ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৮৭৮ নারী সেনা সদস্যের শপথ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

যে দেশের নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে সে দেশের নারী পিছিয়ে থাকবে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

যে দেশের নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে সে দেশের নারী পিছিয়ে থাকবে না

ফিরোজ মান্না/ইফতেখারুল অনুপম, ঘাটাইল শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস থেকে ॥ নারী-পুরুষ মিলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজের নারীর অবদান সব ক্ষেত্রে নক্ষত্রের মতো জ¦লজ¦ল করে জ¦লছে। তাই ‘সাহসের বরা ভয় বাংলার নারী হয়, দেখিবে জগৎ অবলা আর নয়রে নয়’। সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন রোদে সুসজ্জিত ৮৭৮ নারী সেনা সদস্যের মাথার লাল টুপিতে বর্ণিল আলোর ঝলক লাগে। ঘাটাইলের শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাসের শহীদ বীরউত্তম নুরুল হক প্যারেড গ্রাউন্ডে তাদের অপেক্ষার পালা। কখন আসবেন প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার জন্য গোটা সেনানিবাস বর্ণাঢ্য সেজেছিল। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ, বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটার দিকে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সম্মানে শুরু হয় নবীন নারী সদস্যদের মন মাতানো কুচকাওয়াজ। প্রধানমন্ত্রী নবীন নারী সেনা সদস্যদের কুচকাওয়াজ দেখে অভিভূত হন। ঘাটাইলে দেশের প্রথম মহিলা মিলিটারি প্যারামেডিক রিক্রুট ব্যাচের শপথ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি আজ সত্যিই গর্বিত, বাংলাদেশের জন্য আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। যে দেশের নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দিয়েছেন সেদেশের নারী পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশে এটাই প্রথম মেডিক্যাল কোরে এত বিপুলসংখ্যক নারী সদস্য ‘পাসিং আউট’ হলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, নারীর অংশগ্রহণে দেশ এগিযে যাবে, যাচ্ছে। একদিন দেশ হবে একটি উন্নত দেশ। প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার ঘাটাইলে পাসিং আউটের শুভ উদ্বোধন করেন। পরে তিনি বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব তীরে বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। জাতির পিতা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি আধুনিক সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি। জাতির পিতার সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিক নির্দেশনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজকের এ গৌরবময় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যে সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল তার সুনাম আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশে^ও ছড়িয়ে পড়েছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আর্মি মেডিক্যাল কোরের ১৫ অফিসারসহ ১৩৭ বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ এই কোরকে গৌরবান্বিত করেছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে একবিংশ শতাব্দীর পেশাদার চৌকস বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি। আর্মি মেডিক্যাল কোরে মহিলা অফিসারের পাশাপাশি ২০০০ সালে আমাদের সরকারের সময়ে অন্যান্য কোরেও মহিলা অফিসার নিয়োগ শুরু করি। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন আর্মস ও সার্ভিসে মহিলা অফিসাররা দেশে ও শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ফোর্সেস গোল ’৩০ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীতে মহিলা অফিসারের পাশাপাশি মহিলা সৈনিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর মতো একটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সমাজের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী। নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া কোন ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। আমরা জানি, ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে নার্সিং সার্ভিসের পথচলা শুরু হয়েছিল। সেই নার্সিং সার্ভিস আজ পৃথিবীর সকল পেশাদার সেনাবাহিনীর অনিবার্য অংশ হিসেবে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল সার্ভিস আরও বিস্তৃত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ’১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় আর্মি মেডিক্যাল কোর সেন্টার এ্যান্ড স্কুলকে ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল এ্যান্ড হেলথ টেকনোলজি পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। আজকের দিনটি আপনাদের জীবনে অত্যন্ত আনন্দের এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সৈনিক আপনারা বৃহত্তর কর্মজীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন। আপনাদের ওপর ন্যস্ত হচ্ছে দেশমাতৃকার মহান স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব। আপনারা এএমসি সেন্টার অ্যান্ড স্কুলে ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল অ্যান্ড হেলথ টেকনোলজি সম্পন্ন করে সেনাবাহিনীর চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেন। সেবার মহান ব্রত নিয়ে আজ আপনারা যে শপথ গ্রহণ করলেন, তা আপনাদের আত্মত্যাগ, পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বের প্রতি একাগ্রতার মাধ্যমে এবং দেশের আপামর জনসাধারণের চিকিৎসা সেবায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশাবাদী। আপনারা নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও জনগণের সেবা করবেন। আমার দোয়া ও শুভকামনা আপনাদের জন্য সবসময় থাকবে। