ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টাইগার চিংড়ি রফতানি করে আয় হয় কয়েক কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

টাইগার চিংড়ি রফতানি করে আয় হয় কয়েক কোটি টাকা

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া ॥ দেখতে হুবহু ছোট সাইজের বাগদা চিংড়ি। কিন্তু বাগদা চিংড়ি নয়। বাঘের চামড়ার মতো ডোরাকাটা। তাই বলা হয় টাইগার চিংড়ি। অনেকটা লালচে রঙের। এ কারণে অনেক জেলে লাল চিংড়িও বলেন। সাগর কিংবা নদীতে পানি যখন লোনা থাকে, তখন এই চিংিড়ির জন্ম হয়। আবার পানি মিঠা হলেই মারা যায়। জেলেদের ভাষ্য, ‘আয়ু শেষ হয়ে যায়।’ ফিবছর শুধু কলাপাড়ায় বিক্রি হয় অন্তত ১০ কোটি টাকার টাইগার চিংড়ি। চার মাসের কর্মসংস্থান মেলে অন্তত ১০ হাজার জেলে পরিবারসহ তাদের সন্তানদের। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, টাইগার চিংড়ি সম্পূর্ণভাবে বিদেশে রফতানি হয়, যা দিয়ে দেশ আয় করছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। সাগরপাড়ের জনপদ কলাপাড়ার বৃহৎ মৎস্যবন্দর মহিপুর ও আলীপুরে এই চিংড়ির বেচাকেনা চলে। এছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আরও অসংখ্য বিক্রিস্পট। ফিবছর হাজার হাজার মণ টাইগার চিংড়ি এখান থেকে খুলনা ও ঢাকায় ট্রাক কিংবা পিকআপবোঝাই করে চালান হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, ‘বিদেশে এক্সপোর্ট হয় টাইগার চিংড়ি।’ দামও বেশ চড়া। সাগরে আহরিত টাইগার চিংড়ি প্রথমে মাথাসহ আড়তে বেচাকেনা হয়। কেজি ২শ’৫০ থেকে ৩শ’ টাকা। তারপর মাথা ছিন্ন করে শুধু বডিসহ এ চিংড়ি রফতানিযোগ্য মানের করা হয়। তখন দাম হয় তিনগুণ। কখনও আরও বেশি। মৌসুমে ২০-২৫ হাজার মণ টাইগার চিংড়ি কলাপাড়ার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে চালান করা হয় বলে এখানকার মৎস্য আড়তদার সমিতির নেতৃবৃন্দের দাবি। মহিপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিমাই চন্দ্র দাস জানান, ফিবছর অন্তত ২শ’ টন টাইগার চিংড়ি কলাপাড়া থেকে খুলনার মোকামে চালান হয়। তার ভাষ্যমতে, পৌষ মাস থেকে চার মাস এ চিংড়ি সাগরে ধরা পড়ে। খাড়া এক ধরনের জাল ভাটার সময় সাগরে পেতে রাখা হয়। তখন চিংড়িগুলো জালে চাপে, জোয়ারের আগেই তুলতে হয়। নইলে সব ভেসে যাবে। এ জালে অন্য কোন মাছ আটকায় না। তারপরও কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও মৎস্য বিভাগ এই জালও পুড়িয়ে ফেলে। সচেতন জেলে ও আড়ত মালিকদের ভাষ্য, সাগরের মাছ ও জাল সম্পর্কে তাদের পূর্ণ অভিজ্ঞতা নেই। যেন চলছে অনভিজ্ঞ শাসন। কারণ লোনা পানিতে জন্ম নেয়া এই চিংড়ি না ধরলেও মিঠা পানির মৌসুমে মারা যাবে। তবে এ বছর অনেক কম টাইগার চিংড়ি সাগরে ধরা পড়ছে। কারণ হিসেবে মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানি জমাট বেঁধে বরফের মতো জালে আটকে জাল ভেসে থাকায় মাছ বেশি ধরা পড়ছে না। এ মাছ মাংসের মতো ভুনা করে খেতে খুব স্বাদ। আহরিত ৯৫ ভাগ টাইগার চিংড়ি বিদেশে রফতানি হয় বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। স্থানীয়ভাবে সাগর কিংবা মোহনা এলাকায় নির্দিষ্ট জাল পেতে জেলেরা টাইগার চিংড়ি আহরণ করে। আড়তে বিক্রির পরে চিংড়ির মাথা বডি থেকে আলাদা করা হয়। এজন্য শ্রম দেয় জেলে পরিবারের দরিদ্র মহিলা, শিশু ও জেলে শ্রমিকরা। মৌসুমের প্রায় চার মাস প্রতি সপ্তাহে ৩-৪ দিন এসব মানুষের কাজ জোটে টাইগার চিংড়িকে কেন্দ্র করে। কয়েকশ’ শ্রমিক পায় চিংড়ির মাথা ছাড়ানোর কাজ। এর সঙ্গে জড়িতরা এ কাজকে বলেন চিংড়ির মাথা ভাঙ্গার কাজ। তবে অনেক জেলে, আড়ত মালিক ও শ্রমিকের ভাষ্য, ‘চিংড়ি হেডলেস’ করার কাজ। এক কেজি চিংড়ির মাথা ভেঙ্গে মজুরি মেলে মাত্র তিন-চার টাকা। অথচ কাজটি খুবই দুরূহ। এ কাজে জড়িত শ্রমিকরা জানান, আঙ্গুলে ঘা হয়ে যায়। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়তে থাকে। মহিপুর ফেরিঘাট থেকে সোজা ডানদিকে শিববাড়িয়া নদীর পাড় ঘেঁষে আড়তের সামনে খালি জায়গায় এ মৌসুমে প্রতিদিন শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু টাইগার চিংড়ির মাথা ভাঙ্গার কাজ করে থাকে। এ কাজে নিয়োজিত আয়শা বিবি (৪২), সালেহা বেগম (৭০), রাহিমা (১২), মুন্নি (২২), সামছুল হক, আবু তাহের- এরা সবাই জেলে পরিবারের সদস্য। তাদের দাবি, টাইগার চিংড়ি ধরার কারণে তারা তিন-চার মাসের কাজ পায়। তাদের কাছে সিজনাল কাজ এটি। শুধু কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর, আলীপুর, খালগোড়া, কাউয়ারচর, গঙ্গামতিসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রতি বছর তিন-চার মাসে অন্তত ১০ কোটি টাকার টাইগার চিংড়ি বেচকেনা হয়। ৎবিদেশে এই চিংড়ির চাহিদাও প্রচুর। এই চিংড়ি দেখতে অনেকটা আলাদা প্রজাতির মনে হয়। নাকে একটু গন্ধও লাগে। হাজার হাজার জেলে পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এই টাইগার চিংড়ির বেচকেনাকে কেন্দ্র করে। অথচ সরকারীভাবে আলাদা কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি টাইগার চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে। এজন্য বাছাই করতে একটি শেড করা জরুরী প্রয়োজন। রফতানিযোগ্য এ চিংড়ির স্যুপ খুবই সুস্বাদু বলে দাবি আড়ত মালিকদের।
×