ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীর ৯২ ওয়ার্ডের মধ্যে নামমাত্র চালু আছে সাতটিতে ;###;বন্ধ হয়ে গেছে পনেরোটি ;###;ধ্বংসের মুখে ঐতিহ্যবাহী নর্থব্রুক হল লাইব্রেরি

পাঠাগার দেখভালে ডিসিসির মন নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

পাঠাগার দেখভালে ডিসিসির মন নেই

আনোয়ার রোজেন ॥ ‘লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল-কলেজের চাইতে একটু বেশি। আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব দেশের তত বেশি উপকার হবে’Ñ জাতীয় জীবনে লাইব্রেরি বা পাঠাগারের গুরুত্ব বোঝাতে কথাগুলো বলেছিলেন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী। আর খ্যাতনামা সাহিত্যিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী লাইব্রেরিকে চিহ্নিত করেছেন ‘জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মাপকাঠি’ হিসেবে। তবে দেশের সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত ও সভ্য জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত নগর রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের উন্নতির মানদ-ের বিবেচনায় লাইব্রেরি গুরুত্বহীন। তাই কোথাও লাইব্রেরি রুমে রাখা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারের ডেক-ডেকচি ও থালা-বাসন। কোথাও বা লাইব্রেরি কক্ষ ও বইয়ে জাল বুনেছে মাকড়সা! সংস্কারের অভাবে প্রায় দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী নর্থব্রুক হল পাবলিক লাইব্রেরির ছাদে দেয়া ফাটল কিংবা বর্ষাকালে এর হাঁটুজলে ডুবে যাওয়াতেও বিকার নেই কর্তৃপক্ষের। দুই ডিসিসির মোট ৯২টি ওয়ার্ডের মধ্যে নামমাত্র পাঠাগার চালু রয়েছে ৭টি ওয়ার্ডে। আর এসব পাঠাগার পরিচালনা করছেন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা! গত এক দশকে রাজধানীবাসীর দেখভালকারী সংস্থা- সিটি কর্পোরেশনের সীমানা বেড়েছে। বেড়েছে জনসংখ্যা। একই সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও। এ সময় স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। বাড়েনি কেবল সিটি কর্পোরেশনের পাঠাগারের সংখ্যা। বরং এক দশকের ব্যবধানে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) পাঠাগারের সংখ্যা ২৩ থেকে ৭টিতে নেমে এসেছে। প্রচুর পাঠক থাকলেও কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও সুস্থ পরিবেশের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে ১৫টি পাঠাগার। আর প্রায় ৭০ লাখ নাগরিক অধ্যুষিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে কাগজে-কলমে পাঠাগার আছে ৫টি। তবে এর মধ্যে ৪টি পাঠাগারের কোন অস্তিত্বই নেই! নাগরিক সেবার মান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ডিসিসি দুই ভাগ করা হলেও তদারকির অভাবে পাঠাগার ব্যবস্থার কোন উন্নয়ন ঘটেনি। বিভক্তির পরই বন্ধ হয়ে গেছে ১৫টি পাঠাগার। দুই ডিসিসির পাঠাগার সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত পাঠাগারগুলো বিকেল ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। পাঠাগারে পাঠকরা সাধারণ বইয়ের পাশাপাশি দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, জার্নাল, গবেষণাপত্র, সায়েন্সফিকশন ইত্যাদি পাঠের সুযোগ থাকবে। ক্যাটালগ দর্শন ও লাইব্রেরিয়ানের সহযোগিতা থাকবে। তবে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব সুবিধা থাকা তো দূরের কথা পাঠাগারগুলো চালু রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নীতিমালায় উল্লেখিত একটি সুবিধাও দেয়ার সামর্থ্য চালু পাঠাগারগুলোর নেই। নেই পর্যাপ্ত বই, রাখা হয় না কোন ম্যাগাজিন বা সাপ্তাহিকী। কোনটি আবার খোলারই লোক নেই। কোন পাঠাগারেই বইয়ের ক্যাটালগ ও ক্যাটালগার নেই। ক্লিনাররা পালন করছেন লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব। বইয়ের আলমারি না খুলতে খুলতে জং ধরে গেছে। প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখার কথা থাকলেও এ নিয়ম মানা হয় না। দুই ডিসিসির পাঠাগারগুলোর দুরবস্থা প্রসঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জনকণ্ঠকে বলেন, এসব পাঠাগার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সবাই আসলে চাকরিজীবী। বইপ্রেমী না হলে শুধু চাকরির মানসিকতা নিয়ে পাঠাগার পরিচালনা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালের শুরুতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অনেকে নিজস্ব উদ্যোগে পাঠাগার চালু করেছিলেন। ডিসিসি বিভক্ত হওয়ার পরই পরিচালনার ব্যর্থতায় সাবেক ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭৪, ৫৯, ৬০, ৬৪, ৬৫, ৫৪, ৪২, ৪৪, ৪, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে থাকা এ রকম ১৫টি পাঠাগারের সবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টিতে এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১টি ওয়ার্ডে পাঠাগার নামমাত্র চালু আছে। ডিএসসিসির ৭ পাঠাগার ॥ ডিএসসিসির তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে পাঠাগার রয়েছে ৭টি। এর মধ্যে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে অবস্থিত সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নর্থব্রুক হল পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থা সবচেয়ে করুণ। