ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুপেয় মিঠা পানির হাহাকার দেশে আর থাকছে না

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

সুপেয় মিঠা পানির হাহাকার দেশে আর থাকছে না

সমুদ্র হক ॥ উন্নত বিশ্বের চ্যালেঞ্জে সুপেয় মিঠা বা স্বাদু পানি আহরণের বিশেষ কৌশল উদ্ভাবন করে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগে সফলতা এনেছে বাংলাদেশ। স্বল্পব্যয়ের এই অসাধারণ কাজে ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লোনা পানির কয়েকটি জেলায় এবং পূর্বাঞ্চলের টেকনাফের মানুষ নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের যেসব এলাকায় (বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চল) এখনও ভূ-স্তরের অনেক গভীরে গিয়েও পাথরের কারণে সুপেয় পানি মিলছে না সেই সব এলাকাতেও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সাফল্য এনেছে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)। এর আগেও গ্রাম উন্নয়নে তারা বহুমুখী গবেষণায় সফল হয়েছে। বগুড়া আরডিএর মহাপরিচালক এম এ মতিন জানালেন, বিশ্বে আগামীতে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার লেগে যেতে পারে। যার আলামত এখনই মিলেছে। ইউরোপের অনেক দেশে সুপেয় পানির ব্যবস্থায় রিসাইক্লিং শুরু হয়েছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাকারণে সুপেয় পানির আধার দূষিত ও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুদূর প্রসারি এ ভাবনায় বগুড়া আরডিএ বিশেষ ধরনের গবেষণায় মিঠা পানি প্রাপ্তির ব্যবস্থা করছে। আরডিএর সেন্টার ফর ইরিগেশন এ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের (সিআইডব্লিউএম) পরিচালক মাহমুদ হোসেন খান জানালেন, সকল ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় মিঠা পানির নিশ্চিতকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। দেশকে এগিয়ে নিতে এবং বিশ্বের চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার সব প্রযুক্তি আয়ত্বে আনা হচ্ছে। বলা যায়, বিশ্ব যেখানে হিমশিম খাচ্ছে আরডিএ সেখানে স্বল্প ব্যয়েই সীমিত সাধ্যের মধ্যে মানুষের জীবন রক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তায় এগিয়ে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলে মিঠা পানির যে ভয়াবহ সঙ্কট ছিল তা মোকাবেলা করা হয়েছে। বর্তমানে খুলনার রামপালে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের আওতায় ১৩শ’ ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের কয়লাভিত্তিক যে স্টিম টারবাইন বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে সেখানে খাবার পানির ব্যবস্থা করেছে আরডিএ। একই স্থানে সুন্দরবনের ধার দিয়ে যে নদী গেছে সেখানে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসিয়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা হয়েছে। অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম দুটি দিক বিচেনায় আনা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ত পানির অঞ্চলের মাটির নিচে কোথাও অধিক গভীরে কোথাও স্বল্প গভীরতায় সুপেয় পানি মেলে। মাটির নিচের এ জায়গাটি খুঁজে বের করাই প্রধান কাজ। এর বাইরে স্বাভাবিকভাবে সব স্থানে লোনা পানির আধিক্য বেশি। অনেক সময় স্থানীয় প্রযুক্তিকে যুগোপযোগী করে কাজে লাগিয়ে লোনা পানিকে ট্রিটমেন্ট করে স্বাদু পানিতে রূপান্তর করা হয়। মাহমুদ হোসেন খান বললেন, দক্ষিণাঞ্চলের বিশেষ করে সাতক্ষীরার মানুষ প্রমাণ করেছে তারা মিটারের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করে পরিমিত মিঠা পানি ব্যবহার করে। গেল সিডরের পর খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাটের প্রতিটি ইউনিয়নে মিঠা পানির উৎস খোঁজা হয়েছে। এজন্য আরডিএর গবেষকগণ কোথায় কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে তা খুঁজে বের করেন। বিশেষ ধরনের এ গবেষণায় প্রথমে ৩৬টি গ্রামকে নির্বাচিত করা হয় মিঠা পানির জন্য। তারপর গভীর ও অগভীর নলকূপের দুই ধরনের প্রকল্প নিয়ে বিশেষ প্রযুক্তিতে মিঠা পানি সরবরাহে ব্যবস্থা করা হয়। