ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

কৃষিঋণের মামলা ‘পিডিআর এ্যাক্ট’ করা জরুরী

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কৃষিঋণের মামলা ‘পিডিআর এ্যাক্ট’ করা জরুরী

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদটা এমনি এমনি নয়। তিনি একটা কাজের কাজ করেছেন। কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের দুর্দিনে। সারাদেশে বিশদলীয় অবরোধ ও হরতালের নামে তাণ্ডব চলছে। জ্বলছে দেশ, জ্বলছে কৃষি ও কৃষক। বাকিদের কথা বললাম না। উপস্থিত ক্ষেত্রে কৃষকদের কথা। তাদের বিরুদ্ধে ‘সার্টিফিকেট’ মামলা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, কৃষকদের বিরুদ্ধে ‘সার্টিফিকেট’ মামলা করা যাবে না। তাদের ঋণ পুনর্তফসিল (রিশিডিউলিং) করে দিতে হবে। এ কথা হয়ত অনেকেই জানেন কৃষকদের বিরুদ্ধে ঋণের টাকা আদায়ের জন্য খেলাপী ক্ষেত্রে ‘পিডিআর এ্যাক্ট’ (পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি এ্যাক্ট) মামলা করা হয়। এই ক্ষেত্রে ঋণ দেয়ার তিন বছরের মধ্যে ঋণটি আদায় না হলে অথবা ঋণ হিসাবে সর্বশেষ লেনদেনের তিন বছরের মধ্যে ঋণটি আদায় না হলে মামলা করতে হয়। এর নাম সার্টিফিকেট মামলা। না করলে ঋণটি ‘তামাদি’ হয়ে যায়। অর্থাৎ ঋণের টাকা আর আদায়যোগ্য থাকে না, আদালতের শরণাপন্ন ব্যাংক হতে পারে না। কৃষিঋণ বাদে বাকি ঋণের টাকা আদায়ে মামলা করতে হয় অর্থঋণ আদালতে। সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আইন। বড়ই জটিল এবং ত্রুটিপূর্ণ, যার কারণে ঐ আইনে টাকা আদায় হওয়ার উদাহরণ বিরল। কিন্তু সার্টিফিকেট মামলা বড় সহজ। কৃষক টাকা দিতে পারে না। লাখে বিশজন, ত্রিশজন, পঞ্চাশজনের নামে মামলা হয়। তারপর পুলিশ ছোটে কৃষকের পেছনে। কৃষক হয়ত জানেও না, এমনকি ঋণের কথা না জেনেও মামলাগ্রস্ত হতে পারে কৃষক। হয়ত তার নামে ঋণ নিয়েছে গ্রামের একজন মাতব্বর। যেই পুলিশ জানল সে ছুটল কৃষকের পেছনে। কোমরে দিল দড়ি। কৃষক, যাদের কোমরে পুলিশ দড়ি বাঁধে সে খুবই দুর্বল একজন ব্যাংক গ্রাহক। অসহায়, কেউ নেই তার স্বার্থ দেখার। কোমরে দড়ি অবস্থায় কত কৃষকের ছবি কাগজে ছাপা হয় প্রতিবছর। কারও টনক নড়ে না, ব্যাংকের না, সরকারের না। এবার মনে হয় সরকারের কানে জল ঢুকেছে। ঢুকেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কানেও। ঢুকেছে ভাল হয়েছে। কৃষক এবার ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত। ২০১৩ সালের শেষের দিকে সে হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত আরেকবার। তখন ছিল নির্বাচনের দাবি তত্ত্ব¡াবধায়কের অধীনে। এবারও একই দাবি। দাবি পুনর্নির্বাচনের। সেই বিশদলীয় দাবি। রেহাই নেই কৃষকের। এখন সবজির মৌসুম, মাছের মৌসুম, দুধের মৌসুম। দুটো পয়সা কৃষকের ঘরে ওঠার কথা ছিল। না, তা হবার নয়। জমিতে আলু, পটোল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, বেগুন, টমেটো, লাউ ইত্যাদি সবজি পচছে। গ্রামে পাইকার নেই, ক্রেতা নেই। পরিবহনের ব্যবস্থা নেই। শহর থেকে গ্রামে ‘ক্যাশ’ যাচ্ছে না। দুধ মাটিতে ঢেলে নষ্ট করা হচ্ছে, মাছ বড় হচ্ছে। পুকুরভর্তি মাছ। তোলার ব্যবস্থা নেই। গ্রাহক নেই। এমতাবস্থায় কৃষক পড়েছে বিপাকে। মহাজনের টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বেরসিক ব্যাংক এরই মধ্যে করছে ‘সার্টিফিকেট’ মামলা টাকা আদায়ের জন্য। দৃশ্যত ব্যাংকাররা ‘মানুষের’ মতো ব্যবহার করছেন না। কিন্তু কথা আছে। তারও হাতে কোন বিকল্প নেই। সময়মতো মামলা না করলে দাবি ‘তামাদি’ (ল অব লিমিটেশন এ্যাক্টের অধীনে) হয়ে যাবে। চাকরি যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে এ কারণে ২০১৪ সালের নবেম্বরের মধ্যেই দুই লাখের ওপরে মামলা হয়েছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের মামলা। পরিমাণ কত? মাত্র ৫৭০ কোটি টাকা। দশ হাজারের ওপর সংখ্যক কৃষকের বিরুদ্ধে ‘ওয়ারেন্ট’ ইস্যু হয়েছে। ভাবা যায় হাজার হাজার কৃষকের কাছে পাওনা মাত্র ৫৭০ কোটি টাকা, যার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কত ৫০০ কোটি টাকা ব্যাংকগুলো বছর বছর মাফ করে দিচ্ছে। কত শত শত কোটি টাকার ঋণ ব্যাংক পুনর্তফসিল করে দিচ্ছে। এবার ৫০০ কোটি টাকার অধিক ঋণ হবে ‘পুনর্গঠনের’ অধীনে পুনর্তফসিল। এ সবের মধ্যেই কৃষকের কোমরে দড়ি। এমতাবস্থায় যথাসময়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কৃষিঋণ পুনর্তফসিল করতে। সম্ভবত পুনর্তফসিলের ঘটনা এই প্রথম। সম্ভবত এসব ঋণ শস্যঋণ। শস্যঋণ পুনর্তফসিল আগে হয়নি। এতে ডাউনপেমেন্ট লাগবে কিনা, জানি না। আমার মতে, এসবের বালাই থাকা উচিত নয়। নিতান্ত ঋণ-শৃঙ্খলার প্রশ্ন, নতুবা আমি বলতাম কৃষিঋণের টাকা সব মওকুফ করে দিতে। যে কৃষকরা ৪০-৪২ বছরে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিনগুণ, যে কৃষকের ছেলেরা বিদেশে অর্জন করে সরকারীভাবেই দেড় লক্ষাধিক টাকা ডলার হিসেবে পাঠায়, তাদের ৫০০-৭০০ কোটি টাকা মাফ করে দেয়াই উচিত। সরকার তার বাজেট থেকে এই টাকা দিয়ে দিতে পারে। সরকার তা বিবেচনা করে দেখতে পারে। ইত্যবসরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটা পরামর্শ দেব। সদাশয় গবর্নর এটা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। প্রতিবছর কৃষকের কোমরে দড়ি দেখতে আর ভাল লাগে না। এটা বড়ই লজ্জার বিষয়ও বটে। ‘পিডিআর এ্যাক্ট’ বদল করা যায় কিনা ভেবে দেখা দরকার। বিদ্যুতের বিল না দিলে, গ্যাসের টাকা না দিলে, সরকারের পাওনা টাকা না দিলে পিডিআর এ্যাক্ট প্রযোজ্য হয়। তা হোক। কৃষিঋণ একটা ভিন্ন জিনিস। এখানে লাখ লাখ কৃষক জড়িত। এটা ঋণ। বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে তারা টাকা পরিশোধ করতে পারে না। এখন চলছে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ। যার কারণে তারা টাকা ফেরত দিতে পারবে না। ঋণের টাকা আদায়ে ‘পিডিআর এ্যাক্ট’ কতটুকু যথাযথ তা বিবেচনা করে দেখা দরকার। এই উদ্যোগটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিতে পারে। এই প্রসঙ্গেই আরেকটা কথা বলা দরকার। এ কথা সবারই জানা, ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আদালতে মামলার কারণে আটকা পড়ে আছে। অর্থঋণ আদালতের ধারাগুলো বড়ই জটিল। মামলায় জিতে সম্পত্তি নিলামে তুলে দরদাতা পায় না। ‘সিকিউরিটির’ মূল্য আছে। কিন্তু তা বিক্রির কোন ব্যবস্থা করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে সিকিউরিটির কোন বাজার মূল্যই নেই এ কথাও সত্য। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করে ব্যাংকের টাকা আদায় করাও শক্ত। এদিকে আবার বড় বড় গ্রাহক উচ্চতর আদালতে রিট করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রাখে। রিট শোনার জন্য বিশেষ বেঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। আবার দেখা যায়, বিচারকের অভাবে ‘রিট’ শোনা হয় না। এক কথায় আইনী জটিলতায় ব্যাংকের পাওনা টাকা উদ্ধারের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। অর্থঋণ আদালত ও আইন ঘটনাক্রমে ঋণগ্রহীতার পক্ষে। এটা স্পষ্ট। ব্যাংক টাকা দিয়েছে ঋণ হিসেবে। এর প্রমাণের কোন অভাব নেই। শত শত কাগজপত্র আছে। ডকুমেন্ট অফুরন্ত। ব্যাংক কর্তৃক যে হারে সুদ চার্জ করা হয় তার কার্যকারিতা বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা নেই। তারপরও ব্যাংক মামলা করে টাকা আদায় করতে পারছে না। একদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে সম্পত্তি বিক্রিতে জটিলতা- প্রথমে রায়প্রাপ্তি, তারপর তার এক্সিকিউশন। এই প্রসঙ্গে বলতে হয়, সম্পত্তি জামানতের নীতিগত কথা। ‘কোলেটারেল’ ছাড়া অর্থাৎ সহকারী জামানত ছাড়া ঋণ দেয়া যায় না। অথচ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অভিজ্ঞতায় বলে ‘কোলেটারেলের’ সঙ্গে ঋণের অনাদায়ী টাকা আদায়ের কোন সম্পর্ক নেই। জামানতভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা একটা সান্ত¡নায় পরিণত হয়েছে। এতে ব্যাংকের কোন লাভ হচ্ছে না। আবার মামলা একটা ‘সিভিল’ মামলা। ব্যাংকের টাকা আদায়ের জন্য ক্রিমিনাল প্রসিডিংস করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। সর্বোপরি দরকার জামানতভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা। কাস্টমার হওয়া উচিত প্রথম বিবেচনা। কাস্টমার ভাল কিনা, তার ব্যবসা ভাল কিনা, তিনি ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়ার মানসিকতা রাখেন কিনা এসব বিবেচনায় নেয়া দরকার। কোলেটারেল- জামানতবিহীন ঋণ ব্যবস্থার বদলে প্রাইমারী সিকিউরিটি বিবেচনায় ধরে ঋণ দেয়া যায়। তবে টাকা আদায় প্রক্রিয়াটি হবে ক্রিমিনাল প্রসিডিংসের অধীনে, সিভিল মামলা নয়। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
×