ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:০২, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা

(২৩ জানুয়ারির পর) হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) যে সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন তাতে চারের বেশি স্ত্রী গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হলো। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমাদের পছন্দ মতো দুই, তিন অথবা চারজন পর্যন্ত নারীদের বিয়ে করবে আর যদি আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে বিয়ে করবে (সূরা নিসা : আয়াত ৩)।’ নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে (সূরা নিসা : আয়াত ৭)। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে সেক্ষেত্রে তালাকের বিধান থাকলেও তালাক কার্যকর না করার জন্য চেষ্টা করার কথাও বলা হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তাদের (স্বামী-স্ত্রীর) উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন এবং ওর (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে, তাঁরা উভয়েই নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ্ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন (সূরা নিসা : আয়াত ৩৫)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘একটি জিনিস বিধিসম্মত কিন্তু আল্লাহ পছন্দ করেন না তা হচ্ছে তালাক।’ ইসলাম বিদ্যা অর্জনকে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করেছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যে সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন তা আল্লাহর দেয়া সমাজব্যবস্থা। এই সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারী হতে হবে। এই সমাজ মুসলিম উম্মাহ্। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই সমাজের মানুষেরা সত্যিকার অবদান রেখেছে এবং রেখে আসছে। ঐক্য ও সংহতির মধ্য দিয়ে, আল্লাহর ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল রাখার মধ্য দিয়ে, কুরআন ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী আমল করার মধ্য দিয়ে, কুরআন ও সুন্নাহ্ মুতাবিক আখ্লাক গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহ্ মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে অনন্য অবদান রেখেছেন তা সবাই স্বীকার করেন। এটাও স্বীকার করেন যে, ইসলাম ছাড়া বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলাম। কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় মুসলিম উম্মার ঐক্য ও সংহতির নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ হয়েছে : আর আল্লাহর রজ্জ (কুরআন ও ইসলাম) সবাই মিলে মজবুত করে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১০৩ )। মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তিস্থাপনা কর ও আল্লাহ্কে ভয় কর যাতে তোমরা অনুগ্রহ পেতে পার (সুরা হুজুরাত : আয়াত ১০)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ এনে এখানে মসজিদুন্ নববীকে কেন্দ্র করে একটি আদর্শ কল্যাণরাষ্ট প্রতিষ্ঠিত করেন। যে নগররাষ্ট্র ৮-৯ বছরের মধ্যে ইয়ামন থেকে দামেস্ক পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি। মসজিদে নববী স্থাপন শেষে তিনি একটি ভ্রাতৃসমাজ তথা উখ্ওয়াত গড়ে তোলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনা করেন। যা চার্টার অব মদীনা বা মদীনার সনদ নামে পরিচিত হয়। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এতে মুহাজির, আনসার, ইয়াহুদী ও অন্যান্য ধর্মীয় গোত্রের প্রধানরা সম্মতিসূচক স্বাক্ষর প্রদান করে এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তাদের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু ইয়াহুদীরা এই সংবিধানের শর্ত ভঙ্গ করে এবং মদীনা মুনাওয়ারায় আবদুল্লাহ ইবনে উবায় নামক এক ধূর্ত মুনাফিক সরদারের সঙ্গে আঁতাত করে মক্কার কাফির-মুশ্রিকদের সঙ্গে জোট বাঁধে। যার ফলে বার বার মদীনা মুনাওয়ারা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহ্র নির্দেশে প্রতিরক্ষামূলক সশস্ত্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। তাঁর নেতৃত্বে বা নির্দেশে প্রায় ৯৩টি ছোট-বড় যুদ্ধ ও অভিযান পরিচালিত হয়। তিনি যেগুলোতে সিপাহসালার ছিলেন তাকে গাযওয়া বলা হয়। এর সংখ্যা প্রায় ২৯টি আর তাঁর নির্দেশে কোন সাহাবীর নেতৃত্বে যে যুদ্ধাভিযান পরিচালিত হয় সেগুলোকে সারিয়া বলা হয়। এর সংখ্যা প্রায় ৬৪টি, সকল যুদ্ধেই ইসলামের বিজয় পতাকা সমুন্নত হয়েছে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২১ রমাদান মক্কা মুর্কারমা বিজয় হয়। এই দিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বার বার উচ্চারণ করেছিলেন : সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত, মিথ্যা দূর হবারই (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৮১)। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ যিলহজ রফিকুল আলার কাছে চলে যাওয়ার মাত্র ৯০ দিন পূর্বে হায়াতুন্ নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রায় ১ লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের সমাবেশে বিদায় হজের দীর্ঘ ভাষণের একপর্যায়ে বললেন : হে লোক সকল! তোমরা শোন, আইয়ামে জাহিলিয়াতের সমস্ত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অনাচার, শিরক, কুফর আজ আমার পায়ের তলায় দলিত হলো। তিনি বললেন : কোন কর্তিতনাসা কাফ্রী গোলামকেও যদি তোমাদের শাসনকর্তা (আমীর) নিযুক্ত করা হয় এবং সে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী তোমাদের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে তোমরা অবশ্য তাঁর অনুগত থাকবে, তাঁর আদেশ মেনে চলবে। তিনি বললেন : আমার পরে আর কোন নবী আসবে না, তোমাদের পরে আর কোন উম্মত হবে না। সাবধান দ্বীনের (ধর্মের) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কর না, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু কওম ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি তাঁর সেই দীর্ঘ ভাষণে সেই বিশাল জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাহ্। তোমরা যদি তা দৃঢ়তার সঙ্গে অবলম্বন কর তাহলে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তিনি বললেন : সাবধান! অনেক কিছুকেই তোমরা ক্ষুদ্র মনে কর অথচ শয়তান সেগুলোর মাধ্যমে তোমদের সর্বনাশ সাধন করে, এ ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ইবনে মাজা শরীফ, তিরমিযী শরীফ)। বিদায় হজের সেই দীর্ঘ ভাষণ শেষে তিনি সমবেত সকলকে আঁসু ভরা চোখে আল-বিদা জানান। তখন যে ওহীখানি নাযিল হয় তা প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং সানন্দ অনুমোদন দান করলাম তোমাদের দ্বীন ইসলামকে (সুরা মায়িদা : আয়াত ৩)। তিনি রফীকুল আলা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার পর থেকে ইসলামের বিজয় অব্যাহত থেকেছে। একটি জাতি যার নাম আরব জাতি, একজন মানুষ যাঁর নাম হযরত মুহম্মদ (সা:) আর সেই একটি শতাব্দী, এটা কি তাই নয়, যেন একটি অগ্নি স্ফুলিঙ্গ, শুধুমাত্র একটি অগ্নি স্ফুলিঙ্গ পতিত হলো এমন একটি ভূখ-ে যা দেখতে ছিল কালো অজ্ঞাত বালুকাবিন্দু। কিন্তু দেখ! সেই বালুকা বারুদের মতো বিস্ফোরিত হলো আকাশ সমান আলো ছড়িয়ে আর সেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দিল্লী থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত। মুসলিম উম্মাহর সুদীর্ঘ সোনালি ইতিহাস রয়েছে। আজকের মুসলিম উম্মাহ্ পৃথিবীর সমগ্র জনসংখ্যার এক চতুথাংর্শ। আজকের বিজ্ঞানে এই যে বিপুল উন্নতি এটারও প্রেক্ষাপটে মুসলিম মনীষীদের অবদান রয়েছে তা সর্বজন বিদিত। ‘মহানবী (সা:) ই-জ্ঞানালোকের ও সভ্যতার বিশাল অট্টালিকার বুনিয়াদ স্থাপন করেন যা তাঁর আমল থেকেই পৃথিবীকে সুশোভিত করে আসছে। আল কুরআনে মুসলিমদের যে কথাটি বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে : ‘হে রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর। হযরত মুহম্মদ (সা:) কে তাঁরা বলতে শুনেছেন : জ্ঞান হচ্ছে মু’মিনের জন্মগত অধিকার, যেখানেই তোমরা তা দেখবে গ্রহণ করবে।’ এমনটাই ছিল বীজগুলো যার থেকে উৎপন্ন হলো বহু বৃক্ষ আর যার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ল বাগদাদে, সিসিলিতে, মিসরে, স্পেনে আর ফলগুলো ভোগ করছে আজকের দিনে আধুনিক ইউরোপ।’ লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা:) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
×