ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারীভাবে ঢাকা মেডিক্যাল ছাড়া কোথাও নেই পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট ॥ বরিশাল ও বগুড়াসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বার্ন ইউনিটই নেই

দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ॥ চিকিৎসা সুবিধা সীমিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ॥ চিকিৎসা সুবিধা সীমিত

নিখিল মানখিন ॥ সরকারীভাবে ঢাকা মেডিক্যাল ছাড়া দেশের কোথাও পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট নেই। বেসরকারীভাবেও অনেক জেলা-উপজেলা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চালু হয়নি বার্ন ইউনিট। রাজধানীতেও বেসরকারী উদ্যোগ সীমিত। জেলা পর্যায়ে বাধ্য হয়ে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে সাধারণ সার্জারি ইউনিটে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান অবরোধ-হরতালের পেট্রোলবোমায় দগ্ধদের চিকিৎসা সেবা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা । আগুনে দগ্ধ মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা। সরকারীভাবে সারাদেশে ৮টি বড় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ ১৩টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সেবা প্রদানের দাবি করা হলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। আইসিইউ ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় ওইসব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধদের ঢাকায় রেফার করতে হয়। অনেক রোগী পথের মধ্যে কিংবা ঢাকা পাঠাতে বিলম্ব হওয়ার কারণে মারা যাচ্ছেন। দগ্ধদের কেউ কেউ শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের নির্দেশনায় রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল, সোহ্রাওয়ার্দী মেডিক্যাল, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ফরিদপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আংশিকভাবে বার্ন ইউনিট চালু আছে। তবে ওইসব হাসপাতালে এখনও আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়নি। এ কারণে দগ্ধ হয়ে কেউ আহত হলে তাদের ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রেফার করা হয়। হরতাল-অবরোধে গানপাউডার ও পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। বর্তমানে দেশে ৫০ জন প্লাাস্টিক সার্জন রয়েছেন। এদের মধ্যে ১৬ জন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রয়েছেন। দেশে বর্তমানে দেড় হাজারের বেশি প্লাস্টিক সার্জন দরকার রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডাঃ মোহাম্মদ সামিউল ইসলাম জানান, দেশের সব মেডিক্যাল কলেজে পর্যায়ক্রমে বার্ন ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত থাকলেও প্রাথমিকভাবে বড় ৮টি মেডিক্যাল কলেজে বার্ন ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট এবং সোহ্রাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে ৩০ শয্যার বার্ন ইউনিট থাকলেও বাকিগুলোর কাজ চলছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশে বর্তমানে ১৪টি মেডিক্যাল কলেজে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট থাকলেও কারিগরিগত দিক থেকে সেগুলো ঢাকা মেডিক্যালের মতো উন্নত নয়। এছাড়া বরিশাল ও বগুড়াসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বার্ন ইউনিট নেই। আর বেসরকারী পর্যায়ে এ্যাপোলো, স্কয়ার, সিটি ও সেন্ট্রাল হাসপাতালে বার্ন রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের অবৈতনিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রতিবছর দেশে ৬ লাখ মানুষ আগুনে বা বৈদ্যতিক শকে দগ্ধ হয় এবং ৬ হাজার মানুষ মারা যায়। পোড়া সব রোগীর চিকিৎসা শুধু ঢামেকের বার্ন ইউনিটের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। সারাদেশে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে পৃথক বার্ন ইউনিট থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ॥ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিবছর রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ইউনিটটির সার্বিক অবকাঠামোর তেমন সক্ষমতা বাড়েনি। ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ সামাল দেয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা উত্তরণে ২০১৩ সালের ১২ নবেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বার্ন ইউনিটকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক সার্জারি পরিণত করার প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে এখনও কোন ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। এদিকে, পোড়া দেহের অসহ্য যন্ত্রণা ও ছটফটানি নিয়ে নির্ধারিত রোগীশয্যার তুলনায় তিনগুণের বেশি রোগী প্রতিদিন চিকিৎসাধীন থাকছে। বেঁচে থেকেও মৃত্যু-যন্ত্রণা উপশমের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেই পর্যাপ্ত জনবল। সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক, সেবিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই সামাল দিতে হয় অধিক সংখ্যক রোগীকে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হরতাল-অবরোধে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেখতে গিয়েছিলেন বার্ন ইউনিটে। সেই সময় পোড়া রোগীদের চিকিৎসার করুণ অবস্থা দেখে ৫০ বেডের বার্ন ইউনিটকে ১০০ বেডে উন্নীত করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গে জনবলসহ অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করারও ঘোষণা দেন। প্রতিদিন পোড়া রোগী আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। চাহিদার তুলনায় বার্ন ইউনিটের সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। এ অবস্থার মধ্যে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০০ বেডের বার্ন ইউনিটকে ৩০০ বেডে উন্নীত করার ব্যবস্থা করেন। ৩০০ বেডের বার্ন ইউনিট হলেও এর জনবল ১০০ বেডেরই থেকে যায়। ৩০০ বেডের এ বার্ন ইউনিটে প্রতিদিন চিকৎসাধীন রোগী থাকে ৫ শতাধিক। আর বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য আসেন ২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগী। নেই প্রয়োজনীয় নার্স, ওয়ার্ড বয়সহ প্রয়োজনীয় কর্মচারী। বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, এ ইউনিটে বর্তমানে ১৬ জন প্লাস্টিক সার্জন রয়েছেন। ১৩ জন ওএসডিতে মেড্যিাকল অফিসার ও ২৯ জন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী। নার্স আছে ৩০ জন। ঢাকা শিশু হাসপাতাল ॥ ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১২ শয্যার বার্ন ইউনিট রয়েছে। সেখানে দগ্ধ শিশুদের ভর্তি করানোর পরামর্শ দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ও নামমাত্র খরচে সেখানে দগ্ধ শিশুদের মানসম্মত চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মনজুর হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে ১২ শয্যার একটি বার্ন ইউনিট চালু রয়েছে। প্রতি বছর এখানে ৪শ’ থেকে ৫শ’ দগ্ধ শিশুদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। মিটফোর্ড হাসপাতাল ॥ হরতাল-অবরোধে নাশকতার প্রেক্ষাপটে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ১০ শয্যার নতুন একটি ওয়ার্ড চালু হয়েছে। ঢাকার এ হাসপাতালে একটি বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট থাকলেও এতদিন সেখানে শুধু প্লাস্টিক সার্জারি করা হতো। মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জাকির হাসান বলেন, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় জরুরী বিভাগের তৃতীয় তলায় এ ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। নতুন চালু এ ওয়ার্ডের জন্য একজন সহযোগী অধ্যাপক, তিনজন সহকারী রেজিস্ট্রারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জেও বার্ন ইউনিট ॥ আগুনে পোড়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে নারায়ণগঞ্জে দুটি হাসপাতালেও বার্ন ইউনিট চালু করা হয়েছে। নগরের খানপুর হাসপাতাল এবং নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে এ ইউনিট চালু করা হয় বলে জেলার সিভিল সার্জন দুলাল চন্দ্র চৌধুরী জানান। তিনি বলেন, সহিংসতায় আগুনে পোড়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে সরকারের নির্দেশে এসব ইউনিট খোলা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দু’জন শল্য চিকিৎসক ও দু’জন নার্স এ ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন। খানপুর ৩০০ শয্যার হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক শফিউল আজম জানান, সরকারীভাবে হাসপাতালে দগ্ধদের চিকিৎসার জন্য দু’টি শয্যা রাখার নির্দেশ থাকলেও তিনটি শয্যা রাখা হয়েছে। এ হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য দু’জন শল্যচিকিৎসক, একজন অর্থোপেডিক, রেজিস্ট্রার এবং দু’জন সহকারী, ছয়জন নার্স এবং তিন শিফটে তিনজন ওয়ার্ড বয় রাখা হয়েছে বলে শফিউল আজম জানান। সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতাল ॥ দগ্ধদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালের দোতলার সাত নম্বর ওয়ার্ডে আট শয্যার একটি পৃথক ইউনিট খোলা হয়েছে। বার্ন ইউনিটের পাঁচটি শয্যাও খালি করে রাখা হয়েছে। আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ কক্ষ, অটোক্লেভ কক্ষ, ড্রেসিং রুম থেকে শুরু করে সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসক, নার্স সবাইকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সোহ্রাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল বারী বলেন, ঢাকার বাইরে দুর্ঘটনায় কেউ দগ্ধ হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখান থেকে ঢাকা মেড্যিাকল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রোগীদের রেফার করা হয়। কিন্তু সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে সমৃদ্ধ বার্ন ইউনিট থাকার পরও রোগীদের রেফার করা হয় না। প্রচারের অভাবে চিকিৎসক এবং রোগীরা বিষয়টি জানেন না। এ কারণে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরও দগ্ধ রোগীরা এ হাসপাতালে আসছেন না। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ॥ সীমিত পরিসরে এখানে বার্ন ইউনিট চালু রয়েছে। আইসিইউ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, পর্যাপ্ত শয্যা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি-চিকিৎসা উপকরণ সঙ্কটসহ বহুমুখী সমস্যায় রয়েছে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (কুমেক) বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। এতে রোগীদের কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা দিতে সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ২০১২ সালের ২১ নবেম্বর কুমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের দ্বিতীয় তলায় এ ইউনিট চালু করা হয়। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ॥ এ হাসপাতালে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জন্য কোন বিশেষজ্ঞ নেই। সঙ্কট রয়েছে জনবলের। মাত্র ৬ জন ডাক্তার দিয়ে বার্ন ইউনিটের কার্যক্রম চালানো হয়। চিকিৎসক জানান, বার্নের জন্য যদি নির্ধারিত কোন ওয়ার্ড এবং স্টাফ থাকত, তবে ময়মনসিংহে সেবার মান আরও অনেক ভাল হতো। এখানে সার্জারি ওয়ার্ডের সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হয়। ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ॥ বছরে গড়ে ২শ’ থেকে ৩শ’ জন দগ্ধ মানুষ এ হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু স্বতন্ত্র বার্ন ইউনিট না থাকায় রোগীদের পাঠাতে হয় ঢাকায়। এতে দরিদ্র রোগী ও তাদের স্বজনদের পড়তে হয় দুর্ভোগে।
×