ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দগ্ধ ৪ যাত্রীর ২ জনই যন্ত্রণায় কাতর রংপুর মেডিক্যালে ॥ বার্ন ইউনিট রোগী ও স্বজনের আহাজারিতে ভারি

যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ॥ গাইবান্ধায় মৃত বেড়ে ৬

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ॥ গাইবান্ধায় মৃত বেড়ে ৬

স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে ॥ দগ্ধ রোগী আর স্বজনের আহাজারিতে শুক্রবার রাত থেকেই রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ভারি হয়ে ওঠে। শুক্রবার রাতে গাইবান্ধার তুলসীঘাটে পেট্রোলবোমায় পুড়ে ঘটনাস্থলেই ৪জন মৃত্যুর পর রংপুর মেডিক্যালে মারা গেছে মা সোনাবানু (৩০) আর ছেলে সুজন (১৩)। এ নিয়ে গাইবান্ধায় বাসে পেট্রোলবোমায় ৬ জনের মৃত্যু হলো। সুজনের বাবা তারা মিয়া (৩২) এবং তার ছোট বোন তানজিলাও দগ্ধ শরীর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয়নি তারা মিয়াকে। ডাক্তাররা অবশ্য বলছেন, দগ্ধ তারা মিয়া ও তানজিলা দু’জনেই আশঙ্কামুক্ত। নিজস্ব সংবাদদাতা গাইবান্ধা থেকে জানান, গাইবান্ধায় বার্ন ইউনিট না থাকায় দগ্ধ ৪০ জনের ২০ যাত্রীকে রংপুর মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীনরাও হাসপাতাল ছাড়ছেন। বিকেল পর্যন্ত গাইবান্ধা হাসপাতালে মাত্র দুজন চিকিৎসাধীন ছিল। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক হয়েছে ৯ জন। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি নিহত পরিবারকে দশ হাজার ও আহতদের ৫ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে। আরও সহায়তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তালিকা পাঠানো হয়েছে। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি ঢাকা থেকে কপ্টারযোগে গাইবান্ধায় আসেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি, বিভাগীয় কমিশনার দিলাওয়ার বখত, ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি হুমায়ুন কবির, ডিসি এহসান এলাহী, এসপি আশরাফুল ইসলাম। পরে সন্ত্রাসী নির্মূলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সার্কিট হাউসে তারা জরুরী সভায় বসেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। নাপু এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে (ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৪৮১০) গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সীচা পাঁচপীর থেকে ৭০ যাত্রী নিয়ে ঢাকা অভিমুখে রওনা দেয়। শুক্রবার রাত ১১টায় গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের তুলসীঘাট সংলগ্ন বুড়িঘর নামকস্থানে পৌঁছলে জামায়াত-শিবির দুর্বৃত্তরা ওই বাসে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে। এতে ১ শিশুসহ ৪ যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং ১ শিশু ও ১ জন নারী রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। গাইবান্ধা থেকে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নেভায় এবং আহতদের উদ্ধার করে গাইবান্ধা সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে আসে। গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ আবু হানিফ জানান, এই ঘটনায় দগ্ধ এক শিশুসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন- সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কালীর খামার গ্রামের খয়বর হোসেন দুলুর ছেলে সৈয়দ আলী (৪২), পশ্চিম চণ্ডীপুর গ্রামের সাইফ মিয়ার মেয়ে হালিমা বেওয়া (৪২), শাজাহান আলীর ছেলে সুমন মিয়া (২২), নাগের খামার গ্রামের বলরাম দাসের মেয়ে শিল্পী দাস (১০), রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যাওয়া মোহাম্মদ তারা মিয়ার ছেলে সুজন (১০) ও তার স্ত্রী সোনাভান (৩৫)। আবাসিক চিকিৎসক আরও জানান, আশঙ্কাজনক আহতদের মধ্যে রাতেই ১৮ জনকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় গাইবান্ধা সদর আধুনিক হাসপাতালে যাদের ভর্তি করা হয় তারা হচ্ছেন সুন্দরগঞ্জের উজান বোচাগাড়ি গ্রামের মতলব (৫০), সাজেদুল (৪০), লিয়াকত (৪৫), মঞ্জুরুল (২৮), আলম মিয়া (২৫), জোসনা (২২), চ-িপুর গ্রামের আশরাফুল (২৭), শফিউল (৩৪), সিরাজুল (২৫), সফিউল (৩৫), সাধনা (৩৫), ফারাজিপাড়া গ্রামের তারা মিয়া (৩৫), সীচা গ্রামের মাসুদ (২৪), কফিল উদ্দিন (৩৬), রহিম (২৬), তানজিনা (৫), রফিকুল (২৫), আমজাদ (২৮), জাহেদুল (৪০), তানজিলা (১৫), তাবিজ তোলা গ্রামের সাহেদুল (১৮), উত্তর সীচা গ্রামের রফিকুল (২৭), সাঘাটা উপজেলার উল্লা বাজার এলাকার