ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা জব্বার

বাংলাদেশকে আর জ্বলতে দেয়া যায় না

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাংলাদেশকে আর জ্বলতে দেয়া যায় না

এই কলামে আমি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়েই লিখছিলাম। বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার বিষয়ে পরপর ৮ সপ্তাহ আমরা এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করছিলাম। ডিজিটাল বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগের দুটি নির্বাচনী ইশতেহার, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয়- এসব প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আরও অনেক আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার তিনটি প্রধান কৌশলের মাঝে মাত্র একটি এতে আলোচিত হয়েছে। বাকি দুটি নিয়ে কোন কথাই হয়নি। আজকেও সেই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করব ভাবছিলাম। কিন্তু যখন এই লেখাটি তৈরি করি তখন পুরো দেশের ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থী চরম অনিশ্চয়তার মাঝে সময় গুনছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত প্রায় এক কোটি মানুষ রাতে ঘুমাতে পারে না। আপনারা যখন এই লেখাটি পাঠ করছেন তখন বিষ (পাঠক ভাববেন না আমি কুড়ি বা বিশ বানান জানি না। আমি ইচ্ছে করেই শ-এর বদলে ষ দিয়ে বিষ লিখেছি-কারণ কুড়িটি দলের এই জোট পুরো দেশের গলায় বিষই ঢেলে দিয়েছে।) দলীয় জোটের ডাকে ৭২ ঘণ্টার হরতাল চলছে। হরতালের মাঝেই হয়ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নেবে কি নেবে না সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কোন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল এমন চরম অবস্থা তৈরি করতে পারে সেটি ভাবাও কষ্টকর। ইতোপূর্বে এই জোট এস্তেমার দুই পর্বে আসা কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করছে। এমনকি বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র কোকোর লাশ আনা, জানাজা দেয়া বা দাফন করার জন্যও অবরোধ তুলেনি। দেশের কৃষক আহাজারি করছে। খেতের সব্জি খেতে শুকাচ্ছে। খামারের দুধ দূর্বাঘাসে ঢালতে হচ্ছে। ধানের দাম ১৫ টাকায় নেমে এসেছে। পণ্যবাহী যানবাহনের অর্ধেকও রাস্তায় নামতে পরছে না। এরই মাঝে দেশের ৪০-এরও অধিক মানুষ খুন হয়েছে। শত শত মানুষ বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে। এদের যে কেউ যে কোন সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। শত শত যানবাহন পুড়েছে-ভাঙচুর হয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষদের পুড়িয়ে মারার এই কুৎসিত কর্মকা-ের মাঝে ন্যূনতম প্রতিবাদ যদি আমরা না করি তবে সেটি নিজের কাছেই মহাঅপরাধ হবে বলে আমি মনে করি। আমার আকুল আবেদন রাজনীতির নামে বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করার হীন প্রচেষ্টা বন্ধ করা হোক। যারা এই্ কাজটি করছে তারা কোনভাবেই বাংলাদেশের নাগরিক থাকতে পারে না, দেশের জন্য রাজনীতি করা তো দূরের কথা। সরকারও এ বিষয়ে নীরব থাকতে পারে না। আক্রমণ করলে গুলি করব বা ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দেব এসব ঘোষণা আর আমাদের শান্ত রাখতে পারে না। দিনে দিনে মৃত্যুর মিছিল বড়ই হচ্ছে। কবে সেটি থামবে, সেটি অন্তত কোন সাধারণ মানুষ জানে না। দুনিয়া কেবল জানে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁর জন্য উন্নত দেশের বিবৃতি দেখেছি আমরা। কিন্তু আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া বা রাজনীতিতে যুক্ত না থাকা সাধারণ মানুষগুলোর জন্য একটু ওহ শব্দও কোন দেশ থেকে আসেনি। নিজের দেশের সুশীলরাও মুখে তালা মেরে রেখেছে। কোন এক কুলাঙ্গার টেলিভিশনে প্রকাশ্যে বলেছে, দেশের জন্য নাকি এমন কিছু ক্ষতি হয়েই থাকে। সরকার তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মানুষ মারার পক্ষে কথা বলে যদি কেউ আইনের উর্ধে থাকতে পারে তবে দেশে আইন থেকে লাভ কি? এই অভাগা দেশে একই রাজনৈতিক ইস্যুতে ২০১৩ সালে ১৯৩ জনের জীবন গেছে। এসব মৃত্যুরও কোন প্রতিবাদ হয়নি। অপরাধীদের বিচার হয়নি বা সেই প্রসঙ্গ আলোচনায়ও আসে না। যারা এই অপরাধের অপরাধী সেই রাজনীতিকরা এসব ব্যাপারে কথা বলেন না। মনে হচ্ছে সরকারও এসব বিষয়ে নীরব। যাদের নির্দেশে এই খুনগুলো হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোন ব্যবস্থাও নেয়নি। নেবে তেমন কোন লক্ষ্মণও দেখি না। প্রতিক্রিয়া রয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে বিষয়গুলো রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে। অথচ দেশের রাজনীতি-টিভি-পত্রিকা বা সরকার কোথাও একজন সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলনও আমরা দেখছি না। ফেসবুকের এমনি একটি পোস্ট পড়ছিলাম শুক্রবার, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫। পোস্টটি একটু বড়। নাম, “এসএমএস পেয়ে”। এতে লেখিকার বিবরণ আছে এভাবে, “কাজ থেকে ফিরেছি সন্ধ্যেবেলা, আমাকে অবাক করে আই ফোন থ্রি মেসেজ টোন বেজে উঠল, বাংলাদেশ থেকে মেসেজ এসেছে, মিঠু এখনই তোর সাথে একটু কথা বলা দরকার। আমি যুগপৎ উৎকণ্ঠিত এবং উচ্ছ্বসিত হলাম। উৎকণ্ঠা মেজদার কাছ থেকে এমন মেসেজ পেয়ে, উচ্ছ্বাস আই ফোনে ইন্টারন্যাশনাল মেসেজ পেয়ে। মেজদাকে কল দিলাম, ফোন ধরে মেজদা বলল, মিঠু, জানিসই তো, অবরোধে এখন ঢাকাতে গাড়িতে আগুন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অনেক অগ্নিদগ্ধ মানুষ, সবাই গরিব, ওদের পরিবারের স্বজনদের দেখে আমার বুকটা ভেঙ্গে যায়। আমার খুব ইচ্ছা, ওদের সবার হাতে যদি এক বেলা খাবার কেনার টাকাও দিতে পারি, তাহলেও মানুষগুলোর পেটে তো কিছু পড়বে। তুইও কি আমার সাথে যোগ দিবি? আর শোন, আমার কাছে দেড় বছর আগে মৌটুসী কিছু টাকা পাঠাইছিল গরিবদের সাহায্য করার জন্য, আমি সেই টাকা থেকে কিছু টাকা সাহায্য দিছি, বাকি টাকাটা কি এই অগ্নিদগ্ধদের পরিবারকে দিতে পারব? বললাম, মেজদা তোমার আর আমার দেয়া দুই চার শ‘ টাকায় ওদের তো কিছুই হবে না, ওদের দরকার অনেক বড় ধরনের সাহায্য, সরকারী সাহায্য। -মিঠু শোন, আমরা তো নাম কামানোর জন্য কিছুই করি না, তুই তো এমন অনেককেই টুকটাক সাহায্য করিস, এইটাও কর, গতকাল মেডিক্যাল কলেজে গেছিলাম, চোখ ফেটে জল আসে, হয়ত আমাদের মতো দুই একজন ছাপোষা মানুষ ওদের হাতে দুই পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে যায়, -মেজদা তুমি অবশ্যই দিবে, মৌটুসীর টাকাটাও দিয়ে দিও, মৌটুসীকে জিজ্ঞেস করার দরকার নাই, টাকার পরিমাণ বড় কথা না, দুঃসময়ে অচেনা কেউ পাশে এসে দাঁড়ালে বুকে ভরসা জাগে। তুমি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ওদের আহাজারি দেখে আসছো, ১৫,০০০ মাইল দূরে বইসা আমিও ওদের আহাজারি শুনতে আছি। একটুও শান্তি লাগে না মনে। আমার যদি অনেক টাকা থাকত, আমি কত দুস্থকে সাহায্য করতে পারতাম, ভগবান আমাদের সেদিক থেকে মেরে রেখেছে। ভাল কিছু কাজ করে যেতে পারলাম না। -মিঠু, অনেক ডর করে, প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করি, আমারও তো এই অবস্থায় পড়তে হইতে পারে। -মেজদা, ভয় পাইওনা, সবই আমাদের কপাল। দুই দিন ধরে রিয়াজ রহমানকে নিয়ে বড় বড় মানুষের যে আহাজারি চলছে ফেসবুকে, এইসব গরিবদের নিয়ে তোমার আমার মত কিছু ডরপুক মানুষ কাইন্দা মরতেছে। - এসব নিয়া ভেবে লাভ নাই রে বইন, খুব খারাপ আছি, বড় বড় মানুষরা বড় বড় মানুষের খোঁজ নিবে, ছোটরা ছোটদের। খুব খারাপ আছি, এবার ফোন রেখে দে। দেখি, আজ বা কালের মধ্যেই মেডিক্যাল কলেজে আবার যাব। তুই বেশি চিন্তা করিস না।” পোস্টটির রচয়িতা রিতা রায় মিঠু, কলম্বাস, মিসিসিপিতে থাকেন। তাঁর পরিচিতিতে বলা আছে যে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। পরের বেশ কটি পোস্ট পড়ে জানা গেল যে, তিনি