ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছে তো/যে-ভিৎ কখনো কোন রাজন্য পারেনি ভাঙতে’। ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বাঙালীর গর্বের অন্ত নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি উচ্চারণ করলে সেটা তখন আর সংখ্যাবাচকে সীমাবদ্ধ থাকে না। শুধু মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষার গূঢ় ব্যঞ্জনা অতিক্রম করে এর বিস্তার ঢের সুদূরপ্রসারী। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষের বুকের রুধির আর অবিরল অশ্রুপাতে সিক্ত। জাকির হোসেন সম্পাদিত ‘একুশের কবিতা সংকলন’ গ্রন্থে মাতৃভাষার প্রতি এভাবেই শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। বাংলাভাষা নিয়ে পাকিস্তানীদের চক্রান্ত শুরু হয় বহু আগে থেকেই। এর চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নজিরাবাজারের বাসায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যায়। প্রতিনিধি দল শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চায় সিএসপি পরীক্ষা থেকে বাংলা ভাষাকে কেন বাদ দেয়া হলো। এ নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের তুমুল বিতর্ক হয়। পরে মন্ত্রী প্রতিনিধি দলকে বলেন, এটা নিতান্তই ভুলবশত হয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (প্রথম খ-) গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পরীক্ষা থেকেও বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়ার চক্রান্ত শুরু হয়। ওই পরীক্ষা উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় নৌবাহিনীর পরীক্ষায় বাংলামাধ্যম বাদ দেয়ার বিষয়ে ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। পরে এ সম্পাদকীয় ১৯৪৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নওবেলাল’ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়। এরপর তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাসেম পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও নূরুল আমিনের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে রক্ষার আন্দোলনে শহীদদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ক্রোধের আগুনে সারাদেশ হয়ে ওঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা এক মাস ঢাকা শহরে সভা-মিছিল-সমাবেশের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। তমদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্টের আহ্বায়ক আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেন। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক সমাজ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাঁদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। প্রথমে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ওই ঘটনায় সরকারী হিসাবে চারজনের মৃত্যু হয়। শহরের বিভিন্ন অংশে একই ভাবে জানাজা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন কলেজ, ব্যাংকসহ অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এ মিছিলে অংশ নিতে আসেন। বিকেলে আরেকটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারপক্ষের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্র জুবিলী প্রেস এবং মর্নিং নিউজ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। জুবিলী প্রেস থেকে সকালের পত্রিকা বের হওয়ার সময় ছাত্র-জনতা আগুন লাগিয়ে দেয়। একই দিনে পুলিশ দ্বারা আক্রমণ ও হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল। ওই রাস্তায় অহিদুল্লাহ নামে নয় বছরের এক শিশুকেও হত্যা করে পাকি পুলিশ।
×