ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দৃপ্ত প্রত্যয়ে পালিত হলো একুশ ॥ পিশাচ রুখে দাও

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দৃপ্ত প্রত্যয়ে পালিত হলো একুশ ॥ পিশাচ রুখে দাও

মোরসালিন মিজান ॥ রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ফাল্গুনে আজ চিত্ত আত্ম ভোলা/আমি কি ভুলিতে পারি/একুশে ফেব্রুয়ারি...। একুশ বাঙালীর আত্মপরিচয়। বিপ্লবী চেতনার বহ্নিশিখা। প্রতিবাদ প্রতিরোধের বায়ান্ন। পুনঃ পুনঃ তাই উচ্চারিত হলোÑ একুশ মানে মাথানত না করা। একুশের মর্মবাণী প্রতিধ্বনিত হলো বুকের গভীরে। শহীদ মিনারের চারপাশ ঘিরে থাকা জনসমুদ্র জানিয়ে দিলÑ বাঙালী পরাভব মানে না। সব রকমের অন্যায় পাপ ও পিশাচের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে, একুশের চেতনায় এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে শনিবার পালিত হলো শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০১৫। যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে সারাদেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এ দিন শহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সর্বত্র ওড়ানো হয় শোকের কালো পতাকা। অনেকে কালো ব্যাজ ধারণ করেন। একুশের প্রথম প্রহর, প্রভাতফেরি, বইমেলা, শহর ঘুরে বেড়ানোÑ সর্বত্রই বিপ্লবী চেতনার বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিল বাঙালী। প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু। এরপর গোটা দিন একুশের চেতনার রঙে সেজেছিল বাংলাদেশ। গীতিকবির ভাষায়Ñ স্বাধীন এই বাংলা আমার/কোটি প্রাণ শহীদ মিনার/নেবই নেব, নেবই নেব/নেবই নেব আমরা মনের মতো এই দেশ গড়ে...। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় পৃথক দুই রাষ্ট্রÑ ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলের মানুষ বাঙালী। মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, পশ্তু, বেলুচ, উর্দুসহ আরও কয়েকটি ভাষা। এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মায়ের ভাষার প্রতি বাঙালীর অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেনÑ যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি...। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অনুভূতি স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার ওপর আঘাত হানে। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সকল অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে পড়ে বাংলার মানুষ। বাঙালীর সে সময়ের মনোজগত তুলে ধরে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেনÑ মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না/বলো, মা/তাই কি হয়? এরপরও নিজেদের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। গণচেতনাকে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় বাঙালীর সামনে দুর্বার আন্দোলনের বিকল্প ছিল না। সবাই যেন একসঙ্গে গেয়ে ওঠেছিলেনÑ সইমু না আর সইমু না, অন্য কথা কইমু না/যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান/এই জানের বদলে রাখুম রে/বাপ-দাদার জবানের মান...। সাধের জান হাসিমুখে বিলিয়ে দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল বাঙালী। ১৯৪৮ সাল এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার প্রমাণ। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানীদের গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। এ দিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। কিন্তু সকল ভয় জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসেন। বাংলার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করতে মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। মাটিতে লুটিয়ে পড়েনÑ আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। তবে কাজ হয় না কোন। বাঙালীর ভাষার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে অমর একুশে। