ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গর্ভবতী মায়েদের সুষম খাদ্যের ঘাটতি

সাতক্ষীরায় শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ানো বন্ধ হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩১ জানুয়ারি ২০১৫

সাতক্ষীরায় শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ানো বন্ধ হচ্ছে না

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি সেবা নিশ্চিত করতে জেলার ৫টি উপজেলার মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা মূলক কাজ চলছে ব্র্যাকের মাধ্যমে। তবে বিকল্প শিশু খাদ্য (কৌটার দুধ) ব্যবহারের কারণে ৬ মাস পর্যন্ত শিশুদের শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ার বিষয়ে পরামর্শের সফলতা মিলছে না। এ সব উপজেলায় সরকারী ও বেসরকারীভাবে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় দরিদ্র পরিবারের গর্ভবতী বেশিরভাগ মায়েদের প্রতিদিনের পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাবারে ঘাটতি থাকছে। পাশাপাশি এসব পরিবারে গড়ে উঠছে না হাতধোয়ার অভ্যাস। জেলায় গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারী সংস্থার মাঠকর্মীদের মূল্যায়ন তথ্যে এবং মাঠ পর্যায়ে এসব গর্ভবতী মায়েদের সঙ্গে কথা বলে মিলছে এমন তথ্যচিত্র। বিকল্প শিশুখাদ্য (কৌটার দুধ) ব্যবহার বন্ধ করা , গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং পরিবারে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলাটাই এই অঞ্চলের শিশু ও মায়েদের অপুষ্টি দূর করার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ । জেলার তালা উপজেলার কাজীডাঙ্গা গ্রামের ছিদ্দিকুর রহমানের ৪ মাসেন শিশু পুত্র হুসাইন এর জন্য ইতোমধ্যে কেনা হয়েছে কয়েক কৌটা গুঁড়ো দুধ। জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে পরিবারকে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেয়া হলেও ক্লিনিক থেকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে শিশুখাদ্য কেনার সিøপ। জন্মের পরপরই শিশুটি পর্যাপ্ত মায়ের দুধ পাচ্ছে না এমন অভিযোগের পরই বিকল্প শিশু খাদ্য কেনার পরামর্শ দেয়া হয় বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকের নার্স। পালপাড়া এলাকার তুলশীর স্ত্রী টুম্পা (১৯) এখন ২ মাসের গর্ভবতী। বেসরকারী সংস্থার মাঠকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এই গর্ভবতীকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ প্রকার আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এই পরিবারে প্রতিদিনের চাহিদামত প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ মিলছে না। কলারোয়া উপজেলার সীমানন্দকাটি গ্রামের কৃষক কামালের ৪ মাসের পুত্র ইয়াছিনকে প্রথম ২ মাস বিকল্প শিশুখাদ্য (কৌটার দুধ) খাওয়ানো হয়। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শে কামাল এখন কৌটার দুধ কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণে মায়ের বুকের দুধেই এখন শিশুটির চাহিদা মিটছে। বিকল্প শিশু খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত কৌটার দুধের বিষয়ে খুলনা জেনারেল হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ খান গোলাম মোস্তফা জনকণ্ঠকে বলেন, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মায়ের দুধে যে “ইমুনো গ্লোবিউলিন’ থাকে কৌটার দুধে এটি মোটেই থাকে না। কৌটার দুধে কোন জীবন্ত কোষ ( লিভিং সেল) না থাকায় শিশু জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত কৌটার দুধ ব্যবহারে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিডিএইচএস-এর তথ্যানুযায়ী সাতক্ষীরা জেলায় কম ওজনের শিশু জন্মের হার শতকরা ৩৫ দশমিক ৫ ভাগ, এনিমিয়া আক্রান্ত ৬ থেকে ৫৯ মাসের শিশুর সংখ্যা ৫৪ দশমিক ২ ভাগ, জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার শতকরা ৪৭ ভাগ এবং শিশুর ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ৪০ ভাগ। এছাড়া অপুষ্টিজনিত কারণে খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা ৩৪ দশমিক ১ ভাগ, ক্ষীণকায় এর সংখ্যা ১৪ দশমিক ৬ ভাগ এবং কম ওজনের শিশুর সংখ্যা ২৯ দশমিক ১ ভাগ। জেলার পুষ্টি কার্যক্রম বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ সালেহ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পুষ্টি কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট বেসরকারী সংস্থাগুলো খাবার ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে আসা অপুষ্টি আক্রান্ত মা ও শিশুদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। সরকারীভাবে ভিটামিন এ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট দেয়া হচ্ছে। শিশুর পুষ্টি বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সরকারী ও বেসরকারীভাবে নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে ১০০০ (এক হাজার দিন) কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গর্ভকালীন ৯ মাস (২৭০) দিন এবং সন্তান জন্মের পর প্রথম দুই বছর (৭৩০) দিনকে অপুষ্টির হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মা ও শিশুদের অপুষ্টি রোধে এবং গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টিকর আমিষ খাবার নিশ্চিত করতে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকা ও মাঠকর্মীদের মাধ্যমে ৫টি উপজেলায় চলছে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ। জেলার ৫টি উপজেলায় মোট ৩৮ হাজার ৬শ’ ২৭ জন মা শিশুকে এই সচেতনতামূলক কাজের মধ্যে আনা হয়েছে। এদের মধ্যে ৯ হাজার ২শ’ ৯ জন রয়েছেন গর্ভবতী ও প্রসবোত্তর মা। এ সব মায়েদের ক্যালসিয়াম গ্রহণ, নিয়মিত বিশ্রাম. প্রতিদিনের খাবারে নির্দিষ্ট পরিমাণ আমিষ গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি যেয়ে স্বাস্থ্য সেবিকারা কাজ করছে। আর পুষ্টি কর্মীরা গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব হওয়া পর্যন্ত এ সব মায়েদের পরামর্শ দিয়ে চলছে। এদিকে ডায়রিয়া, পেটের পীড়াসহ যে কোন ধরনের সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিশুকে খাবার দেয়ার আগে মায়েদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে অশিক্ষিত মায়েরা এই পরামর্শ ধরে রাখতে পারছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাঠকর্মীরা। অন্যদিকে সরকারীভাবে পুষ্টি কার্যক্রমে উপজেলা হাসপাতালের পুষ্টি কর্ণারে আসা শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকে সরবরাহ করা ওজন ও উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্রের কার্যকারিতা নেই। আর সরকারীভাবে পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দেয়া লিফলেটগুলোর ব্যবহার হচ্ছে না। পাশাপাশি কৌটার দুধ বিক্রি ও ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য সরকারীভাবে কোন প্রচারের ব্যবস্থা না থাকায় কৌটার দুধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এদিকে ডবলুএফপির অর্থায়নে জেলার আশাশুনি, দেবহাটা, তালা ও সদর উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে পুষ্টি খাবার দেয়া হয়েছে গত দেড় বছর ধরে। এসিএফ এর কারিগরি সহায়তায় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সুশীলন যৌথভাবে (জুলাই ’১২- ডিসেম্বর ’১৩) পর্যন্ত মোট ১ লাখ ২০ হাজার ৪শ’ ২০ জন মা ও শিশুকে পুষ্টি সেবা দিয়েছে। পরামর্শের পাশাপাশি এ সব মা শিশুদের দেয়া হয় হুইট সয়া ব্লেন্ডেড নামের পুষ্টিকর খাবার। সংশ্লিষ্ট বেসরকারী সংস্থা সুশীলনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর জিএম মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় ২০১২ সাল থেকে মক পদ্ধতিতে ম্যালনিউট্রেড মা ও শিশু চিহ্নিত করে এদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা দেয়া হয়। এই কর্মসূচীতে অপুষ্টি আক্রান্ত শিশু ও মায়েরা উপকৃত হয়েছে।
×