ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শ্রমবাজার হারানোর শঙ্কা, তবু থামছে না মানবপাচার

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

শ্রমবাজার হারানোর শঙ্কা, তবু থামছে না মানবপাচার

ফিরোজ মান্না ॥ মানব পাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে। অবৈধ পথে দেশান্তরী হতে গিয়ে সাগরে ডুবে অনেকে মারাও যাচ্ছেন। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার বনজঙ্গলে দিনের পর দিন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। মানব পাচার রোধে দেশে কঠোর আইন থাকলেও পাচারকারীরা আইনের পরোয়া করছে না। বিপজ্জনক পথে পাচার হতে গিয়ে অনেকে মারা পড়ছেন, কেউ কেউ বিদেশ বিভূঁইয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হয়ে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। মালয়েশিয়াতেও ট্রলারযোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাচার হচ্ছে। পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে প্রতিনিয়ত নিরীহ অনেক মানুষ পুলিশের হাতে আটক হয়। কিন্তু পাচারকারীর কেউ গ্রেফতার হয় না। অভিযোগ উঠেছে, পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে রয়েছে। এ কারণেই পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মানব পাচার বন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে। মানব পাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশিরভাগ মানব পাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। একশ্রেণীর দালালের মাধ্যমে তারা বেশি বেতনে চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখানে থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব-সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। ‘ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এ্যাডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এ্যাগেনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিসহ। পাচারকারীরা দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। মানব পাচার নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেন, চাকরির নামে পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানব পাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সর্বজনীন আইন প্রণয়ন করা জরুরী। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও এর বেশিরভাগের কোন কার্যক্রম নেই। এ ছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান না করা, আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচারপ্রাপ্তি ক্রমেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের নাজুক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা অসঙ্গতি মানব পাচার প্রতিরোধের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাচাররোধে অপরাধীর শাস্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে চলছে প্রচলিত আইনে পাচারের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হওয়ার বিষয়টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নানামুখী পদক্ষেপে মানব পাচার অনেকটা কমে গেছে। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি মহিলা পাচারের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৫৪৪-৫৪২ জনকে তাদের পরিবারের কাছে এবং দ’ুজনকে একটি এনজিও ও একটি সরকারী সেফ হোমে রাখা হয়েছে। পাচারের এসব ঘটনায় ৪৮৯ মামলায় এক হাজার ৫১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করেছে ৭৮৮ জনকে। একই সময়ে ৫৮১ শিশু পাচারের শিকার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ৪৫৫। এর মধ্যে ৪৫৪ জনকে তাদের পরিবারের কাছে এবং একজনকে সরকারী সেফ হোমে রাখা হয়েছে। পাচারের এসব ঘটনায় ৩০১ মামলায় ১০০১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই হিসাব পুলিশের। বাস্তবে এই সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ পাচার হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হযেছে, মানব পাচার বন্ধে তারা আন্তরিক। মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা মানব পাচার কেন হচ্ছে এবং বন্ধে করণীয় চিহ্নিত করে মানব পাচার বন্ধের জন্য কাজ করা হচ্ছে। মানব পাচারকারীদের ধরতেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তালিকা তৈরি করেছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও বিজিবির সমন্বয়ে এই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
×