ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে প্রাণের মেলা, এবার সবচেয়ে বড় পরিসরে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে প্রাণের মেলা, এবার সবচেয়ে বড় পরিসরে

মোরসালিন মিজান ॥ বই এবং বইয়ের মেলা নয় শুধু। বাঙালীর প্রাণের মেলা। লেখক- পাঠক-প্রকাশকের অদ্ভুত মিলন। আড্ডা। আদান-প্রদান। ফেব্রুয়ারির ১ থেকে শেষদিন পর্যন্ত চলে। বছর ঘুরে আবারও এসেছে সময়টি। আর মাত্র কয়েক দিন পর শুরু হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। ঘুরে আসা যাক ইতিহাসের পথ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বাররা। তাঁদের রক্তে নতুন প্রাণ পায় আমরি বাংলা ভাষা। ভাই হারানোর ব্যথা আর রাষ্ট্রভাষা বাংলার গৌরব ধারণ করেছে বইমেলা। এর নাম হয়েছেÑ অমর একুশে গ্রন্থমেলা। শুরুটা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউজের বটতলায় চট পেতে বসেছিলেন তিনি। সেখানে ৩২টি বই ছড়িয়ে রাখা ছিল। বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা এসব বই প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী)। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। সীমিত বই নিয়ে এই প্রকাশক একাই উদ্যোগটি অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৬ সালে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালে মেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করেন। বর্তমানে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। বিশাল পরিসরে মেলা আজ সারা দুনিয়ার বাঙালীর আবেগ- ভালবাসার অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ। প্রতিবারের মতো এবারও ১ ফেব্রুয়ারি মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাষার মাসের শেষদিন পর্যন্ত মেলা উন্মুক্ত থাকবে বইপ্রেমীর জন্য। লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মিলনমেলা আয়োজনে এখন যারপরনাই ব্যস্ততা যাচ্ছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিশেষ পরিবর্তন এসেছিল গতবছর। দুই আঙিনায় ভাগ করা হয়েছিল মেলাকে। সেই ধারাবাহিকতা এবারও পরিলক্ষিত হবে। মেলার সদস্য সচিব জালাল ফিরোজ জানান, পরিসর আরও বাড়বে এবার। বিগত যে কোন মেলার পরিসরের চেয়ে এই পরিসর শুধু বড় হবে না, কয়েকগুণ বড় হবে। বিশালায়তনের যে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান, এর প্রায় পুরোটাই ব্যবহার করা হবে। সব ঠিক থাকলে এখন পর্যন্ত একাডেমি আয়োজিত সবচেয়ে বড় পরিসরের মেলা হবে এটি। তিনি জানান, সব মিলিয়ে মেলার আয়তন বাড়ছে প্রায় ১০০০ বর্গফুট। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করে নেয়া হয়েছে। স্বাধীনতা স্তম্ভকে কেন্দ্র ধরে সাজানো হবে পরিসর। গ্লাস টাওয়ারটি রাখা হবে মেলার ভেতরেই। পূর্ব-উত্তর কোণ স্বাধীনতা স্তম্ভের ওয়াটারবডি ছাড়িয়ে আরও অনেকদূর যাবে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে প্রচুর গাছ। গতবছর এসব গাছ মেলার বাইরে রাখা হয়েছিল। এবার অভ্যন্তরে রেখেই মেলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গাছগুলো দিনেরবেলায় সবুজের স্নিগ্ধতা দেবে। রাতে সেখানে জ্বলবে নিয়ন আলো। বাংলা বর্ণমালা দিয়ে সাজানো হবে গাছের উপরিভাগ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলিয়ে এবার এক ইউনিটের স্টল থাকছে ১৫৫টি, দুই ইউনিটের ১১৫টি ও তিন ইউনিটের ৫২টি। তবে, মেলার পরিবর্তন দৃশ্যমান করবে প্যাভিলিয়ন। ১১টি দিয়ে শুরু হচ্ছে। একটি বাংলা একাডেমির। এটি আয়তনে বেশি হবে। বাকি ১০টি প্যাভিলিয়ন সাজাবেন প্রকাশকরা। এ তালিকায় আছে ইউভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল), অনুপম প্রকাশনী, আগামী প্রকাশনী, সময় প্রকাশন, মাওলা ব্রাদার্স, অন্যপ্রকাশ, অনন্যা, সাহিত্যপ্রকাশ, কাকলী প্রকাশনী ও পাঠক সমাবেশ। প্রতিটি প্যাভিলিয়নের আয়তন হবে ২০ ফিট বাই ২০ ফিট। প্যাভিলিয়ন আকর্ষণীয় করতে নকশার ওপর জোর দিয়েছেন প্রকাশকরা। তবে মেলার সৌন্দর্য ধরে রাখতে যেমন খুশি নকশা করার সুযোগ রাখা হয়নি। নিজ নিজ প্যাভিলিয়নের নকশা একাডেমিতে জমা দিয়েছেন প্রকাশকরা। পাসকৃত নকশায় গড়ে উঠবে প্যাভিলিয়ন। আয়োজক সূত্র জানায়, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মাঝখানে বিশাল জায়গা ফাঁকা রাখা হবে। জায়গাটি থেকে চমৎকার দৃশ্যমান হবে স্বাধীনতা স্তম্ভ। বিশাল এলাকা ঘুরে ক্লান্ত হলে থাকবে বসার ব্যবস্থা। বেশ কিছু আসনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে মেলায়। মেলার বাংলা একাডেমি অংশেও থাকছে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। এখানেই অনুষ্ঠিত হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মঞ্চে প্রতিদিন আয়োজন করা হবে গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বহেরা তলায় রাখা হবে লিটলম্যাগ চত্বর। বসবে ৭৫টি লিটলম্যাগ। শিশুদের জন্য এখানে থাকবে আলাদা কর্নার। সব ধরনের শিশুতোষ বই এখানে পাওয়া যাবে। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনও থাকবে এখানে। গত কয়েকদিন মেলার দুই অংশ ঘুরে দেখা যায়, পুরোদমে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে বলে আশা একাডেমি ও প্রকাশকদের। মেলায় ২৫ ভাগ ছাড়ে বই বিক্রি হবে। বাংলা একাডেমি বিক্রি করবে ৩০ ভাগ ছাড়ে। চারটি বিক্রয় কেন্দ্র থেকে একাডেমির বই বিক্রি হবে। মেলায় পাঠক যাতে নকল বই কিনে না ঠকে, সে জন্য প্রথম থেকেই টাস্কফোর্স সক্রিয় থাকবে। মেলা সম্পর্কে প্রকাশক নেতা ওসমান গনি বলেন, এবারের মেলা আরও সুন্দর হবে। সেভাবেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিগত দিনগুলোতে পাঠকের বই দেখার সুযোগ কম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, পরিসর বাড়ায় সে সমস্যা দূর হবে। বিশেষ করে প্যাভিলিয়নে বই দেখার দারুণ সুযোগ থাকবে বলে জানান তিনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা মেলায় প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মেলার আলাদা বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে একুশের চেতনা জুড়ে আছে। ফলে কোন অবস্থায়ই মেলার ক্ষতি করবে না বলে আশা করি আমরা।
×