ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের পাঠ

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের পাঠ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের তিনটি পাঠ আছে। প্রথম পাঠ আওয়ামী লীগ ও মধ্যপন্থী বাম জনগণের। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালে এবং এই মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয় ১৯৭১। এই যুদ্ধ একই সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক ও সশস্ত্র পন্থায় পরিচালিত হয়। যুদ্ধের নেতৃত্ব আগাগোড়াই রাজনৈতিক, এই যুদ্ধের লক্ষ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বে নির্দিষ্ট হয়। লক্ষ্য পাকিস্তানের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই যুদ্ধ থেকে নির্মিত হয় ১৯৪৭ সাল থেকে, আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ। কলোনির শোষণের বাস্তবতা থেকে নির্মিত হয়ে এই জাতীয়তাবাদ একটি জাতীয় ঐক্যবোধ তৈরি করে। এই ঐক্যবোধের মধ্যে নিবন্ধিত হয় বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতা, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আঞ্চলিক দূরত্ব। শোষণের বাস্তবতা এই জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে এবং কলোনির শোষণের বাস্তবতামুক্ত একটি শোষণহীন, সাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন, আঞ্চলিক দূরত্ব লোপকারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, অর্থনীতি, মতাদর্শ গড়ে ওঠে। এই যুদ্ধের নিয়মতান্ত্রিক পন্থার সঙ্গে যুক্ত হয় সারাদেশের অধিকাংশ জনসমষ্টি। এই জাতীয়তাবাদে প্রবিষ্ট গণআন্দোলন ও গণযুদ্ধ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কলোনির বাংলাদেশের সকল আন্দোলন চরিত্রের দিক থেকে গণআন্দোলন। ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চরিত্রের দিক থেকে গণযুদ্ধ। দ্বিতীয় পাঠ বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ও তাদের অনুসারী দলগুলোর। এই পাঠে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি হয় ১৯৭১, নেতৃত্ব সামরিক বাহিনীর। রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপেক্ষিত এবং সামরিক নেতৃত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক নেতৃত্বের ওপর জোর দেয়ার দরুন পাকিস্তানের কলোনিকালে, সাবেক পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তানের অধঃস্তন অবস্থান সম্বন্ধে এই পাঠে কোন বক্তব্য নেই। অপরপক্ষে সামরিক নেতৃত্বের ওপর জোর দেয়ার দরুন যুদ্ধের নয় মাস কেন্দ্রিক পরিসর থেকে সামরিক নেতৃত্বের বৈধতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিপরীতে তৈরি করা হয়। এই বৈধতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় যুদ্ধপরবর্তীকালে সামরিক বাহিনীর দুটি ক্যুর মাধ্যমে। ক্যুর অর্থ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মাধ্যম নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিকতা নয় বরং সশস্ত্রতা। সশস্ত্রতার প্রয়োজনকে বৈধতা দেয়া হয় সংবিধান সংশোধন করে এবং সাধারণ মানুষের নির্বাচনভিত্তিক সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান করে নির্মাণ করা হয় বাস্তব প্রয়োজনভিত্তিক সশস্ত্রতার সার্বভৌমত্ব। এই সার্বভৌমত্বের কর্তৃত্ব সামরিক বাহিনী/সামরিক নেতৃত্বের এবং এই সার্বভৌমত্বের রাজনৈতিকতার ভিত্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজ। সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই বাস্তব প্রয়োজন থেকে নির্মিত হয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র ভিত্তি মূল মুসলমান সমাজ, অন্যান্য সমাজের (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান) অবস্থান এই জাতীয়তাবাদে অধঃস্তন এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বিকাশের বোধ এই জাতীয়তাবাদে নেই। তৃতীয় পাঠ জামায়াতে ইসলামের। এই পাঠে মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকৃত, পাকিস্তান আন্দোলনকে নিগেট করার জন্য এই যুদ্ধের সূত্রপাত। এই যুদ্ধ ভারত ও প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ ন্যূনতম। এই বোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিচার করার দরুন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের কাছে ভারতের সেবাদাস এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র সমর্থন বৈধ। পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সংঘর্ষ (যুদ্ধ নয়) মূলত একই আদর্শে বিশ্বাসী জনসমষ্টির ‘ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব’। এই ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব অপনোদনের দায়িত্ব জামায়াতের এবং এই ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব অপনোদন সময়সাপেক্ষ। ইসলামী মতাদর্শ শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাবের উজ্জীবন করার মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ও সমস্যার নিরসন করা সম্ভব। জামায়াত এই অর্থে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিগেট করে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৎপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মিল আছে। অন্যপক্ষে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠ একত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পাঠের বিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সত্যের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে এবং এই বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে প্রথম পাঠ রাজনৈতিক মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। প্রথম পাঠে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এবং পরবর্তী সময়কালে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যারা ক্ষমতায় আসীন, যারা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিরুদ্ধে (পাকিস্তানী শাসক ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমাজ নির্যাতনকারী) সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেছে, যেসব জুলুম হয়েছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালক ও প্রশাসকদের সঙ্গে সমমর্যাদার রাষ্ট্রের পাবলিক স্পেসে নিজেদের স্বীকৃতি রেখেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত সময়কালে পূর্ববাংলার কৃষক জনসমষ্টি পাকিস্তান রাষ্ট্র, একই সঙ্গে বাঙালী স্থানীয় জমিদার-জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছে, ১৯৫২ সালে ভাষার মর্যাদার দাবিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র পরিচালকদের ক্ষেত্রে সমঅধিকার উত্থাপন করেছে, ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত সময়কালে পূর্ববাংলার জনসমষ্টি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়ায় যে বহির্ভূততা তৈরি হয়েছে তার বিরুদ্ধে দুই দেশ অর্থাৎ দুই অর্থনীতির দাবি তুলেছে, পূর্ববাংলার জনসমষ্টি দুই দেশের দাবিতে ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থান করেছে আইয়ুব শাসনের সামরিকতা ক্লায়েন্ট রাজনীতি, পূর্ববাংলার সামগ্রিক অধঃস্তনতা ও পূর্ববাংলার অভ্যন্তরীণ মহাজন-জোতদার-মৌলিক গণতন্ত্রী চোর, বদমাস, ডাকাতদের বিরুদ্ধে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত সকল ক্রোধ, সকল বিদ্রোহ, সকল সশস্ত্রতা নিয়ে সাধারণ মানুষ ১৯৭১ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ ও অসহযোগের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা, যে রাষ্ট্রকে আক্রমণ করেছে পাকিস্তান ২৫ মার্চে, ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালে এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে রক্ষা বাংলাদেশের সকল মানুষ পেট্রিয়াটিক যুদ্ধ করেছে রাজনৈতিক নেতৃত্বে : এই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পাঠের অন্তঃসার। এই ধারাবাহিকতা, আখ্যানের কেন্দ্রে সাধারণ মানুষের অবস্থান প্রত্যাখ্যান করে তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠ। সাধারণ মানুষের মুক্তির রাজনীতি দ্বিতীয় পাঠে পর্যবসিত হয়েছে সামরিকতার প্রাধান্যে ও তৃতীয় পাঠ পর্যবসিত হয়েছে গণহত্যার তা-বে। প্রথম পাঠে রাজনীতি ও গণতন্ত্র সমার্থক, দ্বিতীয় পাঠে গণতন্ত্র অন্তর্হিত এবং সামরিক সশস্ত্রতা কেন্দ্রীয় আখ্যান। তৃতীয় পাঠে গণতন্ত্রহীন সামরিক সশস্ত্রতা কেন্দ্রীয় আখ্যান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠে গণতন্ত্রবিরোধী অ-রাজনৈতিক রাজনীতির সূত্রপাত। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পাঠের কেন্দ্রে সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পাঠের কেন্দ্রে সামরিক বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় পাঠের কেন্দ্রে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও জামায়াতের নির্দেশনায় গণহত্যার বৈধতা তৈরির যুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান ও অন্তঃসার বোঝার জন্য আমাদের প্রথম পাঠ উত্থিত সত্যের কাছে পৌঁছতে হবে বার বার। জামায়াত ও বিএনপির মুঠি থেকে মুক্তিযুদ্ধকে উদ্ধার করা জরুরী : পেট্রোলবোমা ও মুক্তিযুদ্ধের সহঅবস্থান সম্ভব না, খালেদা জিয়ার পেট্রোলবোমা কদর্য ও কদর্য ও কদর্য : মানুষ বিরোধী। লেখক : কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ
×