ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুফী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন

যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে তারা কি মুসলমান?

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে তারা কি মুসলমান?

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলাম ও আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস ও পালন করে, তারা কীভাবে মানুষকে এভাবে পুুড়িয়ে হত্যা করতে পারে? শুধু ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিএনপি-জামায়াত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে। মানুষ পুড়িয়ে মেরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তাঁর অর্থ-সম্পদ ও দুর্নীতির মামলার বিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চান, আর জামায়াতে ইসলামী মানবতা বিরোধীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে যারা মানুষ পুড়িয়ে মারছে, আল্লাহ যেন তাদের সুমতি দেন। বাংলাদেশের চলমান সহিংস পরিস্থিতিকে অত্যন্ত দুঃখজনক, নৃশংস ও কষ্টকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশ যখন সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের সার্বিক উন্নতি হচ্ছে- ঠিক সেই সময় কেন এই তা-ব? এই মানুষের কান্না, কষ্ট, মানুষের ব্যথা-বেদনা তাদের মনে কি নাড়া দেয় না? পুড়িয়ে মারার মতো যন্ত্রণা মানুষ মানুষকে কীভাবে দেয়? যারা ইসলাম ধর্মে বিশ^াস ও পালন করে, তারা কীভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারে? ইসলামের নামে রাজনীতি করে কীভাবে একজন মুসলমান হয়ে আরেকজন মুসলমানকে পুড়িয়ে মারতে পারে? আসলে বিএনপি নেত্রী (খালেদা জিয়া) মানুষ পুড়িয়ে মেরে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় যাতে এদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস হয়। মানুষ ধ্বংস হয়। মানুষকে পুড়িয়ে মারার বীভৎসতা কখনই সহ্য করা যায় না। শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তরিকত ফেডারেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক সুফী সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশসহ সারাবিশে^ শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে দেশে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। জানি না বিএনপি-জামায়াত কেন ব্যক্তিস্বার্থে এভাবে মানুষ হত্যা করছে? কেন এই নাশকতা-সন্ত্রাস চালাচ্ছে? এভাবে মানুষ পুড়িয়ে তারা কী অর্জনই বা করছে? আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বিদেশ থেকে এতিমের নামে টাকা এনে আত্মসাত করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁর বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা হয়েছিল, যার বিচার চলছে। উনি বিচারের সম্মুখীন হতে ভয় পান। এ কারণেই তিনি মানুষ পুড়িয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন। নাশকতা-সহিংসতা চালিয়ে দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছেন যাতে দেশ ও গণতন্ত্র ধ্বংস হবে, অন্যদিকে তিনি তাঁর ‘চুরির টাকা’ রক্ষা করতে পারবেন। এটিই তাঁর লক্ষ্য। তিনি বলেন, এদের আরেকটি প্রধান লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। আমরা যখন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াতও সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আমাদের দেশে তো বিচার কাজ এক রকম। এটা যদি কোন ইসলামিক দেশে হতো তবে তাদের শিরñেদ করা হতো। তাদের শিরñেদ করা হতো। প্রচলিত আইন ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে বলে তারা (যুদ্ধাপরাধী) আপিল করারও সুযোগ পাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে কী অর্জন করছে? এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে। শত বাধা উপেক্ষা করে মানুষ ভোট দিয়েছে, আমরা সরকার গঠন করেছি। গত একবছর মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ছিল। গত ৬ বছর থেকে আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছি। মানুষের মধ্যে যখন আস্থা, বিশ^াস, স্বস্তি ও শান্তি ফিরে এসেছে, ঠিক সেই সময় বিনা কারণে পেট্রোলবোমা মেরে ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী-শিশু নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ পুুড়িয়ে মারা হচ্ছে। মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা (বিএনপি-জামায়াত) কী মানবতার দিকে একবারও ফিরে তাকাবে না? এ রকম দেখে কী মনে হয় সত্যিই কী তারা ইসলাম ধর্মে বিশ^াস করে? এরা কী প্রকৃত মুসলামান? সবচেয়ে কষ্ট লাগে, ইসলাম ধর্মের নাম নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনীতি করে ঠিকই, কিন্তু তাদের হাত থেকে আমাদের মসজিদ ও পবিত্র কোরআন শরীফও রেহাই পায় না। মসজিদ ও কোরআন শরীফও আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে তারা। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! বিশ্ব এজতেমা ও পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর সময়ও তারা অবরোধের কর্মসূচী দেয়। তার মানে এরা মহানবীকেও (স.) কোন সম্মান দেয় না। তিনি বলেন, ইসলাম ধর্ম সবচেয়ে আধুনিক এবং কল্যাণ, শান্তি ও প্রগতির ধর্ম। কিন্তু সেই ধর্মের কথা বলে যারা রাজনীতি করে তারাই যখন মানুষ পুড়িয়ে মারে, তখন এই পবিত্র ধর্মের বদনাম ও মর্যাদাহানী হয়। মুষ্ঠিমেয় লোকের জন্য পবিত্র ধর্ম ইসলামের অপমানজনক অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। মহান আল্লাহ তাদের সুমতি দিক- এটাই চাই। ইসলাম ও আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আলেম-ওলামা ও মাশায়েখদের কাছে এর বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম। আর ২০ দলের এই মানুষ পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে কাজ করার জন্য তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বক্তব্যের শুরুতে সুফী দর্শন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে সুফী দর্শন কিংবা সুফীবাদ বলা হয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহকে জানার আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। এই আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক সুফি সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পথভ্রষ্ট মানুষের কাছে ইসলামের শান্তির বাণী পৌঁছে দিয়ে তাদের আলোর পথে নিয়ে আসতে পীর মাশায়েখ, সুফীসাধক ও ধর্মীয় নেতারা কাজ করবেন বলেও তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের অবদানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ইসলামের যথাযথ প্রচার, প্রসার ও ধর্মকে যেন ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কেউ অপব্যবহার করতে না পারে, সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, তবলীগ জামায়াতের জন্য টঙ্গিতে বিশাল জমি দান ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। সকল ধর্মের মানুষের সহ-অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী আবারও ইসলাম ও আন্দোলনের নামে মানুষকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক সুফী সম্মেলনের উদ্বোধন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী এমপির সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সম্মেলনের আহ্বায়ক ও তরিকত ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী। আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক কোরের ডিন শাহের মোহাম্মদ, ভারতের রাজস্থানের আজমীরের খাজা মইনুদ্দিন (র.) চিশতী দরগাহ শরিফের সভাপতি ওয়াহিদ হোসেন চিশতী, দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া দরগাহের সভাপতি সৈয়দ নজিব আল নিজামী, আফজাল হোসাইন কাদরী, তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল এমপি, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ তৈয়বুর বশর মাইজভা-ারী প্রমুখ। ওয়াহিদ হোসেন চিশতী তাঁর বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রীকে আজমীর থেকে আনা একটি ওড়না উপহার দেন। বিএনপির কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে ॥ শনিবার বিকেলে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভুলতা ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালের মতো বিএনপি-জামায়াত আবার একই কায়দায় মানুষ হত্যার খেলা শুরু করেছে। তারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে। এ ধরনের কর্মকা-ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এতে জনগণের কষ্ট হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নষ্ট হচ্ছে। এগুলো মেনে নেয়া যায় না। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট কর্মসূচীর নামে ‘জঘন্য কর্মকা-’ করছে মন্তব্য করে বলেন, আমরা আশাবাদী সত্বরই তারা এসব কর্মকা- বন্ধ করবে। সহিংস কর্মকা-ে জড়িতদের কঠোরভাবে দমন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে নাশকতা-সহিংসতা বন্ধে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। কারও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য দেশের মানুষকে পুড়িয়ে মারবে, এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। সহিংসতাকারীদের দমনে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দেশবাসীর সহযোগিতা একান্তভাবে দরকার। ভুলতা ফ্লাইওভার এক দশমিক দুই তিন কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি সরকারের নিজস্ব অর্থায়নেই হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর অর্থায়ন করছে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট। এটি এক দশমিক দুই নয় কিলোমিটার দীর্ঘ। শীতলক্ষ্যা সেতুর অর্থায়নের জন্য সৌদি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু এবং ভুলতা ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ আশা করি দ্রুতই শুরু হবে। সেতুটি নির্মাণের ফলে নারায়ণগঞ্জে কর্মচাঞ্চলতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন ঢাকার সৌদি দূতাবাসের চার্জ দ্যা এ্যাফেয়ার্স। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জেলার সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান, গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক ও নজরুল ইসলাম বাবু।
×