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ফরাশগঞ্জের টাউন হলের (বর্তমানে লালকুঠি নামে পরিচিত) পাশে ব্রিটিশ আমলে ১৮৮২ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাহিত্যে নোবেল জয়ের পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এখানেই সংবর্ধিত করেছিল ঢাকাবাসী। সংস্কারের অভাবে রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত সমৃদ্ধ সেই পাঠাগার ভবনটির এখন জীর্ণদশা। দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়েছে। ভবনের ছাদে দেখা দিয়েছে ফাটল। লাইব্রেরির কর্মচারীরা জানিয়েছেন, বর্ষাকালে লাইব্রেরিতে হাঁটু পরিমাণ পানি উঠে। ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে ১২টি আলমারিতে রাখা শত বছরের পুরনো প্রায় কয়েক হাজার বই ইতোমধ্যে পড়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি পাঠাগার ভবনের পাশে ওয়াসা পানির পাম্প ও জেনারটর বসিয়েছে। জেনারেটরের শব্দে পাঠাগারে পড়াত দূরের কথা, বসে থাকাই মুশকিল। যথাযথ অনুমতি না নিয়েই ওয়াসা পাম্প ও জেনারেটর বসিয়েছে বলে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। লাইব্রেরিটি সংস্কারের জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেগুলোর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ এটি সংস্কারে ঢাকা বিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে প্রধান করে ডিএসসিসির সচিব ও বিশিষ্ট স্থপতিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সুপারিশকৃত সংস্কার প্রস্তাবটি সাবেক প্রশাসক ইব্রাহীম হোসেন খানের সময় অনুমোদনও লাভ করে। তবে প্রশাসক পরিবর্তিত হওয়ার পর সংস্কার উদ্যোগটি আর এগোয়নি। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, লাইব্রেরিসহ গোটা টাউন হলটিরই সংস্কার জরুরী। এ বিষয়ে আমরা একটি সংস্কার প্রস্তাবও ডিএসসিসিকে দিয়েছিলাম। প্রস্তাব অনুযায়ী ওই স্থাপনাকে ঘিরে পুরান ঢাকার মানুষের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার কথা। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী চায় না- ভবনটির সংস্কার হোক। তাদের কারণেই সংস্কার উদ্যোগে ভাটা পড়েছে বলে তার অভিযোগ। ডিএসসিসির অন্য ৬টি পাঠাগারের অবস্থাও তথৈবচ। গত অর্থবছরে পাঠাগারের জন্য মাত্র ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও একটি টাকাও ব্যয় করেনি কর্তৃপক্ষ। আশপাশে কয়েকটি স্কুল-কলেজ থাকলেও হাজারীবাগ পার্কের কাছে অবস্থিত হাজী খলিল সর্দার লাইব্রেরি পাঠক শূন্য। ২০ বছরের পুরনো এ পাঠাগারটিতে বই আছে মাত্র ৫০০। লালবাগে অবস্থিত মাওলানা মুফতী দ্বীন মোহাম্মদ ইসলামী পাঠাগারের পরিবেশ নোংরা। দ্বিতল পাঠাগারের নিচতলায় মহানগর শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বসানো জেনারটরের শব্দে গোটা ভবন কাঁপে। দ্বিতীয় তলার একাধিক লাইট ও ফ্যান নষ্ট। টয়লেটে পানি নেই। বই আছে মাত্র ৫০০টি। রোকনপুর পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থান লক্ষ্মীবাজার সংলগ্ন রোকনপুর কমিউনিটি সেন্টারের ৫ তলায়। সেখানে গিয়ে পাঠাগারের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কক্ষের একপাশে বড় বড় ডেক-ডেকচি ও থালা বাসন সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সূত্রাপুরের জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পাঠাগারটিও কার্যত বন্ধ। কেন্দ্রের কর্মচারীরা জানান, এখানে কোন লাইব্রেরিয়ান নেই। চতুর্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী মাঝে মাঝে দুই ঘণ্টার মতো এটি খোলা রাখেন। ওয়ারীতে অবস্থিত আবদুর রহিম স্মৃতি পাঠাগারের চিত্রও অভিন্ন। ফকির চান কমিউনিটি সেন্টারের দ্বিতীয় তলার অপ্রশস্ত একটি কক্ষে শ’দুয়েক বই নিয়ে চলছে এটি। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পাঠাগারগুলোর দুরবস্থার কথা স্বীকার করে ডিএসসিসির প্রধান সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা খোন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, পাঠাগার পরিচালনায় লোকবলের সঙ্কট প্রকট। সঙ্কট নিরসনে পাঠাগারগুলোতে লাইব্রেরিয়ান ও ক্যাটালগার পদে নিয়োগের চিন্তা ভাবনা চলছে। তাছাড়া পাঠাগারগুলোকে সত্যিকার অর্থে পাঠকবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়া হবে। আর নর্থব্রুক হল পাবলিক লাইব্রেরি সংস্কারের থেমে যাওয়া উদ্যোগটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তিনি। ডিএনসিসির তালিকা সর্বস্ব পাঠাগার ॥ কাগজে-কলমে ডিএনসিসির পাঠাগার সংখ্যা ৫টি। তবে এর মধ্যে ৪টি পাঠাগারেরই কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্যটিও পাঠকের অভাবে নিষ্প্রাণ। পাঠাগারের অস্তিত্ব না থাকলেও ২০১৩-’১৪ অর্থবছরের পাঠাগার খাতে ১০ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। ডিএনসিসির তালিকায় মোহাম্মদপুর টাউন হল সংলগ্ন স্থানে (৩১ নম্বর ওয়ার্ড) কমিশনার রাজু মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থানের কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে সেখানে কোন লাইব্রেরির অস্তিত্ব নেই। প্রায় এক যুগ আগেই এটি বন্ধ হয়ে গেছে। কমিশনার অফিসের তিন তলায় অবস্থিত পাঠাগার কক্ষটিতে বইপত্র যা ছিল সেগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
×