ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাগরে আবার ট্রলার ডুবি ॥ থামছে না পাচার

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

সাগরে আবার ট্রলার ডুবি ॥ থামছে না পাচার

চট্টগ্রাম অফিস/কক্সবাজার, মহেষখালী ও কুতুবদিয়া প্রতিনিধি ॥ অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচারকালে কুতুবদিয়ার অদূরে সাগরে প্রায় ৭০ মালয়েশিয়াগামী যাত্রী নিয়ে একটি দেশীয় ইঞ্জিনচালিত বোট বৃহস্পতিবার ভোরে ডুবে গেছে। কোন কোন সূত্রে যাত্রীসংখ্যা শতাধিকও বলা হয়েছে। তবে এ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা ৪২ জনকে উদ্ধার করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে মাঠ পর্যায়ের চার দালাল। এই ৪২ জনের মধ্যে ৩৩ জনকে কুতুবদিয়া থানা ও অবশিষ্ট ১১ জনকে মহেষখালী থানার আওতাধীন মাতারবাড়ি ফাঁড়ি পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে কুতুবদিয়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অবশিষ্টরা হয় নিখোঁজ রয়েছে অথবা সাঁতরিয়ে কূলে উঠে গা-ঢাকা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উদ্ধারকৃতরা নরসিংদী, যশোর, সিলেট, নওগাঁ, মাদারীপুর, বরগুনা ও কক্সবাজার এলাকার। বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় আদম পাচার থেমে নেই। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফাঁক ফোকরে এদেশের হতদরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের ভাল উপার্জনের লোভ দেখিয়ে অবৈধ পথে এ পাচার যেন থামছে না। নৌবাহিনী, কোস্টকার্ড ও পুলিশ সূত্র উদ্ধারকৃতদের বরাত দিয়ে জানায়, বুধবার গভীর রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর মাঝিরঘাট এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা একটি বড় আকৃতির ইঞ্জিনচালিত বোটে প্রায় দু’শ’ জনকে নিয়ে সাগরপথে রওনা দেয়। কুতুবদিয়া দ্বীপের আরও আগে পথিমধ্যে এদের আনুমানিক ৭০ জনকে ওঠানো হয় ছোট আকৃতির এফবি ইদ্রিস নামের একটি ইঞ্জিনচালিত বোটে। এরপর আবার শুরু হয় সাগরপথের অনিশ্চিত যাত্রা। বর্তমান শীত মৌসুমে সাগর তত উত্তাল নয়। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির ঢেউ রয়েছে। বোটটি কুতুবদিয়ার দক্ষিণে খুদিয়ারটেক এলাকা এবং মহেষখালীর উত্তরে মাতারবাড়ি এলাকা থেকে দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সাগরে ঢেউয়ের তোড়ে আকস্মিকভাবে কাত হয়ে ডুবে যায়। এ সময় বোটে থাকা যাত্রীদের মাঝে চিল্লাচিল্লি ও কান্নার রোল পড়ে যায়। এ সময় কেউ সাঁতার কেটে কূলের দিকে প্রাণ রক্ষায় তৎপর হয়। পাশাপাশি সাগরে থাকা ফিশিং ইঞ্জিন নৌকার মাঝিমাল্লারা এগিয়ে যায়। ইতোমধ্যে খবর পৌঁছে যায় কোস্টগার্ডের কুতুবদিয়ায় পয়েন্টে অবস্থানরত ইউনিটে। তারা দ্রুত অকুস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এর পর পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ। নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজ ‘তানভীর’ ‘হাইস্পীড জাহাজ মেটাল সার্ক’, ‘তৌহিদ’ ও ‘অতন্দ্র’ একযোগে উদ্ধার কাজ চালিয়ে ৩২ জনকে উদ্ধার করে। এ সময় নৌবাহিনীর চৌকস ডুবুরি দল ডুবে যাওয়া বোটের অভ্যন্তরে গিয়ে কোন মৃতদেহ খুঁজে পায়নি। উদ্ধার কাজ শেষে ডুবুরি দল জানিয়েছে, তারা নিশ্চিত নৌকার অভ্যন্তরে জীবিত বা মৃত কেউ নেই। এরপরে