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে। আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে বেগম রোকেয়া বাঙালী মুসলিম নারী সমাজকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়ার অবদান বাঙালী নারীর জন্য চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল। আমার পিতা, পরিবার এবং কর্মীদের সহযোগিতা দিয়েছেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ক্যাপ্টন ডা. সেতারা বেগম এবং তারামন বিবি আমাদের গর্ব ও অহঙ্কার। ’৭১- এ নারীরা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে এবং খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে, অনুপ্রেরণা ও ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের নারীরা আজ পিছিয়ে নেই। নিজেদের শ্রম, মেধা এবং দক্ষতা দিয়ে বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে চলছে সর্বক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে নানা ধরনের চ্যালঞ্জিং এবং দুঃসাহসিক কর্মকা-ে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন নারীরা। ২০১২ সালে সর্বপ্রথম নিশাত মজুমদার এবং পরবর্তীকালে ওয়াসফিয়া নাজনীন এভারেস্ট জয় করার মতো দুঃসাহসিক অভিযানে সফল হন। এছাড়া সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম মহিলা ছত্রীসেনা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাঈমা হক এবং ফ্লাইং অফিসার তামান্না-ই-লুৎফী প্রথম সামরিক বৈমানিক হওয়ার যোগ্যতা লাভ করেন। বিশ^জুড়ে রাজনীতি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক কর্মকা- ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন নারীরা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বিনামূল্যে শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ এবং বৃত্তি দেয়ায় নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। সরকার নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইন ২০১০ প্রণয়ন করেছে। বিভিন্ন সরকারী কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ৪০ মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার সেনসেটিভ বাজেট তৈরি হচ্ছে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপের ২০১৩ সালের রিপোর্টে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং সর্বোপরি সামাজিকভাবে নারীকে মূল্যায়ন করলে গোটা সমাজেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করে আজ আপনারা সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলেন। আপনাদের মনে রাখতে হবে আপনারা এদেশের জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুঃসময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর্মি মেডিক্যাল কোর আর্ত-মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। যাদের সেবার প্রসার বাংলাদেশের গ-ি পেরিয়ে বহির্বিশে^ও ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে এ কোরের অফিসার ও সৈনিকগণ নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। বর্তমানে কঙ্গো, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, পশ্চিম সাহারা ও কুয়েতসহ মোট পাঁচটি দেশে এই কোরের সদস্যগণ চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত আছেন। এছাড়াও মানবতার সেবায় এই কোরের ফিল্ড ইইনিটসমূহ বহিরাঙ্গন অনুশীলনে বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করেছেন। ‘সমরে ও শান্তিতে রাখিব সুস্থ’Ñএ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সেনাবাহিনী তথা জাতিকে সেবাদানের জন্য পেশাগত উৎকর্ষ, নিরলস পরিশ্রম এবং ত্যাগের মহান ব্রত নিয়ে আপনারা নিজেদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য অনুসারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আপনাদের সুসজ্জিত, সুশৃঙ্খল ও আকর্ষণীয় কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছি। এদিকে, টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতু সংলগ্ন ‘বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস’ নামে নতুন একটি সেবানিবাস উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে দুটোয় প্রধানমন্ত্রী নবনির্মিত এ সেনানিবাসের উদ্বোধন করেন। এরপর দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে সেনানিবাসে নব নির্মিত সদর দফতর ৯৮ কম্পোজিট ব্রিগেড অফিস ভবন, ১২তলা অফিসার্স মেস কমপ্লেক্স, অফিসার জেসিও এবং অন্যান্য পদবির সৈনিকদের জন্য বহুতল পারিবারিক বাসস্থানের ফলক উন্মোচন করেন। ফলক উন্মোচনের পর প্রধানমন্ত্রী নবনির্মিত স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী দুপুর একটা ৩৯ মিনিটে এ সেনানিবাসে পৌঁছলে সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুইয়াসহ অন্যান্য উর্ধতন কর্মকর্তা তাঁকে স্বাগত জানান। এছাড়া এ সময় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রধানসহ উর্ধতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু সেতুর সার্বিক নিরাপত্তার জন্যে ১৯৯৯ সালের ২০ মে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদর দফতর ৯৮ কম্পোজিট ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করেন। তখন বঙ্গবন্ধু সেতুর নামের সঙ্গে মিল রেখে এই সেনানিবাসের নাম রাখা হয় বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস।
×