ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অস্থির সময়ে সম্ভাবনার প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হলো কবিতা উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অস্থির সময়ে সম্ভাবনার প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হলো কবিতা উৎসব

মনোয়ার হোসেন ॥ একই অঙ্গে সত্য ও সত্তাকে ধারণ করে কবিতা। শব্দের পিঠে শব্দের সংযোজনে উচ্চারিত হয় বহুবিধ বিষয়। সে শব্দমালায় থাকে দ্রোহ, প্রেম, মানবতার কথা কিংবা সময়ের দিনলিপি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে হাতিয়ার হয়েছে কবিতা। তাই নিছক ভাললাগা নয়, সময়ের দাবিও ধ্বনিত হয় কাব্যের শরীরে। সেই সঙ্গে সঙ্কটের সূত্র ধরে বিবৃত হয় স্বপ্নমাখা সম্ভাবনার পথরেখা। আর চলমান অস্থির সময়ে সম্ভাবনার প্রত্যাশায় শুরু হলো জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৫। জাগো সম্ভাবনায় জাগো কবিতায় সেøাগানে উৎসবের সূচনা হলো রবিবার। উৎসবে কলুষতা ও পাশবিকতাকে দূরে ঠেলে সৃজনশীল মানবিক বোধ জাগ্রত করার প্রত্যয় ধ্বনিত হলো কখনও কবিতায়, কখনও বা কথায়। কবি ও কবিতাপ্রেমীরা সহমর্মিতার বাণী নিয়ে শান্তিপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার করলেন। এসেছে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর মশাল জ্বালিয়ে অশুভকে সরিয়ে শুভকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে শীতের সকালে বসে দুই দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে প্রথম এ উৎসবের আয়োজন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ। এবারের ২৯তম উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। আর ২০১৪ সালের জাতীয় কবিতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কবি মোহাম্মদ রফিক। উৎসবের সমাপনী দিন আজ সোমবার তাঁর হাতে তুলে দেয়া হবে এই পুরস্কার। দুই দিনের উৎসবে দেশের কবিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও ইকুয়েডরের কবি ও লেখকবৃন্দ। রয়েছে নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বরচিত কবিতা পড়ার অবারিত সুযোগ। প্রথম দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন পর্বে দেশ-বিদেশের প্রায় ২০০ কবি পাঠ করেছেন স্বরচিত কবিতা। সূচনা দিনে কবিতা পাঠের পাঁচটি অধিবেশনের সঙ্গে ছিল আবৃত্তিপর্ব। দুই দিনের আয়োজনে সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠের সঙ্গে উৎসবে বৈচিত্র্য দিয়েছে খ্যাতিমান বাকশিল্পীদের আবৃত্তি, কবিতার গান, একাধিক সেমিনার, প্রদর্শনী ও দেশের ভিন্নভাষী কবিদের নিয়ে ‘অন্য ভাষার কবিতা’ শিরোনামের পৃথক অধিবেশন। খ্যাতিমান কবিসহ নানা বয়সী কবিতাপ্রেমীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে দারুণ সরব ছিল প্রথম দিনের উৎসব প্রাঙ্গণ। সকাল দশটায় শুরু হয় উৎসব কার্যক্রম। গ্রন্থাগার চত্বর থেকে বের হওয়া অনাড়ম্বর শোভাযাত্রাটি গিয়ে থামে চারুকলা সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিসৌধে। সেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসানের সমাধিতে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। এরপর শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সকল শহীদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্পণ করা হয় পুষ্পস্তবক। সকাল ১১টায় শুরু হয় উৎসবের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। শিল্পীদের কণ্ঠে উঠে আসে জাতীয় সঙ্গীতের সুর। সেই সুরের তালে তালে উত্তোলন করা হয় জাতীয় ও উৎসব পতাকা। এরপর সারি বেঁধে মঞ্চে থাকা বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শোনান একুশের গান ও উৎসব সঙ্গীত ‘জাগো কবিতায় জাগো-ও-ও-ও, জাগো সম্ভাবনায়’। গান শেষে বিগত বছরের শুরু থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের শিল্প-সাহিত্যসহ নানা অঙ্গনের প্রয়াত কৃতীদের স্মরণে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন কবি কাজী রোজী। শোকগাথায় উচ্চারিত হয় ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল ইসলাম, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক সালাহ্্উদ্দীন আহমেদসহ অনেক কীর্তিমানের নাম। একইসঙ্গে স্মরণ করা হয় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতদের। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। উৎসব উদ্বোধন করেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। পরিষদের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন উৎসবের আহ্বায়ক কবি মুহাম্মদ সামাদ, যুগ্ম আহ্বায়ক তারিক সুজাত ও পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আসলাম সানী। জাগো সম্ভাবনায়, জাগো কবিতায় শীর্ষক উৎসব ঘোষণাপত্র পাঠ করেন পরিষদের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। অকল্যাণকে থামিয়ে সম্ভাবনা ও মঙ্গলময়তার পথে ধাবিত হওয়ার আহ্বানে তিনি বলেন, আজ স্বদেশে ও স্ববিশ্বে অমিত সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য যুদ্ধ, বৈরিতা, হানাহানি ও ধ্বংসের যে অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা চলছে, তাকে নির্মূল করতে না পারলে স্তব্ধ হবে মানবতা, মানব-সভ্যতা ও মানব-সম্ভাবনা। তাকে ঠেকাতে হলে প্রতিটি মানবচিত্তে জাগাতে হবে কবিতার সম্ভাবনা। শোধিত করতে হবে চিত্তের সকল কলুষতা, সকল পাশবিকতা। কলুষিত চিত্তের আসলে অমানুষ। শোধিত ও মঙ্গলচিত্তের মানুষই আসল মানুষ, শ্রেষ্ঠ মানুষ। জয় হোক কবিতার, জয় হোক মানবতার, জয় হোক বিশ্বমানবের সৃষ্টিশীল সম্ভাবনার। উদ্বোধনী বক্তব্যে কবিতা উৎসবের সেই সূচনা সময়ের উল্লেখ করে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ২৮ বছর আগে অস্থির এক রাজনৈতিক সময়ে আমরা কবিরা এক হয়েছিলাম। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজনীতির সঙ্গে শিল্পের সংযোগ ঘটিয়ে শুরু হয়েছিল জাতীয় কবিতা উৎসব। এরপর থেকে বারবারই আমাদের জাগ্রত হতে হচ্ছে। চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সময় এসেছে প্রতিরোধ রচনার। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে চলছে নৈরাজ্য। ঘুরেফিরে যেন বাংলাদেশকেই হত্যা চেষ্টা চলছে। অথচ এই মাটিতে মিশে আছে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার রক্ত। সব মিলিয়ে যেন সত্য ক্রমাগত বিতাড়িত হচ্ছে। আর সত্যের শেষ আশ্রয় হচ্ছে শিল্প। কবিতাই হবে শিল্পের সেই হাতিয়ার। আদিকালেও যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য কবিতার ব্যবহার হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নজরুলের ‘বল বীর’ পড়ে কে না জাগ্রত হয়েছে। যুগে যুগে শতাব্দীতে শতাব্দীতে আমরা শব্দের শক্তি দেখেছি। সেই শক্তির সম্ভাবনায় আমরা জাগতে চাই। সভাপতির বক্তব্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, উৎসবের এ বছরের মর্মবাণী যেন আগামী দিনগুলোকে স্বপ্নবাস্তবতায় পূর্ণ করার অভিপ্রায়। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে শুরু হয় কবিতা পাঠের প্রথম পর্ব। স্বরচিত কবিতা পাঠের এ আসরে আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথিদের মধ্যে অংশ নেন ভারতের কবি আশিস সান্যাল, বীথি চট্টোপাধ্যায় ও সুবোধ সরকার, ডেনমার্কের সিন্ডি লিন ব্রাউন, সুইডেনের কবি পিটার নেইবার্গ, বেলজিয়ামের কবি জার্মেইন ড্রুগেনব্রুট, ইকুয়েডরের মারিয়া ব্যারেরা ও সুইজারল্যান্ডের টোবিয়াস বিয়ানকোন। আজ সোমবার উৎসবের সমাপনী দিনের কার্যক্রম শুরু হবে বেলা ১১টায়। এদিন ‘নতুন কবিতা : যুগান্তরের আহ্বান’ ও ‘বাংলাদেশের কবিতা : ভাবরূপের পালাবদল’ শিরোনামের দুটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। বিকেলে কবি মোহাম্মদ রফিককে প্রদান করা হবে গত বছরের জাতীয় কবিতা পুরস্কার। আর সকাল থেকে রাত চলমান উৎসবে কবিতা পাঠের সঙ্গে থাকবে কবিতার গান শীর্ষক বৈচিত্র্যময় আয়োজন।
×