ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সন্ধ্যায় লেখক পাঠকদের জমজমাট আড্ডা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সন্ধ্যায় লেখক পাঠকদের জমজমাট আড্ডা

মোরসালিন মিজান ॥ সারাদিন ঘুরে বেড়ানো। বই হাতে নিয়ে দেখা। অল্পস্বল্প কেনা। আড্ডাও চলছে। দিনের বেলাটা এর পরও কেমন যেন খাপছাড়াই থেকে যাচ্ছে। তবে সন্ধ্যা নামতেই অন্য চেহারা। কেমন যেন ঝলমল করে উঠছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার দু’টি ভেন্যু। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভিড় করছেন লেখক পাঠক প্রকাশকরা। এ সময় বিক্রিও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই কম-বেশি পাঠকের উপস্থিতি চোখে পড়ছে মেলায়। তবে এর সঙ্গে খুব বেশি সম্পৃক্ত অংশটি আসছেন সন্ধ্যা নামার পর। মেলা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বই কেনা গল্প-আড্ডায় তারা জমিয়ে রাখছেন পুরো প্রাঙ্গণ। মঙ্গলবার মেলায় এসেছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অনন্যার স্টলে মোটামুটি খুঁটি গেড়েছিলেন তিনি। এখন যে দুই-চারজন লেখক খুব চেনা জানা তাঁদের অন্যতম মিলন। বহুদিন ধরে লিখছেন। মেলায় আসছেন এবং অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। লেখক সশরীরে উপস্থিত থাকলে বিক্রি বাড়ে। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য আরও একবার দেখা গেল। কিছু কথাও হলো এক ফাঁকে। জানা গেল, বর্তমান সময়টি আর সবার মতো লেখককেও হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। বললেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। এ অবস্থায় মেলা কতটা জমবে বলা মুশকিল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে মানুষ তো ঘর থেকে বের হতেই ভয় পাচ্ছে। কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটা আমাদের ভাষার মাস। এই মেলা আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। পাঠক-লেখক-প্রকাশক সবাই সারা বছর অপেক্ষায় থাকে মেলার জন্য। এ মাসে রাজনৈতিক দলগুলো মিলে যা করল, তা এক কথায় অনুচিত হয়েছে। ভাষার মাসে হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রত্যাহারের আহ্বানও জানান তিনি। লেখকদের মতো প্রকাশকরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্ধ্যার কিছু আগে মেলায় প্রবেশ করেন। মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে মেলায় প্রবেশ করতে দেখা যায় আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনিকে। কখনও নিজের স্টলের ভেতরে থেকে, কখনও বাইরে থেকে আড্ডা এগিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কখনও প্রকাশকদের সঙ্গে। কখনও আলাপ চলছিল নবীন লেখকদের সঙ্গে। গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে ছবি তোলার কাজও করছিলেন আগ্রহ নিয়ে। বললেন, দিনের বেলাটা অফিসে কাটাতে হয়। যেসব বই আসার বাকি, সেগুলোর কাজ তদারকি করি। শেষ করে মেলায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আড্ডা-আলাপের যুক্তি তুলে ধরে বললেন, বই বিক্রি তো করতেই হবে। তবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুধু বই বিক্রির নয়। লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলাও। এ জন্যও সময় দিতে হয়। এভাবে মেলা প্রাণ পায় বলে মনে করেন তিনি। এদিকে, মেলার এক-তৃতীয়াংশ সময় ইতোমধ্যে ফুরিয়ে যাওয়ায় কেনায় মন দিয়েছেন অনেকেই। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলে অত ভিড় ছিল না। তবে বিক্রি ছিল ভাল। পাঠক নিজেদের মতো করে ঘুরছিলেন। বই দেখছিলেন। পছন্দ হলে কিনছিলেন। বিশেষ করে বাংলা একাডেমির স্টলে বিক্রি ছিল চোখে পড়ার মতো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মূল প্রকাশকদের স্টল। সঙ্গত কারণে এখানে বিক্রি আরও বেশি। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাকি বইগুলো চলে এলে বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা। ১২৫ নতুন বই ॥ দশম দিনেও মেলায় এসেছে বেশ কিছু নতুন বই। এদিন বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়া বইয়ের সংখ্যা ছিল ১২৫। এগুলোর মধ্যে গল্প ১৭, উপন্যাস ২৫, প্রবন্ধ ৭, কবিতা ৩৫, গবেষণা ১, ছড়া ১, জীবনী ৪, মুক্তিযুদ্ধ ৩, বিজ্ঞান ৪, শিশুসাহিত্য ২, ভ্রমণ ৫, ইতিহাস ৩, ধর্মীয় ২ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর ১৬টি রয়েছে। ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে এসেছে হাসান আজিজুল হকের ‘নির্বাচিত গল্প’, যতীন সরকারের ‘শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধ’, হায়াৎ মামুদের ‘অমর একুশে’। কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে বদরুদ্দীন উমরের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা, মোকাররম হোসেনের ‘জীবনের জন্য বৃক্ষ’ ও ‘বাংলাদেশের নদী’। অনন্যা থেকে এসেছে মহাদেব সাহার ‘ভুলে যাওয়ার চেয়ে ভাল কিছু নেই’, পরিতোষ বাড়ৈর ‘মায়ের চিঠি’। মাওলা ব্রাদার্স থেকে এসেছে সালেহ মাহমুদ রিয়াদের ‘বাঙলা ভাষা : শুদ্ধ শিখুন শুদ্ধ লিখুন’। আদর্শ থেকে এসেছে লোপা হোসেইনের ‘যে অন্ধত্বের নাম ভালোবাসা’। ইউপিএল থেকে এসেছে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘যথাশব্দ : বাংলা ভাষার প্রথম ভাব অভিধান’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘মাটি ও মানুষের উপাখ্যান।’ সময় থেকে এসেছে আনিসুল হকের ‘মায়ের কাছে যাবো’, ধ্রুব এষের ‘মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে। সরগরম নজরুল মঞ্চ ॥ মঙ্গলবার বিকেলে বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল ঘন উপস্থিতি। নজরুল মঞ্চে চলছিল নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আনুষ্ঠানিকতা। এখানে প্রায় সারাক্ষণই লেগে আছে প্রকাশনা উৎসব। এদিন নজরুল মঞ্চে ৬টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অন্বেষা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কুসুম সিকদারের ‘নীল ক্যাফের কবি’ বইটির মোড়ক উšে§াচন করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। একজনের বই। উপস্থিত ছিলেন ভক্ত সুহৃদরা। ফলে নজরুল মঞ্চে জটলা দৃশ্যমান হয়েছে পুরোটা সময়। বাংলা একাডেমির ই-তথ্য কেন্দ্র উদ্বোধন ॥ মঙ্গলবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমির ই-তথ্যকেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়। একাডেমির বর্ধমান হাউসে কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ড. মোঃ হাসান কবীর। ই-তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রন্থমেলার স্টলসমূহের অবস্থান, মেলার প্রতিদিনের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলী গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অতিদ্রুত সরবরাহের ব্যবস্থা করা যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নেতা ‘শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের নব্বইতম জন্মবর্ষ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ সামাদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম এবং ড. এম অহিদুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন কমরেড অজয় রায়। প্রাবন্ধিক বলেন, জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম নানা দিক থেকেই বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিলেন এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব। ছাত্রজীবন থেকে প্রজ্ঞা, মেধা এবং বাংলা ও বাঙালীর প্রতি অবিচল আস্থা ও অঙ্গীকার তাঁর রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ নজরুল ইসলাম পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আরও তিন নেতাসহ দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান কিন্তু এদেশের ইতিহাসের সরণিতে তাঁর কোন মৃত্যু নেই। আলোচকরা বলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাঁর সহযোদ্ধা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমাজরাষ্ট্রে ইহজাগতিকতার মূল্যবোধ ও জনকল্যাণকামী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করেছেন। আজকের বাস্তবতায় যখন মেধাশূন্যরা রাজনীতির মাঠ দখল করে নিচ্ছে তখন নজরুল ইসলামদের মতো প্রকৃত গুণী ও মানবদরদি রাজনীতিবিদের অভাব বিশেষ করে অনুভূত হয়। তাঁরা বলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমাদের ইতিহাসবিদ কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রায় কেউই এখন পর্যন্ত বিস্তারিত গবেষণা করেননি। বাংলা একাডেমি তাঁর জীবনী প্রকাশ করে এই মহান রাজনীতিবিদের জীবন ও কর্ম উত্তর প্রজন্মের কাছে শিক্ষনীয়ভাবে তুলে ধরতে পারে। সভাপতির বক্তব্যে কমরেড অজয় রায় বলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিক পাটাতন নির্মাতাদের একজন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের হাতে কারাভ্যন্তরে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় নেতাদের জীবনাদর্শ অনুসরণ করলে আমরা বর্তমান সঙ্কটময় সময়ে পথচলার দিকনির্দেশনা পেতে পারি। একই মঞ্চে সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দীপা খন্দকারের পরিচালনায় নৃত্য পরিবেশন করে দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী মহিউজ্জামান চৌধুরী, বুলবুল মহলানবীশ, শারমিন সাথী ইসলাম, স্বর্ণময়ী ম-ল, প্রদীপ কুমার নন্দী, মোঃ হারুন অর রশীদ এবং মোঃ এরফান হোসেন। আজকের অনুষ্ঠান ॥ আজ বুধবার বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জাতীয় নেতা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের নব্বইতম জন্মবর্ষ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ড. জিল্লুর রহমান খান, অধ্যাপক এমএম আকাশ, অধ্যাপক শাহীনুর রহমান, মেজর জেনারেল (অব) মোহাম্মদ আলী সিকদার ও সুভাষ সিংহ রায়। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ।
×