ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাক্সিক্ষত দিন আজ উৎসবের রঙে-

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কাক্সিক্ষত দিন আজ উৎসবের রঙে-

মোরসালিন মিজান ॥ আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...। ভাই হারানোর ব্যথা ভুলবার নয় কোনদিন। সেই সঙ্গে মহত্ত্বম অর্জনের সুখ এসে বুকে যেন দোলা দিয়ে যাচ্ছিল। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ, খোলা হাওয়া স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল- মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর একুশের প্রথম প্রহর। মেলায় আগতদের মাঝে চলছিল শহীদ মিনারে যাওয়ার প্রস্তুতিও। বাংলা একাডেমি আয়োজিত মেলার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের যে পরম্পরা, বিশেষভাবে তা উচ্চারিত হচ্ছিল। সব মিলিয়ে ২০তম দিনেই মেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল অমর একুশের আবহ। শুক্রবার হওয়ায় এ দিন ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে কাক্সিক্ষত দিনটি আজ শনিবার। লেখক প্রকাশক পাঠক সকলেই এ দিনের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। সেভাবেই নেয়া হয়েছে প্রস্তুতি। অমর একুশে উপলক্ষে আজ শনিবার মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হবে সকাল ৮টায়। শহীদ মিনারে ফুল দেয়া শেষে স্রোতের মতো মেলায় প্রবেশ করবে মানুষ। ২৮ দিনের আয়োজন হলেও, আজ সব দিক থেকেই পূর্ণতা পাবে মেলা। এ প্রসঙ্গে মেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলা একাডেমির মেলার সঙ্গে ‘অমর একুশে’ শব্দটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত। একাডেমির এটি অত্যন্ত সচেতন প্রয়াস। এ প্রয়াসের কারণেই আর সব মেলা থেকে ফেব্রুয়ারির মেলা ভিন্ন। আয়োজনটি বাঙালীর প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিবারের মতো আজও এখানে বাঙালীর মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, সেভাবেই সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। মেলা চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২৬৪ নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র এবং সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার মেলার ২০তম দিনে নতুন ২৬৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ প্রকাশ করেছে জাতীয় সংহতি প্রকাশন। মৌলি আজাদের ‘রূপালী জোছনায় ভেজা জীবন’, প্রশান্ত লাহিড়ীর ‘পৃথিবীর এক ঝলক’, আবিদ আনোয়ারের ‘কাব্যসংসার’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘একদা, এক যুদ্ধে’, শহীদুল আলমের ‘মমতায় রাখি বুকের গভীরে’ মেলায় এনেছে আগামী। অমলেন্দু কুমার দাশের ‘মরমী কবি রাধারমণের গান ও জীবন’, অসিত কুমার ম-লের ‘ছড়ায় সুরে ছন্দপুরে (ছোটদের গান ও স্বরলিপি)’, ভবেশ রায়ের ‘অনন্তহীন মহাকাশের অপার রহস্য’ এনেছে অনুপম প্রকাশনী। মাহবুব তালুকদারের ‘আমি কখনো সত্য কথা বলি’, ময়ুখ চৌধুরীর ‘উনিশ শতকের নবচেতনা ও বাংলা কাব্যের গতিপ্রকৃতি’, আনোয়ার আজাদের ‘মেঘবিলাস’ এনেছে এ্যাডর্ন। শেখ শাহাদাৎ হোসেনের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাল্যবন্ধুর লেখাÑজীবনীগ্রন্থ : বিপ্লবী নেতা শেখ মুজিব’, আশির আহমেদের ‘জাপান কাহিনী’ এসেছে ঐতিহ্য থেকে। মাযহার সরকারের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী নিঃসঙ্গতা’ এনেছে দিব্যপ্রকাশ। ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের ‘অশ্রু, ওষ্ঠ ও তলোয়ার’, মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা স্মৃতি ১৫ ও ১৬’ এনেছে মাওলা ব্রাদার্স। উম্মে মুসলিমার ‘তুচ্ছ প্রেম গুচ্ছ প্রতারণা’, মোবারক হোসেন খানের ‘সেরা স্বরলিপি’, হাসান আজিজুল হকের ‘এপার বাংলা ওপার বাংলার শ্রেষ্ঠ গল্প’, লাবন্য লিপির ‘সাজঘরের সাতকাহন’, আহমেদ মাওলার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের সাহিত্য’ এনেছে মুক্তধারা। শাহনেয়াজ বিপ্লবের ‘উপনিবেশ’, অধরা জ্যোতির ‘একুশ আমার রক্তকরবী’ ও ‘হƒদয়ে সবুজ আলো’, ইফতেখার আহমেদ টিপুর ‘সময়ের দর্পণ’ এনেছে ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ। হিমাংশু করের ‘ট্রাইম ট্রাভেল’ ও ‘স্প্রিং থিওরি’, মামুন রশিদের ‘ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদের কথা’, ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাসের ‘অন্যরকম অভিযান’ এনেছে তাম্রলিপি। জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘চন্দ্রালোকে ছায়াহীন’, পূরবী বসুর ‘সভ্যতা নির্মাণে নারী’, একুয়া রেজিয়ার ‘এই শহরে মেঘেরা একা’, ফারহানা হকের ‘অতঃপর হিরণ¥য়তা’, মোশতাক আহমেদের ‘নীল জোছনার জীবন’ ও ‘প্রজেক্ট হাইপার’, নাসরীন জাহানের ‘তিনটি মঞ্চনাটক’ এনেছে অন্যপ্রকাশ। আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘আরেক ভুবন : সোভিয়েত ইউনিয়ন’, মিতালী মুখার্জীর ‘মন মিছিল শব্দ পথ’, করুণা রাণী সাহার ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যে জীবন ও সমকাল’ এনেছে বিভাস। স্বপন কুমার দাসের ‘রবীন্দ্রনাথের বিয়ে রবীন্দ্রের সংসার’ এনেছে নিখিল প্রকাশন। শিশুপ্রহর ॥ শুক্রবার যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়েছে শিশুপ্রহর। এ উপলক্ষে সকাল ১০টা থেকেই ক্ষুদে পাঠকদের উপস্থিতিতে সরব হয়ে উঠেছিল বাংলা একাডেমি চত্বর। নজরুল মঞ্চ ঘিরে থাকা শিশুতোষ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল ঘুরে বই কিনতে দেখা গেছে শিশু-কিশোরদের। এ দিন সকাল ১০টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচারকার্য পরিচালনা করেন আশরাফুল আলম, ডালিয়া আহমেদ ও মাহিদুল ইসলাম। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘ভাষা সংগ্রামী আবদুল মতিন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর এবং মোহাম্মদ আলী। সভাপতিত্ব করেন লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। প্রাবন্ধিক বলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ দিয়ে আবদুল মতিনের রাজনীতির শুরু হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পর পরবর্তীকালে তিনি বামপন্থী রাজনীতির ধারায় এগিয়ে গিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনে যোগদানসহ তাঁর সমগ্র রাজনীতি ভাবনার কেন্দ্রে ছিল মানুষের অধিষ্ঠান। তিনি বলেন, আবদুল মতিন রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন সামগ্রিক অর্থে দেশের মানুষের কল্যাণের আকাক্সক্ষা থেকে। আমরা আবদুল মতিনের মতো মানুষদের জীবন সংগ্রামের কাছ থেকে এই জনরাজনীতির শিক্ষাই পেতে পারি। তা না হলে এত বছর পর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চার কোন অর্থ থাকতে পারে না। আলোচকরা বলেন, ভাষা আন্দোলনে আবদুল মতিনের অংশগ্রহণ এতটাই বীরত্বব্যঞ্জক ছিল যে, তিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে জনসাধারণ্যে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের তাৎপর্য শুধু মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ ছিল না বরং একই সঙ্গে মাতৃভূমির বৃহৎ মানুষের মুক্তির জন্য তিনি সাম্যবাদী রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, বাংলা একাডেমি ভাষা মতিনের জীবদ্দশায় তাঁর জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করে একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন ছিলেন ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের প্রকৃত প্রতিকৃতি। ভাষা আন্দোলন আর ভাষামতিন যেন সমার্থক নাম। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলে এবং একটি শোষণহীন-মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদিত হবে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেনÑ আবৃত্তিশিল্পী লায়লা আফরোজ, এস এম মাহিদুল ইসলাম, মোঃ বেলায়েত হোসেন এবং মাসকুরে সাত্তার কল্লোল। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল, কল্যাণী ঘোষ, মাহমুদ সেলিম এবং স্বপ্না রায়।
×