ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোটর সাইকেলে নয় দু’জন আরোহী

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

মোটর সাইকেলে নয় দু’জন আরোহী

অবরোধের ভেতর ঢাকার রাজপথে যে নাশকতাগুলো ঘটানো হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই মোটরসাইকেলের মাধ্যমে হয়েছে। পেছনে বসা আরোহী ছুড়ে দিয়েছে পেট্রোলবোমা, আর চালক দ্রুত সটকে পড়েছেন অলিগলি তস্যগলি দিয়ে। তাই সাময়িকভাবে ঢাকায় মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া অপর আরোহী বহন নিরুৎসাহিত করতে ব্যবস্থা নেন সড়ক চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরা। ঢাকার বৈধ মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮২৪টি। ১৯৮৩ সালের মোটর ভেহিকেলস অধ্যাদেশের ৮৮ ধারার ক্ষমতাবলে অর্থাৎ আইনের মাধ্যমেই এটি করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রচারণা চালানো হয়নি বলে রাস্তায় নেমে বহুজনই সমস্যায় পড়েন। চালকের সঙ্গীকে মোটরসাইকেল থেকে নেমে যেতে বাধ্য করা হয়। এটাকে সহজভাবে নিতে পারেননি অনেকেই। যদিও বৃহস্পতিবার এই ট্রাফিক তৎপরতা শুরু হওয়ার পরও আমি দেখেছি স্ত্রী-সন্তানকে মোটরসাইকেলে বসিয়ে গৃহকর্তা নির্বিঘেœই পথ চলছেন। ঢাকায় বহু বাবাই নিজ সন্তানদের স্কুলে আনা-নেয়া করেন মোটরসাইকেলে। তাদের কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অবশ্য এই সাময়িকভাবে চালু হওয়া নিয়ম অনেকেই ভালভাবে নিতে পারেননি। পাশাপাশি এটাও লক্ষণীয় যে, এরপর যে ক’টি নাশকতা চালানো হয়েছে সেগুলোয় আর মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়নি। তাই মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের সাময়িকভাবে কিছুটা ত্যাগ স্বীকারের উপকারিতা পাচ্ছেন ঢাকাবাসী। পথে পথে হাত পেতে থাকা অভাবী ঢাকায় ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে বহু দুস্থজন। শোনা যায়, ভিক্ষে করে বিল্ডিং পর্যন্তও নাকি তুলে ফেলেছে অনেক ভিখারি। মানুষ অবশ্য বাড়িয়ে বলতে পছন্দ করে। নাটক, নভেল ও হিন্দি সিনেমায় ভিক্ষুকদের নিয়ে বিচিত্র কেচ্ছা ফাঁদা হয়ে থাকে। শিল্প-সাহিত্যে যা কিছু আসে তার কিছু তো সত্য বটে। অস্কারজয়ী ফিল্ম সø্যামডগ মিলিওনিয়ারে শিশুদের বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করে অর্থোপার্জনের দৃশ্য রয়েছে। ঢাকার রাস্তায় অন্ধ কিংবা এক হাত বা এক পা-বিহীন অল্পবয়সী ভিক্ষুক দেখলে সেই দৃশ্য মনে পড়ে শিউরেও ওঠেন নিশ্চয়ই অনেকে আমার মতো। ভিক্ষাবৃত্তির ধরন বদলেও যাচ্ছে। মানুষ আর আগের মতো সদয় ও দানশীল নেই। তাই ভিক্ষুকরাও বিচিত্র কৌশল অবলম্বন করে ভিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। টাইপ করা কিছু কথা ফটোকপি করে বাসের ভেতর যাত্রীদের হাতে হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাহায্য চাওয়ার কৌশলটি একটু পুরনো হয়ে গেছে। প্রায় দেড় শ’ বছর আগে লেখা কালজয়ী মহান রুশ লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘অভাজন’ উপন্যাসে ঢাকার এ জাতীয় ভিক্ষুকদের অনুরূপ সাহায্যপ্রার্থীর সন্ধান মেলে। রুশ কথাশিল্পীর লেখাটি থেকে একটুখানি তুলে দিচ্ছি দুটো উদ্দেশ্যে। প্রথমত, জীবনের সত্য যখন আমরা সাহিত্যের ভেতর পাই তখন সেটি আমাদের বেশি আন্দোলিত করে। আমরা নতুন দৃষ্টিতে জীবনের দিকে ফিরে তাকাই। দ্বিতীয়ত, পথে পথে হাত পেতে থাকা অভাবীদের বিরাট অংশই যে নিরুপায় সহায় সম্বলহীন। অন্যের দয়ার ওপরেই যে তাদের জীবনযাপন নির্ভরশীলÑ এই বোধটুকু যেন আমরা খুইয়ে না বসি। লেখা থেকে উদ্ধৃতির আগে আমি সংক্ষেেেপ দুটো কথা বলে নিতে চাই। