ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

যারা দেশের জন্য হুমকি তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে কী ভাবে?

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

যারা দেশের জন্য হুমকি তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে কী ভাবে?

(১৪ ফেব্রুয়ারির পর) একটি সেক্যুলার স্কুল খোলার কথা মনে আসে না। তা হলে, আওয়ামী জোটও ক্ষমতায় এসেছে কয়েকবার, কিভাবে? সেটি কিভাবে সম্ভব? আমার মনে হয়েছে, ডানের অত্যাচার ব্যভিচার দুর্নীতি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখন মৃদু আওয়ামীবিরোধী ও সুবিধাবাদী বা ক্ষতিগ্রস্তরা আওয়ামী জোটকে ভোট দেয়। খুব সামান্য ব্যবধানে তারা জেতে। কিন্তু দু’বছর মোটামুটি তাদের কর্মসূচী এগিয়ে নিলেও তারপর তাদের বিরুদ্ধে ‘গ-গোল’ শুরু হয় এবং তাদের এক সময় সরে যেতে হয় বা সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হলো, যখনই তারা ক্ষমতায় যায় তখনই প্রবৃদ্ধি হয় বিশেষ করে গরিব মানুষরা উপকৃত হয়। কিন্তু, এই ভাল কাজ ও উন্নয়ন কেন মানুষ মনে রাখতে চায় না? এর নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারব না। তবে, আওয়ামী জোট ক্ষমতায় গেলে প্রতিবারই দেখা গেছে, যারা তাদের পক্ষে ছিল না, সক্রিয় ছিল না, তাদেরই সুযোগ-সুবিধা বেশি দেয়। দলের নেতা-মন্ত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতা কর্মীদের মধ্যে বিতড়িত হলেও তার বিনিময়ে কিছু দিতে হয়। আর কেন যেন বিরুদ্ধবাদীরা প্রভাবশালী পদগুলো অধিকার করে থাকে। যে কারণে দেখবেন, এই সময়, এই সরকার ও দল যাদের পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ করেছে তাদের কোথাও সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। এ কারণেও মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য সবক্ষেত্রে নেতাদের একতরফা দেখা দেয়াও ঠিক নয়। এদেশের মানুষকে কখনও সন্তুষ্ট করা যায় না। বিএনপি কিন্তু তাদের পক্ষভুক্তদের মনে রাখে। তাদের সময়ও লুটপাট-অত্যাচার প্রবল হয়, দেশের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায় কিন্তু মানুষ খুব একটা অসন্তুষ্ট থাকে বলে মনে হয় না। বাঙালী মনই বোধহয় এ রকম। যে দল চান্স পেলেই হিন্দু খেদায় সে দলের নেতা গয়েশ্বর রায়, নিতাই রায় চৌধুরী প্রমুখ। তা হলেই বুঝুন অবস্থাটা। আজকের সঙ্কটের একটি ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য এ দীর্ঘ পটভূমি দিতে হলো। আমরা যখন তর্কবিতর্ক করি তখন এ বিষয়গুলো মনে রাখি না। ২. প্রথমে বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ কর্মসূচির মূল কারণ হিসেবে ঐ পক্ষের নেতারা যা বলছেন, তা হলোÑ গত ৫ জানুয়ারি তাদের সমাবেশ করতে না দেয়া। সেদিন তারা গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করতে চেয়েছিল। সমাবেশের কারণ গণতন্ত্র হত্যা। গণতন্ত্র হত্যা কেন? তাদের ভাষায় ‘একতরফা’ নির্বাচন দেয়া। এখন প্রশ্ন হলো একতরফা নির্বাচন সরকার ঘোষণা করতে পারে কিনা? পারে না। সরকার নির্বাচন দিতে চেয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। কিন্তু, বিএনপি জোটের দাবি হলো, তাদের শর্ত অনুযায়ী নির্বাচন দেয়া। এর অর্থ আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন। সেটি নিয়ে শেখ হাসিনা আলাপ করতে চেয়েছেন, তাদের নিয়ে প্রাক-নির্বাচন মন্ত্রিসভা করতে চেয়েছেন, কোন কিছুতেই কিন্তু বিএনপি সায় দেয়নি। আজকে যখন অনেকে সংলাপ সংলাপ করেন তখন কিন্তু এই পটভূমি ভুলে যান। আরেকটি বিষয় এসব বিতর্কে স্থান পায় না বা দেয়া হয় না। বা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাওয়া হয়, তা হলো, প্রাক-নির্বাচনী ভায়োলেন্স। নির্বাচনে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে সামান্য ভায়োলেন্স হতেও পারে, যা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু উপমহাদেশ এ ঐতিহ্য থেকে বেরোতেও পারেনি। এসব ভায়োলেন্সে যে সব সময় কেন্দ্রীয় মদদ থাকে তাও নয় এবং আরও মনে রাখা উচিত এই ভায়োলেন্স জিয়া-এরশাদ আমলেই শুরু। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রাক-নির্বাচন ছিল সুপরিকল্পিত ও কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তারা প্রায় ৫০০ স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছিল। যা আগে কখনও হয়নি। হিন্দু ভোটারদের আক্রমণ, ঘরবাড়ি লুট ও ধর্ষণ করা হয়েছিল। প্রচুর বৃক্ষ কর্তন করা হয়েছিল। এবং সুনির্দিষ্টভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল। এগুলো ছিল ভায়োলেন্সের নতুন উপাদান। এখন যুক্ত হয়েছে পেট্রলবোমা। নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত যোগ দেয়নি। অন্যরা দিয়েছে, সেটির সংখ্যা ছোট বড় হতে পারে। এ বিষয়ে, খালেদা জিয়া এক দশক আগে যে যুক্তি দিয়েছিলেন সেটি উল্লেখ করছিÑ নির্বাচন দেয়া হয়েছে, কে আসবে না আসবে তা তার নিজের ব্যাপার। তার আমলে যদি বিষয়টি এমন হয় অন্য আমলে না হওয়ার কারণ কী? নির্বাচন হওয়ার পর থেকে বিএনপি জোট এই সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও একই প্রচারণা চালিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারেক রহমান লন্ডন থেকে নানা রকম নির্দেশ দিয়েছেন এবং জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধুকে পাকবন্ধু, রাজকার হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। তারেক যখন লন্ডনে যান তখন মুচলেকা দিয়েছিলেন যে, তিনি রাজনীতিতে নাক গলাবেন না। এই মুচলেকা ছুড়ে ফেলে দেয়া এবং বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার বললে যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ বলেন, তিনি এই বাক্য প্রত্যাহার না করলে বিএনপিকে প্রতিরোধ করা হবে তাতে কোন অপরাধ হয় বলে মনে হয় না। তারেক রহমানের অনেক কথা না মানতে পারি, ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু তিনি স্বাধীনতার বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলেন বা পাকিস্তানের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন তখন যদি তাকে রাজনীতি করতে না দেয়ার কথা বলা হয় (বলা হয়নি) তাও অযৌক্তিক নয়। এ সব বিষয় যদি গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত না হয় তা’হলে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়া গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত হবে কেন? বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় এর চেয়েও কঠোর অবস্থান যখন নিয়েছিল সভা সমাবেশের ক্ষেত্রে তখন গণতন্ত্র কি বিপন্ন ছিল না? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি কোন পক্ষই করেন না তা’হলো, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ যারা সমর্থন করে তাদের রাজনীতি করতে দেয়া আদৌ উচিত কিনা? এবং তা গণতন্ত্রবিরোধী কিনা? কয়েক দিন আগে নির্মূল কমিটির এক সভায় শাহরিয়ার কবির বলেছিলেন, পাকিস্তানে আসগর খান একটি রিট করেছিলেন আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, তারা রাজনৈতিক দলকে অর্থ সাহায্য করে যেটি তারা পারে না। জিয়া ও এরশাদ আমলে ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ ছিল। পাকিস্তানের খবরের কাগজে এ নিয়ে যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল তাতে পাকিস্তানের যেসব দল টাকা নিয়েছে তার তালিকা ছাপা হয়েছিল। শাহরিয়ার বলেছেন, এ বিষয় নিয়ে তিনি লাহোরে মওদুদী পুত্র ইসলামী চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট হায়দার ফারুক মওদুদীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঐ তালিকায় বিএনপি-জামায়াতের নামও আছে। এই ভুল তারা কেন করছে? এ দুটি দল তো বাংলাদেশের। মওদুদী বলছিলেন, আপনারা সেটা মনে করতে পারেন। কিন্তু আইএসআই তা মনে করে না। তারা এদের পাকিস্তানী দল বলেই টাকা দিয়েছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তান পার্লামেন্ট ও বিএনপি-জামায়াত কি একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আইএসআইয়ের সহায়তায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কি বিএনপি সরকারের নির্দেশে এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের কর্তারা একযোগে গ্রেনেড ছোড়ার বন্দোবস্ত করেনি? বা দশট্রাক অস্ত্র চোরাচালানে কি তারা জড়িত ছিল না। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের দূতাবাসের কর্মী মযহার কি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য জাল টাকা হাতে ধরা পড়েনি। জঙ্গীদের সে সহায়তা করত বলেও অভিযোগ উঠেছে। সে ক্ষেত্রে, তাকে বিনা বিচারে ফেরত পাঠানো হলো কেন, যেখানে এ ধরনের কর্মচারীর ডিপ্লোমেটিক ইমমিউনিটি থাকার কথা নয়? (চলবে)
×