাগজে আমার বিবৃতি ছাপা হয়েছিল। ১ ফেব্রুয়ারি এ বিবৃতি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ও মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর মেজর জেনারেল ওমরাও খান তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি হামুদুর রহমানকে ডেকে এ ব্যাপারে জানতে চান। উপাচার্য আমাকে ডেকে এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কোন রকম কথা না বলে বিবৃতি দেয়ার জন্য রুষ্ট হন এবং পরে আমাকে নিয়ে জিওসির নিকট যান। দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তার পর তিনি এ দিবসের প্রতি আমাদের অনুভূতি উপলব্ধি করে একুশে উদযাপনের জন্য মৌখিক অনুমতি দেন বটে, কিন্তু শর্ত থাকে যে, কালো পতাকা উত্তোলন ও মিছিল করা যাবে না।
একুশের ভোরে আমরা ডাকসু অফিসের সামনে প্রয়াত কথাসাহিত্যক, কবি ও অধ্যাপক আলাউদ্দিন আল আজাদের মাধ্যমে কালো পতাকা উত্তোলন করি। এরপর আমরা ছাত্ররা খালি পায়ে হেঁটে আজিমপুর গোরস্তানে শহীদ বরকত ও শহীদ শফিকুর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে মিছিল করে শহীদ মিনারে যাই। সেখানে সভা করে আমরা ফিরে আসি। রাতে কার্জন হলে শহীদ স্মরণে ভাষাবিদ ড. মোঃ শহীদউল্লাহর সভাপতিত্বে আলোচনাসভা হয়। এ সভায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক শাহেদ আলী, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, নাট্যকার অধ্যাপক নুরুল মোমেন ও অধ্যাপক অজিত গুহ। এই সভায় প্রধান আকর্ষণ ছিল ভারত থেকে গোপন পথে আনা শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগমের উপস্থিতি। তারপর আবদুল লতিফের আকর্ষণীয় গান। মার্শাল ল-এর মধ্যে এভাবে শহীদ দিবস পালিত হয়। এপ্রিলের মধ্যভাগে ডাকসুর নতুন কমিটির নিকট দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি আমার ছাত্র জীবনের ইতি টানি।
লেখক : সাবেক জিএস ডাকসু ও প্রাক্তন উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।