ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেচাকেনা আড্ডায় সরব লিটলম্যাগ কর্নার, তারুণ্যের প্রাণকেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বেচাকেনা আড্ডায় সরব লিটলম্যাগ কর্নার, তারুণ্যের প্রাণকেন্দ্র

মনোয়ার হোসেন ॥ প্রতিবাদী সাহিত্যের চেতনার মশালটি সব সময়ই জ্বলে থাকে ছোট কাগজের শরীরে। এ কারণেই জনপ্রিয়তার ধার ধারে না লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজ। লেখকের বুদ্ধিবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রকাশই এই ধারার কাগজের মূল বৈশিষ্ট্য। সব মিলিয়ে ধারণ করে ভিন্নতা। তাই তো অমর একুশে গ্রন্থমেলার এক আঙিনা বাংলা একাডেমির বহেড়াতলায় দেখা মেলে ভিন্নরকম দৃশ্যপটের। বরাবরের মতো এবারও এই প্রাঙ্গণে ঠাঁই পেয়েছে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর। মেলা শুরুর দিকে এখানে তেমনভাবে পাঠকের আগমন ঘটেনি। তবে এখন বদলে গেছে সেই চিত্র। যৌবনপ্রাপ্ত বইমেলায় সারাক্ষণই যেন সরব থাকছে লিটলম্যাগ কর্নার। প্রচলিত সাহিত্যের বাইরে বিকল্প ধারার সাহিত্যের স্বাদ নিতে আসা পাঠকের আনাগোনায় সরব এই কর্নার। সেই সঙ্গে রয়েছে চত্বরটি ঘিরে তারুণ্যের জমজমাট আড্ডা। সব মিলিয়ে বলা যায়, লিটলম্যাগ কর্নারটি এখন পরিণত হয়েছে ছোট কাগজে বড় স্বপ্ন আঁকিয়েদের প্রাণকেন্দ্রে। সোমবার মেলার ষোড়শতম দিনে বিকেলে প্রাণবন্ত আমেজ পরিলক্ষিত হয় লিটলম্যাগ চত্বরে। ছোট ছোট স্টলে ছোট কাগজের পসরা সাজিয়ে বসেছেন লিটলম্যাগের প্রকাশক বা সম্পাদকরা। বইয়ের বিকিকিনির সঙ্গে চলছে তারুণ্যনির্ভর আড্ডা। আর অনেকটা খোলা আঙিনা পেয়ে পাঠকরাও ঘুরছেন এক স্টল থেকে অন্য স্টলে। খুঁজে ফিরছেন আপন মননের উপযোগী প্রকাশনাটি। তেমনই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোমেনুর রসূল। কথা প্রসঙ্গে জানালেন তিনি ছোট কাগজের নিয়মিত পাঠক। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ওপর রচিত একটি সংখ্যা ইতোমধ্যে কিনে ফেলেছেন। এছাড়াও সংগ্রহ করেছেন লিটলম্যাগ অনুপ্রাণনের একটি সংখ্যা। কী কারণে ছোট কাগজ পছন্দ করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, সাহিত্য সমালোচনা পড়তে আমি ভালবাসি। অথচ এখন সমালোচনার সেই পরিসরটি হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত। আর লিটলম্যাগে আমি সহজেই পেয়ে যাচ্ছি সেই সমালোচনামূলত সাহিত্য। এছাড়া গ্রাম, নিসর্গ কিংবা বিশিষ্টজনদের নিয়ে নানারকম সংখ্যার হদিস মেলে এ ধারার কাগজে। তার ওপর থাকে তরুণ লেখকদের রচনা। সেখান থেকে খুঁজে পাই নতুন ভাবনার খোরাক। কথা হয় লিটলম্যাগ খেয়ার সম্পাদক পুলক হাসানের সঙ্গে। কথায় কথায় জানালেন এবারের লিটলম্যাগ কর্নারের সার্বিক অবস্থা। বললেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতরেও ছোট কাগজের পাঠকের আনাগোনা একেবারে কম নয়। তাই বিকিকিনিও খুব একটা মন্দ নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে পুরোদমে জমে উঠত। কারণ তখন মফস্বলের পাঠকরা মেলায় হাজির হতে পারতেন। আর তাঁদের আগমনেই একই সঙ্গে জমজমাট ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এই কর্নার। লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি পাঠকের আগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, ছোট কাগজের মূল ভাবটিই হচ্ছে- এর ভেতরে কোন আপোসকামিতা নেই। এছাড়া এর অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা হচ্ছে তথাকথিত সমাজব্যবস্থা বা সো কলড্্ স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ। সে কারণেই এই ধারার লেখকরাও মতপ্রকাশের শতভাগ স্বাধীন রাখেন নিজেকে। এখানে কাউকে তোয়াক্কা করতে হয় না। লিটলম্যাগ চত্বরটির অঙ্গসজ্জায়ও রয়েছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। এ বছরের মেলায় ৫৪টির মতো ছোট কাগজকে নিয়ে সাজানো হয়েছে লিটলম্যাগ কর্নার। প্রতিটি স্টলের নামকরণের মধ্যেও রয়েছে সৌন্দর্যবোধের পরিচয়। মনছোঁয়া এমন কয়েকটি স্টলের নাম হলোÑ বনপাংশুল, চর্যাপদ, বেহুলা বাংলা, মেঘ, অনুভূতি, চারবাক, লোক, তৃতীয় চোখ, সুন্দরম, কালের ধ্বনি, রোদ্দুর, শালুক, কবি ও কবিতা, শব্দগুচ্ছ, অর্বাক, মত ও পথ, উলুখাগড়া, ময়মনসিংহ জং, ঊষালোকে, আগুনমুখা, কবিতাপত্র, কোরাস, দ্রষ্টব্য, অরণি, কবিতাসংক্রান্তি, শিরদাঁড়া, সুনৃত, কৃষাণ, সাম্প্রতিক, শুদ্ধস্বর, নিসর্গ, শাহবাগ, গান্ডীব, খেয়া, কালের ধ্বনি, ধমনি, অনুপ্রাণন ইত্যাদি। মেলার ষোড়শতম দিনের সার্বিক চিত্র ॥ আড়ষ্টতা কাটিয়ে একুশের বইমেলায় এখন বিরাজ করছে প্রাণবন্ত ভাব। সোমবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত মেলা ছিল ছিমছাম। তাই বেচাবিক্রিও হয়েছে অল্পস্বল্প। তবে সন্ধ্যার পর বদলে যায় দৃশ্যপট। বাড়তে থাকে পাঠক সমাগম। মেলার দুই ক্যানভাস বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে ওঠে সরগরম। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় বইয়ের বিকিকিনি। সেই সুবাদে প্রকাশকরা ফেলেছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। রোদেলার স্টল বাতিল ॥ মেলার নীতিমালা ভঙ্গ করে ধর্র্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে সোমবার বাতিল করা হয়েছে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল। বিকেলে রোদেলার স্টলটি বন্ধ করে দেয় মেলা পরিচালনা কমিটি। প্রকাশনা সংস্থাটি থেকে প্রকাশিত আবুল কাশেম ও সৈকত চৌধুরী অনূদিত ইরানী লেখক আলি দস্তি রচিত ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ বইটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে স্টল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৫ এর নীতিমালার ১৩(১৩) এবং ১৩(১৪) ধারা অনুযায়ী এ স্টল বন্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রোদেলার প্রকাশক রিয়াজ খান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি, বইটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। বইটি প্রকাশের পেছনে কারও অনুভূতিতে আঘাতের কোন উদ্দেশ আমার ছিল না। আমি ভুলবশত বইটি প্রকাশ করেছি। ব্যক্তিজীবনে আমি নিজেও একজন ধর্মানুরাগী মানুষ। অনাকাক্সিক্ষত এই ঘটনার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি বইটির সম্পূর্ণ প্রকাশনা বাতিল ঘোষণা করছি। তাই বইটির কোন মুদ্রণ বাজারে থাকবে না। সিসিমপুরের ই-বুক উদ্বোধন ॥ সোমবার বিকেলে একাডেমির নজরুল মঞ্চে সিমিমপুরের প্রথম ই-বুক ‘বর্গরাজা আর ত্রিভুজরানি’র মোড়ক উন্মোচন করা হয়। উন্মোচন করেন নন্দিত কথাশিল্পী মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সিসিমপুরের কান্ট্রি প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন ও আরটিভির প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আশিক রহমান। বইটির সঙ্গে একটি এ্যানড্রয়েড এ্যাপও খোলা হয়েছে, যার মাধ্যমে বইটি বিনামূল্যে সরাসরি ডাউনলোড করা যাবে। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার ১৬তম দিন সোমবার একাডেমির নজরুল মঞ্চে ১৫টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এরমধ্যে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান অ্যার্ডন পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত ফারিয়া প্রেমার ‘আরশি’, শেলী নাজের ‘পুুরুষ সমগ্র’, এবিএম হোসেনের ‘পড়ন্ত বেলার গল্প’, মোস্তা শরীফের ‘একচোখো দৈত্য’, আখতার উদ্দিন মানিকের ‘শাহজাদপুর কৃষক বিদ্রোহ ও ঠাকুর জমিদার’ এবং বিজয় প্রকাশ থেকে প্রকাশিত তারিক সজীবের ‘তুমি আমারই ছিলে’ বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করেন। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক উন্মোচন করেন ‘আমিনুল ইসলাম বাদশাহ স্মারকগ্রন্থের মোড়ক। এটি প্রকাশ করেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল উন্মোচন করেন ড. শামসুল আলমের ‘রাজনৈতিক ডামাডোলে স্বপ্ন যাত্রার অর্থনীতি’ বইটির মোড়ক। নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপ-বিভাগের তথ্যানুযায়ী সোমবার মেলায় নতুন বই এসেছে ৯৮টি। এরমধ্যে গল্পগ্রন্থ ১৭টি, উপন্যাস ১৭, প্রবন্ধ ৫, কাব্যগ্রন্থ ২৮, গবেষণা ১, ছড়া ৫, শিশুসাহিত্য ৫, নাটক ১, বিজ্ঞান ১, ইতিহাস ২, রম্য/ধাঁধা ১, সায়েন্স ফিকশন ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর বই এসেছে ১১টি। এছাড়া মেলায় ষোলোতম দিন পর্যন্ত নতুন বই এসেছে দুই হাজার ৯৮টি। উল্লেখযোগ্য বই ॥ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও কামাল লোহানী সম্পাদিত ‘ফয়েজ আহ্মদ স্মারকগ্রন্থ’ মেলায় এনেছে বাংলা একাডেমি, বেলাল চৌধুরীর ‘রোজনামা ঢাকা’ রূপসী বাংলা প্রকাশ, আহমদ রফিকের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এনেছে অনিন্দ্য প্রকাশ’, জাগৃতি প্রকাশনী এনেছে আহসান হাবীবের ‘গণতান্ত্রিক গন্ডার’, আসাদ চৌধুরীর ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’ এনেছে ফেয়ার পাবলিশিং হাউস, অঘোর ম-লের ‘এক্সট্রা টাইম’ এনেছে সময় প্রকাশন, শাকুর মজিদের ভ্রমণবাহিনী ‘অন্নপূর্ণায়’ এনেছে উৎস প্রকাশনী এবং একই লেখকের আরেকটি ভ্রমণগ্রন্থ ‘প্রাগের ঠাকুরোভা লবণপুরের মোজার্ট এনেছে অবসর প্রকাশনী। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ সোমবার বিকেলে মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আহমেদ রেজা। আলোচনায় অংশ নেনÑ কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক শাহীনুর রহমান, রাশিদ আশকারী ও মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী। প্রাবন্ধিক বলেন, আমাদের কবিতা, গদ্য ও অনুবাদ সাহিত্যে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ভূমিকা অসাধারণ। সৃষ্টিশীল সাহিত্যে যেমন তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি বাংলা একাডেমির ইংরেজী-বাংলা অভিধান সম্পাদনায় তাঁর কৃতিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ১৯৯০-৯১ মেয়াদকালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর মেধা, দক্ষতা ও দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এছাড়া পাকিস্তান আমলে রাজশাহী থেকে মুস্তফা নূরউল ইসলামের সঙ্গে যুগ্মভাবে পূর্বমেঘ পত্রিকা সম্পাদনা এবং এই পত্রিকার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানী শাসকচক্রের সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই পরিচালনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং সমাজ-রাজনীতি ও সংস্কৃতিবিষয়ক কলাম আমাদের মননচর্চায় যোগ করেছে নতুনতর মাত্রা। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, সত্য ও সুন্দরের সাধনা ছিল জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর জীবন চলার পাথেয়। তাঁর লেখকসত্তার সঙ্গে প্রশাসকসত্তার কোন বিরোধ ছিল না। দেশ ও জাতির বৃহত্তর ভুবনে তাঁর আদর্শিক পদচারণা ভবিষত প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল আতিকুর রহমান উজ্জ্বলের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘ভোরের পাখি’র শিল্পীদের পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেনÑ ফাহিমা হোসেন চৌধুরী, খায়রুল আনাম শাকিল, চঞ্চল খান, ইয়াসমিন মুশতারী, মকবুল হোসেন, চৌধুরী মোস্তাক হোসেন, অচিন্ত কুমার হাজং, বিবেকানন্দ দাস ও মোহাম্মদ হানিফ। আজকের আয়োজন ॥ আজ মঙ্গলবার মেলার সপ্তদশ দিনে বিকেল ৪টায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শিল্পী রফিকুন নবী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেনÑ মফিদুল হক, মইনুদ্দীন খালেদ ও সাজ্জাদ শরিফ। সভাপতিত্ব করবেন শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী।
×