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করে ভাষা শহীদদের। এবারও দেশজুড়েই ছিল নানা আনুষ্ঠানিকতা। একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার আরও যোগ দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। দুই মন্ত্রী ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন মমতা। ততক্ষণে শহীদ মিনারের চারপাশে ঢল নেমে যায় সাধারণ মানুষের। ১২টা বাজার অনেক আগে থেকেই আসতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুষ্পস্তবক হাতে সারবিদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় শহীদ মিনার। গভীর রাতে নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরা নগ্ন পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে বেদির দিকে। এ সময় মাইকে উচ্চারিত হচ্ছিল শোকসঙ্গীতÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...। সারারাত ধরে চলে শ্রদ্ধা নিবেদনের এ আনুষ্ঠানিকতা। ভোরের আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলে একই এলাকা নতুন চেহারা পায়। দৃশ্যমান হয় প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়া বিভিন্ন বয়সী মানুষের স্রোত। বেলা যত বাড়ে, ফুল দিতে আসা মানুষের সারি তত দীর্ঘ হয়। শাহবাগ, জগন্নাথ হল, পলাশী মোড়, নীলক্ষেত ও ইডেন কলেজের দিক থেকে স্রোতের মতো আসতে থাকে মানুষ। বেলা দুইটার পর এ পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শহীদ মিনার। শ্রদ্ধার ফুল দিয়ে চমৎকার সাজানো হয় গোটা এলাকা। সারাদিন এখানে ভিড় লেগেছিল। এবারও শহীদ মিনারের জনস্রোত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা শহরে। শাহবাগ, টিএসসি, পলাশী, দোয়েল চত্বর এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের পোশাকে ছিল শোকের কালো রং। সাদা কালো শাড়ি পরে বের হয়েছিলেন নারীরা। পুরুষের পাঞ্জাবিতেও ছিল সাদা কালো রঙের বিস্তার। কেউ কেউ অবশ্য মেখে এসেছিলেন জাতীয় পতাকার লাল সবুজ। শহীদ মিনার থেকে অধিকাংশ মানুষ সরাসরি চলে যান অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। এ দিন সকাল ৮টায় খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশ পথ। দেখতে দেখতে ভরে ওঠে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। প্রতিটি স্টলে ভিড় লেগেছিল। সকলেই বই দেখেছেন, বই কিনেছেন। বাইরে ফুটপাতে বসেছিল হাজারও পণ্যের পসরা। বারোয়ারি মেলার মতো আয়োজন ছিল ফুটপাতে। শাহবাগ, চারুকলা, টিএসটি, দোয়েল চত্বর ও শহীদ মিনার এলাকা মাতৃভাষার গৌরবে নতুন করে জেগে ওঠেছিল যেন। রাত পর্যন্ত ছিল অভিন্ন উদ্যাপন। এবার এমন এক সময়ে দিবসটি পালিত হয় যখন একুশের চেতনায় এগিয়ে চলা বাংলাদেশকে খামচে ধরার অপচেষ্টায় লিপ্ত সেই পুরনো শকুন। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় যখন একে একে কার্যকর হতে চলেছে, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিম-ল অস্থির অশান্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত চিহ্নিত গোষ্ঠী। প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। রাজনীতির নামে চলছে নিরীহ নির্দোষ মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার পৈশাচিক খেলা। এ অবস্থায় সকল অন্যায় অশুভ অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান ছিল সর্বত্র। সমাজের সকল অন্যায় অসাম্য ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার শপথ নেয় বাঙালী। দিবসটি পালন উপলক্ষে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ছিল নানা উৎসব আনুষ্ঠান। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এ দিন সকালে বাংলা একাডেমিতে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করা হয়। সভাপতিত্ব করেন কবি অসীম সাহা। বিকেলে ছিল অমর একুশের বক্তৃতা। এতে ‘ভদ্রলোক-রাজনীতি ও শ্রেণীচেতনার আলোকে ভাষা-আন্দোলন’ শীর্ষক একুশে বক্তৃতা প্রদান করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিকেলে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। এখানে বিভিন্ন পরিবেশনায় অংশ নেন ঢাকার বিদেশী দূতাবাসের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। আয়োজনের শুরুতেই অনুষ্ঠানের অতিথিসহ ঢাকার দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ও শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন জাতীয়সঙ্গীত। এরপর সবাই মিলে গানÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলতে পারি। একুশের তাৎপর্য তুলে ধরে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, প্রতিবছরই আমরা এ দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করি। কিন্তু তারপরই যেন ভুলে যাই সবকিছু। মাতৃভাষার মর্যাদাটাকে সঠিকভাবে ধারণ করা হয় না। নতুন প্রজন্মের অনেকের বাংলা ভাষাটা ঠিকমতো রপ্ত না করলেও হিন্দি ভাষার প্রতি তাদের বিশেষ প্রীতি দেখা যায়। জীবনের তাগিদেই নিজের ভাষার সঙ্গে দু’একটি বিদেশী ভাষা শিখতে হয়। তবে সেটা মাতৃভাষাকে অস্বীকার করে নয়। মন্ত্রী বলেন, একুশের প্রত্যয় হোক অহিংস ও অপরাজনীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ। ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার শপথে শাণিত হই সকলে। অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা। ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত ভিনসেন্ট ভিভেঙ্কোও কবিতা পাঠ করেন।
×