নারায়ণগঞ্জের মেয়ে। ভাই-বোনের ব্যক্তিগত এই আলাপচারিতা বস্তুত বাংলাদেশের মানুষের আর্তনাদের প্রকাশ। বিদেশে থাকলেও বস্তুত নিয়মিতভাবে দেশের বিষয়াদি নিয়ে লেখালেখি করেন। আমরা যারা দেশের বিগত ৫০ বছরের রাজনৈতিক বিবর্তনের খবর রাখি তারা স্মরণ করতে পারি যে, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে এভাবে মানুষ মারার সংস্কৃতিটা একেবারেই নতুন। এক সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে মানুষ মারা যাবার মানেই ছিল পুলিশ, বিডিআর বা সেনাবাহিনীর হাতে মারা যাওয়া। সেই ৬২, ৬৬, ৬৯ বা তার পরের সময়কালেরও বিষয়টি ছিল যে আইন শৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণকে দমন করার চেষ্টা করত আর তাতে সাধারণ মানুষ নিহত হতো। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার যে সংস্কৃতির শুরু হয়েছে তার সঙ্গে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের মিল নেই। হরতাল অবরোধ দিলে অর্থনীতির ক্ষতি হয়, মানুষ কষ্টে থাকে,স্বাভাবিক জীবন থমকে দাঁড়ায় এসব নিয়ে আমি তেমন আলোচনা করতে চাই না। দেশে রাজনীতি অস্থির হলে হরতাল অবরোধ হতেই পারে। গণতান্ত্রিক দেশে ধর্মঘট করা, সমাবেশ করা, বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া এসব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু একটি মুক্ত দেশে রাজনীতির নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা বা নিরীহ মানুষকে খুন করা কোন মাপেই গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে এটিও আমাদের নজরে এল যে দেশী-বিদেশী সকলের কাছে ৩৩টি লাশের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে একজন রিয়াজ রহমানের আহত হওয়া। শত শত মানুষের আহত হওয়ার চাইতে এই ঘটনাটিকে অনেক বড় করে দেখা হয়েছে সর্বত্র। মিঠুকে মা বলি, ভগ্নি বলি, কন্যা বলি আর বাংলাদেশের আত্মা বলি তার এই কথাগুলোই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কথা। আমি ঠিক জানি না, কি কারণে সরকার এখনও পর্যন্ত এই ঘাতকদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বোমা মারার সেই হাত পুড়িয়ে দিলে ওরা অনুভব করবে মানুষকে পুড়িয়ে দিলে তার জ্বালা কেমন হয়। একইভাবে আমরা পুলিশ প্রধান, র‌্যাব প্রধান ও বিজিবি প্রধানের হুংকারও শুনেছি। এমনকি পুলিশ-র‌্যাবতো পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু পুরস্কার বা হুংকারেই কি সাধারণ মানুষকে তৃপ্ত থাকতে হবে? এইসব রাজনৈতিক হত্যা কি গণহত্যা নয়? এসব কি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নয়? হরতাল অবরোধ ডেকে যারা এই খুনগুলো করার সুযোগ করে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কি কিছুই করার নেই? সাধারণ মানুষের কাছে কোন হুংকারই স্বস্তির নয় যদি এর অবসান না হয়। আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে যে, সরকার যতটা কঠোর হবার কথা বলছে কাজে তার প্রতিফলন নেই। কেন জানি মনে হচ্ছে সরকারের মনোভাবটা এরকম যে “বিষ” দলীয় জোটের কর্মসূচিতে মানুষ বিরক্ত হোক, তাদের জনসমর্থন কমুক এবং তারা আন্দোলনে পরাজিত হোক সেটার জন্যই সরকার অপেক্ষা করছে। আমি এটা মনে করি না যে, সারা দেশের পুলিশ “বিষ” দলীয় জোটের নেতা-কর্মী বা বোমাবাজদের শনাক্ত করতে পারেনি। ২০১৩ সালে পুরো দেশে যে তা-ব হয়েছে তার তথ্যাদি সরকারের কাছে থাকার কথা। তখন কারা এসব কাজ করেছে তার ভিডিও ফুটেজ পর্যন্ত সরকারের কাছেই থাকার কথা। আমরা দেখিনি যে, ২০১৩ সালের সহিংসতার জন্য কঠোর আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এবার সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যেত। সরকারের জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের শনাক্ত করতে পারার কথা। টেলিভিশনের ক্যামেরা বোমা মারার দৃশ্য ধারণ করতে পারে অথচ গোয়েন্দারা সেটি জানে না এটি কোনভাবেই তাদের দক্ষতা বলে মানা যায় না।
×