ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আ ব ম ফারুক

ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন সরকারকে অভিনন্দন

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন সরকারকে অভিনন্দন

বাংলাদেশে আমরা ১৯৮৭ সালে নবীনগর-নরসিংদী নৌরুটে প্রথম দুধে ফরমালিন শনাক্ত করি। তখন দুধের ব্যাপারীদের কাছে এটি ‘মেডিসিন’ নামে পরিচিত ছিল। তারা ভোরে গ্রামের ছোট বাজার থেকে দুধ সংগ্রহ করে দুপুরে বড় বাজারে জড়ো করে। সারাদিন জ্বাল না দিয়ে সন্ধ্যায় নরসিংদীর পাইকারি বাজারে এনে রাতে ঢাকার রথখোলা বাজারে পাঠাত পরদিন সকালে বিক্রির জন্য। এই প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময়ে ফরমালিন মেশানোর কারণে দুধ নষ্ট হতো না। কিন্তু দুধের স্বাভাবিক স্বাদ ও গন্ধ তো নষ্ট হতোই। ঝামেলামুক্ত থাকার কারণে ব্যাপারীরা খুশি থাকলেও ক্ষতি যা হওয়ার তা ভোক্তারই হতো। ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে দুধের ব্যাপারীরা ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার শুরু করে। ১৯৯৪ সালে বড় মাছে এবং ২০০৩ সালে আমরা ছোট মাছে ফরমালিন পাই। এরপর ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন ফলেও ফরমালিন পাওয়া যেতে থাকে। ফরমালিন রাসায়নিকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কিছু কেমিক্যাল কারখানা, ফটোগ্রাফিক স্টুডিও, ট্যানারি শিল্প, প্লাস্টিক কারখানা, ফরমিকা উৎপাদনসহ বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহৃত হয়। আনুমানিক হিসেবে যার পরিমাণ বছরে প্রায় ১০০ টন। মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গত বছর জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ফরমালিন আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৩৭৯ টন ১৩ কেজি। আগের বছরে তা ছিল ৫ হাজার ১২৭ টন ১৬ কেজি। অর্থাৎ সে বছর সরকার ফরমালিনের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমদানি কমে দাঁড়িয়েছিল প্রায় এক-চতুর্থাংশে। কী বিপুল পরিমাণ ফরমালিন অসাধু ব্যবসায়ীরা দুধ, মিষ্টি, মাছ, সবজি ও ফল যেমনÑ আম, জাম, কলা, পেঁপে, আনারস, আপেল, নাশপাতি, কমলা, আঙ্গুর ইত্যাদিতে মিশিয়েছে উপরিউক্ত হিসেবটি দেখলে শিউরে উঠতে হয়। বিভিন্ন দেশে পরিচালিত গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় যে, ফরমালিন খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলীর ক্ষতি করে, লিভারের এনজাইমগুলোকে নষ্ট করে এবং কিডনির কোষ নেফ্রনকে ধ্বংস করে। ফলে গ্যাস্ট্রিক, আলসার বাড়ে, লিভার ও কিডনির নানা রকম জটিল ও দুরারোগ্য রোগ দেখা দেয়। মহিলাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করলে মাসিক ঋতুস্রাবের সমস্যা হয়। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফরমালিন আরও ক্ষতিকর; অন্যান্য সমস্যা ছাড়াও এর কারণে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার ১৯৮৭ সালে জানিয়েছে যে, অত্যন্ত বিষাক্ত বলে ফরমালিন মানবদেহের বিভিন্ন অংশের ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির ১৯৯৪ সালের সাবধানতা অনুযায়ী ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট অব ক্যালিফোর্নিয়া ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালে বলেছে, ফরমালিন কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বলে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রেস বিজ্ঞপ্তি নং ১৫৩ থেকে জানা যায়, গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিন দায়ী। ২০০৫ সালের ১০ ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পোস্ট পত্রিকা থেকে ফরমালিনযুক্ত মাছ খেয়ে কয়েকজনের মৃত্যুর ফলে সেখানে মাছ ও শুঁটকি ব্যবসায়ে ব্যাপক মন্দার কথা জানা যায়। এ রকম অনেক সূত্র থেকে ফরমালিনের ক্ষতির কথা জানা যায়। যেমন : এটি মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার, মনোগ্রাফস