জ্যোতি (১৮), ফুলছড়ি উপজেলার বরমতাইড় গ্রামের শহীদ (২৩), সদর উপজেলার মালিবাড়ি সরকারপাড়ার কাইছার (৪৩), ফকিরপাড়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদ (২৫), পলাশবাড়ি উপজেলার কুমিদপুর গ্রামের আমিনুল (২২), কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার পাত্ররখাতা গ্রামের জাফর আলী (৩৫), গোয়ানপাড়া গ্রামের বুলবুলি (২২), মমেনা (১৮), ইয়াজুল (৩৬), রংপুরের বদিউজ্জামান বিদ্যুৎ (২৪), রেজাউল (৩০), জাবের মিয়া (৩০), জুলি আকতার (১৮), আশরাফুল (২৫), সাজু মিয়া (২৫), সাইদুল (২৩) ও জাহাঙ্গীর (৩৫)। পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থলসহ গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কে র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহমেদ রাজিউর জানান, অবরোধকারীরা রাতের আঁধারে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী বাসটিতে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। স্টাফ রিপোর্টার রংপুর থেকে জানান, গাইবান্ধার পেট্রোলবোমার ওই ঘটনার পর শুক্রবার রাত অনুমান সাড়ে বারোটার পর থেকে কয়েক দফায় ২০ অগ্নিদগ্ধ রোগী আসেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আসে। এদের মধ্যে সুজন মারা যাবার পর বর্তমানে এক বিজিবি সদস্যসহ চিকিৎসাধীন ১৮ জন। এর মধ্যে ১৪ জন বার্ন ইউনিটে, দু’জন আইসিইউ এ এবং বাকি ১জন অর্থপেডিক্স বিভাগে। আইসিইউ এ থাকা গাইবান্ধার কুমরেরভিটা এলাকার আবুল কালাম আজাদ (৪০) এবং সাজু মিয়ার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিট প্রধান, সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মারুফুল ইসলাম। তিনি জানান, এসব রোগীর প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ শরীর পুড়ে যাওয়ায় তারা পুরোপুরি আশঙ্কাজনক। অন্য যারা আছেন তারা প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের অনেককেই বরণ করে নিতে হবে পঙ্গুত্ব। নামু এন্টারপ্রাইজ নামের ওই গাড়িতে থাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যাত্রী, যিনি একমাত্র অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তিনি জানান, উপর-নিচ মিলে ওই গাড়িতে অন্তত শতাধিক যাত্রী ছিল। অবরোধ বিরম্বড়ার কারণে তারা আড়াই শ’ টাকার একেকটি টিকেট ৫শ’ টাকা করে কিনেছেন। তিনি জানান, বাসের সিটের ৪ নম্বর সিরিয়ালের বামদিকে বসা ছিলেন তিনি। তার খানিকটা পেছনে ডানদিকের জানালায় আকস্মিক বেলুন ফোটার শব্দে ফোটে একটি যেন কী ! নিমিশেই পুরো গাড়িতে জ্বলে যায় আগুন। তিনি জানান, ঘটনার পর সকলেই দরজা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে দরজা বন্ধ থাকায় ব্যর্থ হন। এ সময় গাড়ির সামনের গ্লাস ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন অনেকেই। কিন্তু তার আগেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় চারটি প্রাণ। এ সময় অগ্নিদগ্ধ ও আহত হন অন্তত অর্ধশত মানুষ। অগ্নিদগ্ধ ২০ জনকে রাতেই নিয়ে আসা হয় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এখানে যারা আশঙ্কাজনক অবস্থায় যারা রয়েছেন তারা হলেন মোতালেব ও জাহাঙ্গীর। এছাড়া অন্যরা হলেনÑ বিজয়, কায়সার আলী, নজরুল, আবুল কালাম আজাদ, তারা মিয়া ও তার মেয়ে তানজিনা, আমিনুর, বদিউজ্জমান, মহ্জুরুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, বুলবুলি, জোসনা, সাইফুল ও রফিকুল। জানা গেছে, এদের অধিকাংশের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, কুড়িগ্রামের চিলমারী ও উলিপুর এলাকায়। এরা কমবেশি সকলেই শ্রমজীবী। সকালে অগ্নিদগ্ধদের দেখতে যান রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার দিলোয়ার বখত, বিজিবির উত্তর-পশ্চিম রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহফুজার রহমান, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবীর, র‌্যাব ১৩ রংপুর’র পরিচালক লে. কর্নেল হায়াৎ, জেলা প্রশাসক ফরিদ আহমেদ, রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ জাকির হোসেনসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসার জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা করা হয়। বার্ন ইউনিটের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মারুফুল ইসলাম জানান, বার্ন রোগীর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তারপরও চিকিৎসায় সরকারীভাবে যারপরনাই চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তারপরও তিনি চিকিৎসার জন্য দেশের বিত্তবান শ্রেণীর সহায়তা কামনা করেন।
×