ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিনা পয়সায় সেবা, গ্রামের মায়েদের পরম বন্ধু...

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিনা পয়সায় সেবা, গ্রামের মায়েদের পরম বন্ধু...

কামরুজ্জামান বাচ্চু ॥ ‘বাড়ির ওনা দক্ষিণ ধারে গো...ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো আমার দাইমা, দাইমা গো...।’ ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ‘রূপবান’ ছায়াছবিতে দাইমাকে নিয়ে রচিত এই গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। গল্পের প্রয়োজনেই পরিচালক ছবিতে ওই গানটি ট্যাগ করেছিলেন। ছবির কাহিনী বিন্যাসেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে একজন দাইমা। গানটি গ্রামীণ সংস্কৃতির গভীরে এতটাই গ্রোথিত যে, যাত্রা বা পালাগানে আজও এটি গীত হয়। আমাদের গ্রাম-বাংলায় দাইমা এখনও খুবই পরিচিত এবং প্রয়োজনীয় একটি বাস্তব চরিত্র। ঘরে ঘরে সন্তান প্রসবকালে প্রসূতি মায়ের পাশে এক বা একাধিক দাইমা লাগবেই। আসলে একজন ধাত্রী বা দাইমা যে কোনও গর্ভবতী মায়ের চরম দুঃসময়ের কা-ারী। তবে ধাত্রীগিরি অনেকের কাছেই পেশা নয় সেবা, মানবিকতাও। একজন গর্ভবতী মা বাড়িতে সন্তান প্রসবকালে আতুর ঘরে যে নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সমাজে তার পরিচয় দাইমা বা ধাইমা। ভূমিষ্ট হওয়ার পর সদ্যপ্রসূত শিশু ও যন্ত্রণাকাতর প্রসবিনী মাকে সেবা-শুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন যিনি তিনিই ধাইমা। এলাকাভেদে এঁদের ধাই বা দাই বলে। আবার অনেকে এঁদের ধাত্রী বলেও সম্বোধন করেন। আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় এই ধাত্রী বা ধাইমায়েরা যথেষ্ট সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। সন্তান প্রসবকালে প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং নবজাতক ও প্রসূতি মায়ের যতœ-আত্তি থেকে শুরু করে লালন-পালন ইত্যাদি কাজে সার্বক্ষণিক সঙ্গী এই নারীটিই আপৎকালে গ্রামের মা’য়েদের পরম বন্ধু হয়ে ওঠেন। তবে আজকাল অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত দাই বা ধাত্রী মেলা দুষ্কর। প্রসবকালে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ধাত্রী উপস্থিত না থাকলে মা ও শিশু উভয়ের জীবন আশঙ্কার মধ্যে থাকে। সুখের কথা যে, ইতিবাচক নানা কারণে কিছু বেসরকারী সংস্থা বা এনজিও আজকাল গ্রামে মহিলাদের ধাত্রীবিদ্যায় হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় এর ওপর কাজ করছে ‘সেøাব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংস্থা । এখানে এক হাজারের বেশি মায়ের সন্তান প্রসব করিয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ ধাত্রী মঞ্জু বেগম। বাউফলের দাশপাড়া গ্রামে তার বাড়ি । গত ২০ বছর ধরে তিনি ধাত্রীর কাজ করছেন। বলা যায় একদম বিনা পয়সায় এ কাজ করছেন তিনি। তবে কেউ যদি খুশি হয়ে তাকে কিছু দেন তা তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ২০ বছর ধাত্রীর কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি। অনেক মজার স্মৃতিও রয়েছে তার। এরমধ্যে একটি হচ্ছে, প্রায় ১৮ বছর আগে তার ননদের সন্তান প্রসবকালে ধাত্রী হিসাবে পাশে ছিলেন তিনি। একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয় ননদের। শিশুটির নাম রাখা হয় নাসরিন। মজার ব্যাপার সেই নাসরিনের সন্তান প্রসবকালেও ধাত্রী হিসাবে পাশে ছিলেন তিনিই। মঞ্জু বেগমের মতো বাউফলের প্রত্যেকটি গ্রামেই একজন করে ধাত্রী রয়েছে। যারা নিজ নিজ গ্রামে এ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নাম ও মোবাইল নম্বর রয়েছে গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরে। নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য তাদের ফোন করে ডেকে নেয়া হয়। তারাও গৃহস্থের ডাকে সাড়া দেন। দিন নেই, রাত নেই, যখন ডাক পড়ে তখনই তারা ছুটে যান সেই বাড়িতে। এ কাজ করতে করতে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভাল লাগা যোগ হয়েছে। শুধু সন্তান প্রসবকালীন সময়ই নয়, একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের খোঁজখবর নেয়া এবং তার শারীরিক সুবিধা-অসুবিধাগুলো আগে থেকেই তারা দেখাশুনা করে থাকেন। জটিল কোন সমস্যা মনে করলে সেই মাকে তারা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র অথবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ধাত্রী মঞ্জু বেগম আরও জানান, তিনি সেøাব বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের ধাত্রী কিটস-বক্স দেয়া হয়েছে। একটি কিটস-বক্সে হ্যান্ড গ্লোবস, ব্লেড, হ্যাক্সোসল, তুলা ও টাওয়ালেসহ ১৬ ধরনের সামগ্রী দেয়া হয়। খেজুরবাড়িয়া গ্রামের জাকিয়া বেগম নামের আরেক ধাত্রী জানান, কয়েক দিন আগে তিনিসহ ৩৬ জন ধাত্রী ‘সেøাব বাংলাদেশ’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রত্যেক মাসে একবার করে তাদের রিফ্রেসার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গ্রামের অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের আপৎকালীন বন্ধু তারা। নাজিরপুর ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের ধাত্রী হাসিনা বেগম জানান, একজন মায়ের সন্তান প্রসবের পর খুশি হয়ে নগদ টাকা, শাড়ি, তেল ও সাবান উপহার হিসাবে তাদের দেয়া হয়। তারা কারও কাছ থেকে চেয়ে কোনও কিছু গ্রহণ করেন না। তারা এ কাজটিকে সেবা হিসাবেই মনে করেন। কোনও প্রকার বিনিময় ছাড়াই তিনি এ পর্যন্ত আড়াই শতাধিক মায়ের প্রসবকালে পাশে ছিলেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ গরিব মা। এ ব্যাপারে সেøাব বাংলাদেশ বাউফল উপজেলার প্রকল্প ব্যবস্থাপক (হেলথ এ্যান্ড স্যানিটেশন) দেলোয়ার হোসেন বলেন, তারা ১৯৯৭ সাল থেকে বাউফলে কাজ করছেন। এখানে তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে হেলথ এ্যান্ড স্যানিটেশন অন্যতম। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা ধাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। একজন মা যাতে নির্ভয়ে-নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পারেন, এ জন্য তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
×