ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

যারা দেশের জন্য হুমকি তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে কী ভাবে?

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

যারা দেশের জন্য হুমকি তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে কী ভাবে?

(১৮ ফেব্রুয়ারির পর) আসলে মূল রাজনীতি হচ্ছে সেই পাকিস্তানীদের মতো, মানুষ নয়, জমি চাই। সাধারণ মানুষকে খালেদারা মনে করেন সারমেয় শাবক। এখন সাধারণের সময় হয়েছে এই ধরনের রাজনীতির ধারক-বাহকদের ঐ নামে সম্বোধন করা। তারা মানুষ চায় না- তারা জমি চায়। ভায়োলেন্সে সাময়িক লাভ করা যায় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কোন লাভ হয় না। জামায়াত ১৯৭১ এবং ১৯৭৫-এর পর বিএনপি-জামায়াত ভায়োলেন্সের সাহায্যে যে লাভ করেছে এখন তা কমতে কমতে ক্ষতির কাছাকাছি যাবে। বিএনপি-জামায়াত নেতাদের অনেকে বিদেশে এবং অনেকে কারাগারে গিয়ে সরকারকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। এ কারণে যে, অন্তিমে ব্যর্থতার দায় যেন তাদের ঘাড়ে না পড়ে বা জনরোষের সম্মুখীন না হতে হয়। খালেদা জিয়ার কার্যালয়েও কাঁটাতার বসানো হয়েছে যেন জনরোষ আটকানো যায়। খোকা, সাদেক, মওদুদ, এমকে আনোয়ার- বিএনপির এসব নেতা কোথায়? তাদের শিষ্যরা কি বিষয়গুলো ভেবে দেখেছেন? সরকার যদি আলোচনায় বসে তাহলে প্রমাণিত হবে সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে যা খুশি তা করা যায়। এবং এ দেশটিতে পরবর্তীকালে আইনের শাসন নয়, সন্ত্রাসী শাসন কার্যকর হবে। কোন দায়িত্ববান সরকারের পক্ষে কি তা করা সম্ভব? রাজনৈতিক টোকাই ও ফন্দিবাজ তার্কিক বা বুদ্ধিজীবী বা সুশীল বাটপাড়রা যদি বলত, দায় স্বীকার করে মানুষ পোড়ানোর বোম্বেটে রাজনীতি বন্ধ করা হোক, তারপর দেখা যাবে সংলাপ হয় কি না হয়? তাও কিন্তু তারা বলছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের যে পক্ষে নেই তা বোঝাই যাচ্ছে। অবরোধ-হরতালও যে সাধারণ মানুষ গুরুত্ব দিচ্ছে না, তাও অনুধাবন করা যাচ্ছে। সংবাদ থেকেও তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া স্থান হারাচ্ছেন। মিডিয়া শত চেষ্টা করেও তাদের আপোসহীন নেতানেত্রী বানাতে পারছে না। যেমন, ১৫ জন জাঁদরেল সম্পাদক পারেনি মাহমুদুর রহমানকে হিরো সম্পাদকে পরিণত করতে। আর এই ১৩ জনের মুরোদ কত? ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আলোচনাসভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দুটি তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, সম্প্রতি তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন এবং তার অপরপক্ষ ব্রিটিশ মন্ত্রীকে বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেন সহায়তা করেছিল। বাংলাদেশ তা মনে রেখেছে এবং বাঙালী তার জন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন যদি বাঙালীর বিরুদ্ধে লন্ডনে বসে কেউ [অর্থাৎ তারেক] ষড়যন্ত্র করে তাহলে বাঙালী তা মেনে নেবে না এবং ১৯৭১ সালে ব্রিটেন যে সমর্থন করেছিল তাও ব্যর্থ হবে। ব্রিটিশ পক্ষ বলেছেন, তারা বিষয়টি বুঝেছেন। যে কারণে, দেখুন হঠাৎ মিডিয়ার ব্লু আইড বয় তারেক রহমানের কোন বাণী আমাদের শুনতে হচ্ছে না। অন্তর্জালে একটি দলিল দেখা যাচ্ছে যেখানে তারেক যে রাজনীতি করবেন না বলে মুচলেকা দিয়েছেন তার উল্লেখ আছে। বিএনপির পদ থেকে যে তিনি পদত্যাগ করেছেন তারও উল্লেখ আছে। সে ক্ষেত্রে তারেক রাজনীতি করতে পারেন কিনা সেই আইনগত প্রশ্নও ওঠানো যেতে পারে। ব্রিটিশ পক্ষকে আইনমন্ত্রী আরও বলেছেন, ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধীরা কি করেছে তা বুঝতে হবে। মৃত্যুদ-ও তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। এবং এ বিষয়টি নন-নেগোশিয়েবল। অর্থাৎ এ বিষয়ে কোন আলোচনা হবে না, ব্রিটিশ পক্ষ জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। সরকারের স্ট্র্যাটেজি নিয়েও বোধহয় দ্বন্দ্ব আছে। প্রধানমন্ত্রী এবং আরও কয়েকজন যেখানে বলছেন সংলাপ হবে না, সেখানে কোন কোন আওয়ামী নেতা বলছেন, অবরোধ ত্যাগ করলে হয়ত সংলাপ হতে পারে। আওয়ামী লীগে হেজাবিপন্থীও অনেক আছে। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলছেন, আওয়ামী লীগের দু’একজন মন্ত্রী ছাড়া কেউ জোরালোভাবে তা বলেননি। তাতে আমরা অবাক নই। মন্ত্রিসভায় পুরুষ একজনই আছেন তিনি হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। নির্মূল কমিটির সভায় আনিসুল হক যা বলেছেন, সরকার ও সরকারদলীয়দের ঐ একটি বাক্যই উচ্চারণ করা উচিত, তাহলো সংলাপ হবে। সেটি হলো খালেদা জিয়ার কাছ থেকে জানতে হবে ‘তিনি কবে পাকিস্তান যাবেন?’ রাজনৈতিকভাবে ১৪ দল যতটা সক্রিয় হওয়ার দরকার ছিল ততটা হয়নি কারণ সাংগঠনিক দুর্বলতা; যেটি কোন আওয়ামী লীগ নেতাই স্বীকার করতে প্রস্তুত নন। প্রধানমন্ত্রী যে বলেছিলেন, সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে প্রতিরোধ করতে- কেউ কি সেই নির্দেশ শুনেছেন? বা মোঃ নাসিম যে বলেছিলেন, প্রতিরোধ কমিটি করতে- কোন নেতাকর্মী কি তা শুনেছেন? পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এখন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুই ফ্রন্টেই যুদ্ধ করতে হবে। শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফল হবে না। আমরা যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মনে করি তাদেরও নিজ নিজ অবস্থান থেকে রাজনৈতিক প্রতিরোধ করতে হবে। সরকার কি করল না করল তা নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা উচিত নয়। কারণ, ১৯৪৮ থেকে যদি নাও ধরি, ১৯৭০ সাল থেকে দুটি বিপরীতমুখী আদর্শের যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে তা এখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। হয় তারা থাকবে না হয় আমরা থাকব। সংলাপ এ দ্বন্দ্ব নিরসন করতে পারবে না। অবরোধ-হরতাল এমনিতেই অকার্যকর হয়ে যাবে। তবে, বোমাবাজি, টার্গেট কিলিং দীর্ঘদিন চলবে। যতদিন ঐ পক্ষ পাকিস্তানী মনোভাব ত্যাগ না করে বাঙালী হবে ততদিন চলবে। যদি তারা পরবাসী না হয়ে স্বদেশী হয় এবং ১৪ দল বিরোধী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তাহলে বিরোধের মীমাংসা হবে। এটি নির্বাচন নিয়ে লড়াই নয়, গণতন্ত্র নিয়েও লড়াই নয়; এ লড়াই বাংলাদেশ পাকিস্তান হবে কি হবে না, তার লড়াই। আমরা চাই, ১৪ দল বিরোধী বাংলাদেশী নাগরিকদের একটি মোর্চা হোক। তখন গণতন্ত্র নিয়ে লড়াই হবে। যারা জঙ্গী মৌলবাদের সমর্থক তাদের সঙ্গে আলোচনা করার অর্থ তাদের স্বীকৃতি দেয়া। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী স্মৃতি বক্তৃতায় যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন- “মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ মানুষের শত্রু। এই শত্রুর স্বরূপ বড় জটিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন অঞ্চলে মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ হলোকাস্ট তৈরি করে চলেছে, সাধারণ মানুষকে ভিকটিম করে চলেছে। তাঁর এই সাধারণ মানুষ কারা? যারা সামান্য রোজগেরে, ঘরসংসার করে সন্তানসন্ততির জন্য মৃত্যুর পূর্বে সামান্য বিত্ত রেখে যেতে চায়Ñ তাদেরকে বেঁচে থাকার ব্রত থেকে সরিয়ে এনে মৌলবাদের মধ্যে, জঙ্গীবাদের মধ্যে, পরস্পরের মধ্যে, হিন্দু ও মুসলমান, খ্রীস্টান ও ইহুদী ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের হাতে তলোয়ার তুলে দিয়েছে। মানুষকে এবস্যুলেট মুসলমান করা, এবস্যুলেট হিন্দু করা, এবস্যুলেট খ্রীস্টান করা, এবস্যুলেট বৌদ্ধ করা, এবস্যুলেট ইহুদী করা মৌলবাদের জঙ্গীবাদের লক্ষ্য। এর ফলে নষ্ট হয় মানবিকতা, মানুষের অধিকার, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করার কমনফ্রন্ট। মানুষ তখন লড়াই করে মানুষের বিরুদ্ধে। এই লড়াই পাপ। মানুষ সেক্যুলার না হলে মানুষ মানুষের ওপর টর্চার করে। এই টর্চার মানবাধিকারবিরোধী। জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদ মানুষকে খুন করতে শেখায়- এই শেখানো কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এটি মনে করে পাকিস্তানীরা বা তাদের জারজ বা মানসপুত্ররা যাদের রাজনীতির ফের শুরু ১৯৭৫ থেকে। আমরা নই। তাই আমাদের কর্তব্য তা প্রতিরোধ করা। আমরা যেন তা মনে রাখি। সবশেষে একটি কথা বলি, পাকিস্তানীরা ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালাবার সময় বলেছিল ‘আদমি নেহি মাঙতা, জমিন মাঙতা।’ আজ খালেদারাও একই ভাষায় হত্যা চালাবার সময় যেন বলতে চাচ্ছেন, ‘আদমি নেহি মাঙতা, কুরশি মাঙতা।’ (সমাপ্ত)
×