অন দি ইভ্যালুয়েশন অব কার্সিনোজেনিক রিস্কস টু হিউম্যানস, ভলিউম ৮৮, ২০০৮)। এর কারণে মানুষের মধ্যে লিউকেমিয়া ও ব্রেন ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশি লক্ষ্য করা গেছে (জার্নাল অব ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, ২০০৯, ১০১(২৪), ১৬৯৬-১৭০৮)। এটি একটি জ্ঞাত কার্সিনোজেন (ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম, ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস, ১২তম রিপোর্ট অন কার্সিনোজেন, জুন ২০১১)। মুখে খাওয়ার পর গলা ও পাকস্থলীর জ্বলুনি, পেটে ব্যথা, মাথাব্যথা, বমিভাব, বমি, ডায়রিয়া, রক্তক্ষরণ, পেটে তীব্র ব্যথা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, খিঁচুনি ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ঘটতে পারে। দীর্ঘদিন খেলে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, কাশি, ঝিমুনি, কিডনির ক্ষতি, ঘুমের অসুবিধা, খিটখিটে মেজাজ, মনোযোগে অনীহা এবং মনে রাখার ক্ষমতা কমে যাওয়া ঘটতে পারে (ফরমালডিহাইড হ্যাজার্ডস ইন ফুড, আই ওয়াই এম হেলথ, ১-৯-২০১২)। এ ধরনের তথ্যসূত্র আরও রয়েছে। ২০০৩ সাল থেকেই আমরা বাংলাদেশের জনগণ অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা ফরমালিনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু তখনকার সরকার এতে কর্ণপাত করেনি। ফলে জনস্বাস্থ্য ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকে। দেশের বিশেষজ্ঞবৃন্দ, ভ্রাম্যমাণ আদালত, ভোক্তা সমিতি এবং গণমাধ্যমসমূহ প্রবলভাবে সোচ্চার হওয়ার পর ২০১১ সালে সরকার ফরমালিনের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্তৃক বিদেশ থেকে ফরমালিন আমদানি কমতে থাকে। এরপর ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে অনেক পর্যালোচনার পর সরকার ফরমালিনের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি আইন জারির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এবং একে কিভাবে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে প্রস্তাবনা আহ্বান করে। আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলাম এবং ফরমালিনকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাবনাও সরকারের কাছে পেশ করেছিলাম। দেশে ফরমালিন উৎপাদনের কোন কারখানা নেই। ভারতেও নেই। ফলে ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে ফরমালিন আসার প্রশ্নও কখনও আসেনি। বাংলাদেশ বিদেশ থেকে সবটুকু ফরমালিন আমদানি করে। এ কারণে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ যদি আমদানি ও মজুদ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের প্রস্তাবনায় এ বিষয়গুলোই মূলত ছিল। কিন্তু সরকারকে ধন্যবাদ যে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জরুরী তাগিদে আমদানি ও মজুদ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি খুচরা বিক্রি, পরিবহন ও খাদ্যদ্রব্যে এর অপব্যবহারে কঠোর শাস্তি প্রদানের বিষয়টিও সংযুক্ত করে জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য আইনটির খসড়া ইন্টারনেটে প্রকাশ করে। ২০১৪ সালে মন্ত্রিপরিষদের সভা ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া অনুমোদন করেন। সবশেষে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ মহান জাতীয় সংসদ ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫’ পাস করে, যা পরদিন থেকে কার্যকর হয়। এ আইনে লাইসেন্স ছাড়া কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ফরমালিন আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রি ও ব্যবহার বা দখলে রাখতে পারবে না বলে বিধান করা হয়েছে। এতে লাইসেন্স, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, হিসাব বই, রেজিস্টার সংরক্ষণ, মাসিক প্রতিবেদন দাখিল, তদন্তকারী, তদন্তের পদ্ধতি, পরিদর্শন, ফরমালিন বিক্রির দোকান সাময়িক বন্ধ করাসহ সব বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান করা হয়েছে। এতে প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া সন্দেহজনক স্থানে তল্লাশি, তল্লাশির পদ্ধতি, সন্দেহজনকদের আটক, আটককৃত ব্যক্তি ও তাদের কাছ থেকে আটককৃত মাল বিষয়ে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কেউ লাইসেন্স ছাড়া ফরমালিন আমদানি, উৎপাদন বা মজুদ করলে তার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ- এবং/অথবা ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কেউ লাইসেন্সের কোন শর্ত মেনে না চললে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদ- এবং/অথবা ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়। অননুমোদিত বিক্রি, পরিবহন বা মজুদ, ফরমালিন উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি, স্থাপনা বা ঘর বা যানবাহন ব্যবহার, মিথ্যা অভিযোগ বা হয়রানিমূলক মামলা, পুনরায় অপরাধ করা, প্রয়োজনে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার স্থাপন, এর পরীক্ষক নিয়োগ ও প্রতিবেদন প্রদান, অপরাধের সুষ্ঠু বিচার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রয়োজনে অতিরিক্ত আইন প্রণয়ন করার ব্যবস্থাও এ আইনে রাখা হয়েছে। সবদিক বিচার করলে আইনটি বাংলাদেশে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অত্যন্ত চমৎকারভাবে প্রণীত। এখন প্রয়োজন এর কার্যকর প্রয়োগ। আশা করি, আইনটির প্রয়োগে ব্যবসায়ীরাও সহযোগিতা করবেন। কারণ, ফরমালিনের কারণে শুধু ভোক্তাদেরই স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হয়, তা নয়, মাছে-দুধে বা ফলে যে অসৎ ব্যবসায়ী ফরমালিন মেশায় তার জন্যও দুঃসংবাদ রয়েছে। ফরমালিন অত্যন্ত ঝাঁঝালো এবং মেশানোর সময় এর বাষ্প চোখের সংস্পর্শে এসে চোখের কর্নিয়ার ক্ষতি করে, কর্নিয়া তার স্বচ্ছতা হারিয়ে ঘোলা হয়ে যায়। পরিণামে ব্যবসায়ী চোখে ঝাপসা দেখে, ছানি তৈরি হয়। ফরমালিনের বাষ্প শ্বাস নেয়ার ফলে বমিভাব, মাথাব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট, হাঁপানি এবং ফুসফুস ও গলবিলে ক্যান্সার দেখা দেয়। তাছাড়া ফরমালিন পানিতে মিশিয়ে ব্যবহারের ফলে হাতের ত্বকে ঘা দেখা দেয়, দীর্ঘদিন ব্যবহারে সে ঘা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে, কোন ওষুধেই তা সারে না। আমরা সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি ফরমালিন নামের তীব্র বিষের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে চমৎকার এই আইনটি প্রণয়নের জন্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বিষয়ে ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে তাঁর কাছে আমরা দেশবাসী কৃতজ্ঞ। আমরা মনে করি, আমাদের খাবারে ফরমালিনের ব্যাপক অপব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং এর মাধ্যমে আমাদের দুধে-মিষ্টিতে-মাছে-ফলে-সবজিতে ফরমালিনের উৎপাত কমবে। এর ফলে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। শিক্ষা, খাদ্য ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে সরকার যখন সাফল্যের অবাক স্বাক্ষর রাখছে তখন খাদ্যের নিরাপত্তার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি সরকার কর্তৃক মেনে নেয়া আরেকটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। এখন জনগণ যত দ্রুত সম্ভব এর কার্যকর বাস্তবায়ন দেখতে চায়। জনগণ দেখতে চায় খাবারে ফরমালিন মেশানোর সঙ্গে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীরা নতুন জারিকৃত এ আইনে বর্ণিত ধারা অনুযায়ী জেল-জরিমানার সাজা পাচ্ছে, কোন অজুহাতেই এরা ছাড়া পাচ্ছে না এবং এভাবে একসময় দেখা যাবে বাংলাদেশের কোন খাদ্যেই আর ফরমালিন নামের বিষ মেশানো হচ্ছে না। লেখক : সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় B-‡gBj : [email protected]
×