ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দল বেঁধে আকাশে ওড়ে, দীর্ঘজীবী- এখন বিলুপ্তির পথে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩১ জানুয়ারি ২০১৫

দল বেঁধে আকাশে ওড়ে, দীর্ঘজীবী- এখন বিলুপ্তির পথে

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ এক সময় আকাশে দলবেঁধে উড়ে চলা শকুন দেখা গেলেও এটি এখন অতীতের বিষয়। প্রবীণরা মনে করেন, পাখিকুলের মধ্যে শকুন সবচেয়ে দীর্ঘজীবী। তার গড় আয়ু কমপক্ষে এক শ’ বছর। ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও শকুন আকাশে উড়তে দেখা যেত কিন্তু এখন আর তা চোখে পড়ে না। শকুন হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ পশু চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডাইক্লোফেনের ব্যবহার। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ে সম্প্রতি এক বিকেলে হঠাৎ দেখা মেলে শতায়ু এক শকুনের। বিরল প্রজাতির বিশাল আকৃতির শকুনটি দেখতে ভিড় করে করে শত শত মানুষ। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ জুলহাস আহম্মেদ খান ও পশু চিকিৎসক ডাঃ আনিসুর রহমান শকুনটিকে দ্রুত গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে হস্তান্তর করার অনুরোধ জানান। তাঁরা গফরগাঁও প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে মতবিনিময় করেন। গফরগাঁও উপজেলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রাসেল মিয়া জানান, আমার ৩৫ বছর বয়সে এই প্রথম শকুন দেখলাম, এর আগে কখনও শকুন দেখিনি। বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রায় শকুনগুলো সংরক্ষণ করার জরুরী প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। পরিবেশবিদদের মতে, শকুনই একমাত্র পাখি, যা আকাশে অনেক উঁচুতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়তে পারে। ইদানীং বিভিন্ন দেশে গবাদি পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডাইক্লোফেন’ ব্যথানাশক ওষুধের প্রভাবে শকুন মারা যাচ্ছে। এ কারণে ডাইক্লোফেন ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে নিষিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে ডাইক্লোফেনের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে শকুন বিলুপ্তির পথে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত পশুর মাংস শকুনের কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু ডাইক্লোফেন দেয়া হয়েছেÑ এমন মৃত পশুর মাংস খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে ২-৩ দিনের মধ্যে শকুনের মৃত্যু ঘটে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে ওক গবেষণায় দেখতে পান যে, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনের ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। মানবসৃষ্ট কারণে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচতে পৃথিবীর অনেক দেশেই পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনের পরিবর্তে সমান কার্যকর অথচ শকুনবান্ধব ‘মেলোক্সিক্যাম’ নামক ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ, ক্যামেরুন, সুদান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, ঘানা, চীন, ভারত ও নেপালে এ জাতীয় শকুন খাদ্য ও বসবাসের জন্য ঘুরে বেড়ায়। শকুনকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতে প্রতিবছর ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে থাকে। শকুনের ইংরেজী নাম ঠঁষঃঁৎব। এটি এক ধরনের পাখি। জীবনধারণের জন্য পাখিটি মূলত মৃতপ্রাণীর মাংসের ওপর নির্ভরশীল। তীক্ষèদৃষ্টির অধিকারী শিকারী পাখিগুলো খাবারের খোঁজে বেরিয়ে অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারিদিকে উড়তে শুরু করে। প্রাণিটির মরার জন্য অপেক্ষা করে। শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোন পালক থাকে না। প্রশস্ত ডানায় ভর করে আকাশে উড়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে মহীরূহ বলে পরিচিত বট, পাকুর, অশ্বত্থ, ডুমুর প্রভৃতির বিশালাকার গাছে সাধারণত শকুন বাসা বাঁধে। সাধারণত গুহায়, গাছের কুঠরে বা পর্বতের চূড়ায় ১ থেকে ৩টি সাদা বা ফ্যাকাসে ডিম পাড়ে। পৃথিবীতে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন আছে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে প্রায় ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে। এর মধ্যে ৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। বাংলা শকুন ছাড়াও আছেÑ রাজ শকুন, গ্রিফন শকুন, হিমালয় শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। তবে শুধু গ্রিফন প্রজাতির শকুনই মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এ সব শকুন পৃথিবীতে বিপদাপন্ন। স্থায়ী প্রজাতির মধ্যে রাজ শকুনের অবস্থা আরও খারাপ। এটি ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য ঠোঁটে পাথরের টুকরো বহন করে ডিমের উপর নিক্ষেপ করে। এ প্রজাতির শকুনের দৈর্ঘ্য ৭৬ থেকে ৮৬ সেঃ মিঃ (৩০ থেকে ৩৪ ইঞ্চি)। ওজন ৩.৫ থেকে ৬.৩ কেজি। পাখার দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৯৯-২.৬ মিটার (৬.৫-৮.৫ ফুট)। প্রাপ্ত বয়স্ক রাজ শকুনের ন্যাড়া আকৃতির মাথা ঘন লাল থেকে কমলা রঙের দৃশ্যমান। এটির দেহের পালকে ধসুর ও কালো রঙের সংমিশ্রণ ঘটে। লিঙ্গ ভেদে শকুনের চোখের রঙে ভিন্নতা দেখা দেয়। পুরুষ শকুনের কর্নিয়া সাদাটে এবং স্ত্রী শকুনের কর্নিয়া ঘন বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। সচরাচর দেশের সর্বত্র দেখা গেলেও অর্ধ মরুভূমি এলাকায় এদের দেখা মেলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার মিটার উঁচুতে এরা বাস করে।
×