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় সুন্দরবনের ধারে হরিনগর ও মুন্সীগঞ্জে হাইড্রোলজির বিশেষ প্রযুক্তিতে খাবার পানি (মিঠা পানি) সরবরাহের ব্যবস্থা হয়। সাত কিলোমিটরেরও বেশি পাইপ লাইন টেনে এই দুই গ্রামে ট্যাপ বসানো হয়। প্রতিটি ট্যাপের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা পানি ব্যবহারের মিটার বসানো হয়। প্রতি ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা হয়। প্রতি লিটার পানির জন্য দিতে হয় ৪ পয়সা করে। গ্রামের মানুষ এ বিল পরিশোধ করে ব্যাংক ও স্থানীয় পোস্ট অফিসে। কোন কাজে কি পরিমাণ ব্যবহার করবে তা গ্রাহক নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রামে পানি সরবরাহ নেয়ার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রাথমিক মাত্র দেড় হাজার টাকা জামানত নেয়া হয়। একজন গ্রাহক খুবই কম মূল্যে মিঠা পানি সরবরাহের সংযোগ পান। এদিকে মিঠা পানি সরবরাহ ছাড়াও বাগেরহাটের মুরইলগঞ্জে বলেশ্বর নদী ও খালের পানি মাটির নিচে স্থাপিত পিভিসি পাইপ লাইনের মাধ্যমে জমিতে সেচ কাজে এবং ভূ-গর্ভের পানি সুপেয় পানি ব্যবহারের দ্বৈত প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। আগামী মার্চেই এ প্রকল্পের সুফল পাবে ওই এলাকার মানুষ। আরডিএর মহাপরিচালক এম এ মতিন জানালেন, ভূ-উপরিস্থ (সারফেস) পানি বিশেষ ব্যবস্থ্য়া ব্যবহার করা গেলে ভূ-গর্ভের পানির ওপর চাপ কমবে। আরডিএর গবেষণায় দেখা গেছে মাটির সেচ নালায় যে পানি অপচয় হয় তা রোধ করা গেলে সুপেয় পানির অভাব হবে না। যে কারণে উপরিভাগের পানি সেচ কাজে ব্যবহার ও মিঠা পানির জন্য ভূ-গর্ভের পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুরইলগঞ্জের এ প্রকল্প দেখভালকারী পরিচালক এস এম আব্দুল ওয়াহাব বললেন, দ্বৈত এ প্রকল্পে আর্সেনিক ও আয়রনমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ করা হবে। এখানেও প্রতি বাড়িতে সরবরাহ মিটার থাকবে। বগুড়া আরডিএ জানায়, বাগেরহাটে চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রে মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানির জন্য গবেষণা বিঘিœত হয়। আরডিএ রিভার্স অসমোসিস সিস্টেমে সেখানে মিঠা পানির ব্যবস্থা করে। এ পানিতে এখন গবেষণার পাশাপাশি পুরো ক্যাম্পাসে সুপেয় পানির ব্যবস্থা হয়েছে। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপেয় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেছে। আগে স্যালাইন ওয়াটারের আধিক্যে ক্যাম্পাসে বহুদূর থেকে পানি আনতে হতো। এখন পুরো ক্যাম্পাস লোনা পানিমুক্ত। এভাবে ওই এলাকার লোনা পানির এলাকাগুলোকে মিঠা পানিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। পরিচালক মাহমুদ হোসেন খান বললেন, বরেন্দ্র এলাকায় যেখানে মাটির গভীরেও শক্ত পদার্থ (পাথরসহ নানা কিছু) থাকার কারণে পানি সহজে মিলছে না সেখানেও পানির ব্যবস্থা করা গেছে স্টোন ক্র্যাশার ব্যবহারে। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপেয় পানির জন্য লো-কস্ট (স্বল্প ব্যয়ে) গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। আরডিএর পেটেন্ট এ নলকূপ দেশে পানি সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে। আরডিএ প্রমাণ করে দিচ্ছে কোন কারণে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পানি প্রাপ্তির উৎস দূষিত হলে আরডিএ বিশেষ ব্যবস্থায় প্রযুক্তি ব্যবহারে মিঠা পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে। পৃথিবী গ্রহে ৩ ভাগ জল একভাগ স্থল থাকার পরও বিশ্বজুড়ে মিঠা নিয়ে যখন মাথায় হাত পড়েছে, তখন বগুড়া আরডিএর নিরব গবেষণা বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ বসে নেই। পানির অপর নাম জীবন হলে বিশ্ব জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে একজন অধ্যাপক বললেন, যদি কখনও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় তাহলে তা হবে শুধু মিঠা পানির জন্য। বাংলাদেশ এ বিশ্বযুদ্ধ থেকে রেহাই দিতে পারে।
×