কক্সবাজারের পোকখালীর শুক্কুর কোম্পানির মালিকানার ইঞ্জিন বোট এফবি ইদ্রিসকে টেনে কূলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আরেকদফা তল্লাশি চালানো হয়। এতেও কোন মানুষের সন্ধান মেলেনি। সঙ্গত কারণে ডুবে যাওয়া ইঞ্জিন বোটটিতে সুনির্দিষ্টভাবে কতজন ছিল, থাকলেও অবশিষ্টদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখন বলা যাচ্ছে না। তাদের ধারণা, নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর এদের কেউ কেউ সাঁতরিয়ে কূলে উঠে পুলিশের ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। কোস্টগার্ডের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মো. শহীদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, উদ্ধারকৃতরা সবাই অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র। এদেরকে স্ব স্ব এলাকা থেকে দালালদের মাধ্যমে অধিক উপার্জনের লোভ দেখিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। মালয়েশিয়া পৌঁছার পর তাদের প্রত্যেকের পরিবার দালালদের হাতে জনপ্রতি ২ লাখ টাকা করে পৌঁছে দেয়ার শর্ত ছিল। মালয়েশিয়া যাত্রার জন্য অধিকাংশের কাছ থেকে অগ্রিম কোন অর্থ নেয়া হয়নি। তবে উদ্ধারকৃতদের কারও কারও কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দালালরা গ্রহণ করেছে। মহেষখালী ও কুতুবদিয়া থানায় হস্তান্তরের পর পুলিশ এদের জবানবন্দী রেকর্ড করেছে। কিন্তু এরা সুনির্দিষ্টভাবে কোন দালাল বা গডফাদারের নাম জানাতে পারেনি। তবে এ পথে ইতোপূর্বে তাদের স্ব স্ব এলাকার অনেকে মালয়েশিয়ায় গেছে বলে জানায়। সে কারণে তারাও অবৈধভাবে সাগর পথে অনিশ্চিত এ যাত্রায় শামিল হয়েছে। কুতুবদিয়া থানা পুলিশ জানায়, তাদের কাছে উদ্ধারকৃত ৩২ জনের মধ্যে ৪ দালাল রয়েছে। এরা হচ্ছে ওবায়দুল হক (৩৫), ইসমাইল হোসাইন (১৭), নুর মোহাম্মদ (৫০) ও ইয়াসিন (১৭)। এরা সকলেই কক্সবাজারের পোকখালী এলাকার বাসিন্দা। এছাড়া বাকি ২৮ যাত্রী হলেন নরসিংদীর শাহজাহান (৪৪), মাদারিপুরের শহীদুল ইসলাম (২৩), দুল্লাল হাসান (২৬), নেয়ামত শেখ (২৪), ইব্রাহিম হোসাইন (২৫), উজ্জ্বল মোল্লা (৩০), যশোরের আলমগীর হোসাইন (৩০), ফয়েজ (২৬), নাজিমউদ্দিন (৩৫), সাত্তার হোসাইন (৩০), খোকন হোসাইন (২৫), সিরাজুল ইসলাম (২৬), সবুজ হোসাইন (২৮), সুজন হোসেন (১৮), ইয়াসিন হোসেন (১৮), রফিকুল ইসলাম (৪২) আবুল হোসাইন (২৮), নরসিংদীর শিমুল হোসাইন (১৮), গোলাপ মিয়া (২৫), আলামিন (১৯), ইউসুফ হোসাইন (২০), শাহাজাহন মিয়া (৩৪), মোশাররফ হোসাইন (২৩), নারায়ণগঞ্জের আবুল কালাম (৩২), শফিক (২৩), শরীফ সিকদার (২৬) ও কাউসার (২০)। মহেশখালির মাতারবাড়ি ফাঁড়ি পুলিশের উপ পরিদর্শক নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, সেখানে উদ্ধারকৃতরা হচ্ছেÑ যশোরের সাইফুল ইসলাম (২২), ইব্রাহিম (২২), জিন্নাহ (২৩), নরসিংদীর সবুর (২৩), ওহিদ (২৯), মাদারী বাড়ির নুরুজ্জামান কাজেমী (২৯), নওগাঁর আজহার (৪৫) সিলেটের রফিজ আলী (২২) ও শাহ আলম (২৭) এবং কক্সবাজারের রাসেল (২৩) ও তৈয়ব (২২)। এদিকে, যে বড় আকৃতির ইঞ্জিন বোটে করে প্রায় ২শ’ জন মালয়েশিয়াগামীকে উঠানো হয়েছিল সে বোটটি ও এর যাত্রীরা কোনপথে গেছে বা আদৌ গেছে কিনা তার কোন হদিস এখনও কোন সূত্রে জানতে পারেনি। তবে এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে বলে কোস্টগার্ড সূত্রে জানানো হয়।
×