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ভিক্ষে না দেয়ার পেছনে আমাদের একটি ‘সদিচ্ছা’ কাজ করে। সেটি হলো তারা কাজ করতে নিরুৎসাহিত হবে, সহজে পয়সা পাওয়ার রাস্তায় তারা অভ্যস্ত হয়ে গেলে বিপদ। সেদিন সন্ধ্যায় ফুটপাথে মানুষের ফেলে দেয়া কোমল পানীয় এবং তেল বা পানির বোতল কুড়নো একটি কিশোর হঠাৎ আমার কাছে এসে বলল যে দুপুর থেকে তার কোন খাওয়া হয়নি। একটা পিঠা সে খেতে চায়। এরকম একটি আকুতি উপেক্ষা করা কি সম্ভব? নাকি সঙ্গত! যদি সে মিথ্যেও বলে থাকে তাহলেও অল্পবয়সী ছেলেটাকে বিমুখ করার জন্য কঠিন হওয়া লাগে। আমাদের অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব নয়। এখন আশপাশে পিঠা খুঁজেও পাওয়া গেল না। একবার ভাবলাম পিঠা খোঁজার চেয়ে পিঠার দাম দিয়ে দেয়া ভাল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো নগদ টাকা সে কোন বাজে অভ্যাসে যেমন ধূমপানেও তো ব্যয় করতে পারে। তাই পিঠা না হোক তাকে কোন একটি খাবার কিনে দেয়াই উত্তম। আরেকদিন এক বিকলাঙ্গ মধ্যবয়সী ভিক্ষুককে দেখলাম অনেক কষ্টে পিচের রাস্তার ওপর থেকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ফুটপাথে উঠছেন। কোন মানুষই ফিরে তাকাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত ঘরের হবে এমন দুটি শিশুকে দেখলাম পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে চোখ বড় বড় করে গোটা দৃশ্যটাই দেখল। শিশুমনে এ ধরনের দৃশ্য প্রতিক্রিয়া জাগায়। তার মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারলে শিশুর মনোজগতে বিরূপতা তৈরি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আদর্শ কোন নগর অবশ্যই ভিক্ষুকমুক্ত হবেÑ এমন কথা বইয়ে লেখা থাকতে পারে, বাস্তবে অসম্ভব। সুবেশধারী অভিজাত যে ব্যক্তিটি গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন, আর ট্রাফিক বাতি দেখে গাড়ি থামালে তার গাড়ির কাঁচে টোকা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যে ভিখারিÑ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে দু’জনেরই সমান নাগরিক সুবিধা পাওয়ার কথা। দু’জনেরই ভোট একটি করে, কারু অর্ধেক বা কারু দুটি নয়। সবচেয়ে বড় কথা দু’জনের রক্তের রঙ যেমন লাল, দু’জনের যেমন খিদে লাগে, ঘুম পায়; তেমনি দু’জনেই একটি করেই তো জীবন পেয়েছে যাপনের জন্য। তাই মানবিক রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামাজিক মানুষেরও দায় আছে দুস্থজনের প্রতি। এবার তুলে দিচ্ছি ‘অভাজন’ থেকে দুস্থজনের চালচিত্র : অর্গান-বাদকটা দাঁড়িয়ে ছিল কে জানে কাদের জানালার নিচে। নজরে পড়ল প্রায় বছর দশেকের একটি ছেলেÑ চেহারা ভালই, তবে দেখতে অসুস্থ, রুগ্ণ, গায়ে শুধু একটি শার্ট, প্রায় খালি পাÑ ছেলেটা হাঁ করে বাজনা শুনছেÑ বাচ্চা ছেলে তো! ওর হাতে এক টুকরো কাগজ। ... অর্গান বাদকের বাক্সে কে একজন ভদ্রলোক সামান্য একটা পয়সা ফেললেন। পয়সাটা পড়ার ঠনঠন শব্দে ছেলেটা চমকে উঠে ভয়ে ভয়ে চারপাশে চাইল। বোধহয় ভেবেছিল যে পয়সাটা আমিই দিয়েছি। ও দৌড়ে এলো আমার কাছে। বলল, চিরকুটটা পড়ে দেখতে। কাগজখানা খুলে দেখলামÑ যা থাকে তাইÑ মা মারা যাচ্ছে, তিন ছেলেমেয়ে আছে না খেয়ে, সহৃদয় ভাল মানুষরা আমায় সাহায্য করুন। ... মিথ্যে কথা সে আমায় বলেনি। না না, মিথ্যে কথা সে বলছে না, সে আমার ভালই জানা।... ছুটোছুটি করে ছেলেটা লোকের কাছে গিয়ে মিনতি করছে, কিন্তু লোকে চলে যাচ্ছে, ওর কথা শোনার মতো সময়ই নেই কারও। পাথরের হৃদয় ওদের, কথায় একটুও দয়ামায়া নেই : ‘দূর হ! ভাগ! চালাকি মারছিস!’ সবার কাছ থেকে শুধু এসব শুনে শুনে ছেলেটার মন হয়ে উঠবে কঠোর।... ঠা-ায় ওর কাশি শুরু হলো বলে; বেশি আর সবুর করতে হবে না, কুটিল সাপের মতো ওর বুকের মধ্যে সিঁধোবে রোগ। তারপর দেখতে না দেখতে মরণ এসে দাঁড়াবে ওর শিয়রে, কোন এক পুঁতিগন্ধ কোণে, ছেলেটাকে যতœ করা, সাহায্য করার মতো কেউ থাকবে না। এই হলো ওর গোটা জীবনখানা... ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ সধৎঁভৎধরযধহ৭১@মসধরষ.পড়স
×