ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা দানবের কাজ, রুখে দাঁড়ান ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা  দানবের কাজ, রুখে দাঁড়ান ॥  প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান সঙ্কটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঐক্যবদ্ধভাবে সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা কোন মানুষের কাজ নয়, দানবের কাজ। এটি মানবরূপী দানবের আক্রমণ। মানবরূপী দানবরা আক্রমণ করে জীবন্ত মানুষগুলোকে পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারছে। এর চেয়ে জঘন্য কাজ আর কিছু হতে পারে না। এটা কোন রাজনীতি নয়। এটা সম্পূর্ণ খুন করা, মানুষকে হত্যা করা। তিনি অভিযোগ করেন, রাজনীতির নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার মাধ্যমে দেশে এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে তা নিরসনে বাইরে থেকে অন্যের পরামর্শ চেয়ে আনতে হয়। কারও পরামর্শ নয়, নিজেদের সমস্যা আমরা নিজেরাই সমাধান করতে পারব। এ অবস্থা কখনও চলতে দেয়া যায় না। দেশ ও মানুষের কোন ক্ষতি সহ্য করা হবে না, ক্ষতি আমরা হতেও দেব না। এ জন্য গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের ওপর আঘাতকে আমাদের প্রতিঘাত দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে। শনিবার বিকেলে মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নিজস্ব মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বক্তব্য রাখার আগে প্রধানমন্ত্রী নবনির্মিত এই মিলনায়তনটির উদ্বোধন করেন। একই সঙ্গে ইনস্টিটিউট আয়োজিত তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানমালারও উদ্বোধন করেন। দেশের চলমান পরিস্থিতিকে ‘মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে বাস্তবতা বুঝতে হবে। এ হত্যা সাধারণ হত্যা নয়। এটা স্বাধীনতার ওপর আঘাত, আমার ভাষার ওপর আঘাত, আমার অস্তিত্বের ওপর আঘাত, এটা বাঙালী জাতির ওপরও আঘাত। কাজেই এই আঘাত আমাদের প্রতিঘাত দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও মোকাবেলা করতে হয়। এ মুহূর্তে আমরা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্য দিয়ে চলছি। তিনি বলেন, বাঙালী জাতি কখনও কারও কাছে পরাজয় মানে না, পরাভব মানে না। যে কোন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস আমাদের রয়েছে। সেই ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দিবে কিভাবে আমরা এ অবস্থা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাব এবং আমরা তা পারব। তবে এ জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। সকলের মাঝে একটা সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বাঙালী জাতি একবার সচেতন হয়ে রূখে দাঁড়ালে তখন যে কোন অবস্থার মোকাবেলা আমরা করতে পারি। এ দুর্যোগও আমরা ইনশাল্লাহ কাটিয়ে উঠতে পারব। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, যে বাঙালী নিজের মাতৃভাষা ও স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করে, বুকের রক্ত ঢেলে দেয়, একদল মানুষের সেই বাঙালীকেই পুড়িয়ে মারার চেয়ে বীভৎস ও জঘন্য কাজ আর হতে পারে না। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাঙালী সবসময় এই ধরনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা করেই এগিয়ে গেছে। সব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেই অতীতের মতো এবারও তারা এগিয়ে যাবে। আমরা জানি তারা (বিএনপি-জামায়াত জোট) কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে? তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এটা কি তাদের পছন্দ না? বাংলা ভাষাও কী তাদের পছন্দ নয়? তিনি বলেন, বাঙালী জাতি বিশ্বব্যাপী যে মর্যাদা পেয়েছে সেই মর্যাদাটাই মনে হয় এ গোষ্ঠী ধরে রাখতে চায় না। আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করতে পারি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। ঠিক সে সময় এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হলো যে অন্যের কাছে থেকে পরামর্শক চেয়ে আনার চেষ্টা। আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করতে পারি। ২১ ফেব্রুয়ারি মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, এটি এমন একটি দিবস আমাদের জীবনে, যাতে দলমত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ এ দিবসটাকে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালন করে থাকেন। এ এক অভূতপূর্ব চেতনা। নিজের দেশকে ভালবাসা, নিজের মাতৃভাষাকে ভালবাসার দৃষ্টান্ত আমরা বাঙালী জাতিই সৃষ্টি করেছি। এটা অনেকের হয়ত ভাল লাগে না। অনেকে হয়ত শহীদ মিনারে যেতে চায় না। বিশ্বব্যাপী বাঙালী সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে- এটা তাদের পছন্দ নয় বলেই কী স্বাধীনতাবিরোধীরা এসব অপকর্ম চালাচ্ছে? ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে আমরা এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাংলা ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ, প্রচার ও তার চর্চা করার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা করা আমাদের একান্তভাবে প্রয়োজন। আমরা সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি এবং করে যাব। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যেও সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। বিশে^র সব মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও গবেষণার লক্ষ্যে ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে তাঁর সরকারের মেয়াদের শেষভাগে এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় এসে অন্য সব উন্নয়ন প্রকল্পের মতো এটির নির্মাণ কাজও বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই কাজ আবারও শুরু করে ২০১০ সালে শেষ করা হয়। তিনি বলেন, আজ আমাদের ওপরই দায়িত্ব পড়েছে, বিশে^র সব মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও মর্যাদা রক্ষা করার। এই মহান ও গৌরবের দায়িত্ব আমরা পালন করে যাবো। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বিশে^র অনেক মাতৃভাষাই হারিয়ে গেছে। তার পরও সব ভাষার ওপর গবেষণার মাধ্যমে এগুলোকে সমৃদ্ধ করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ‘ভাষা ও সাহিত্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ নামে একটি পুরস্কার প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার প্রস্তাবও আমরা দিয়েছি। তবে এ জন্য যত সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী মানুষের দরকার, তা থেকে আমরা এখনও কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। এটাও আমরা করতে পারবো ইনশাল্লাহ। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও এর উন্নয়নে এগিয়ে আসতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের শুরুতে মারমা, ত্রিপুরা, বোম ও মুরং ভাষায় অনুবাদকৃত অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশন করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম খান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী।
×