ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গর্জে ওঠো বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

গর্জে ওঠো বাংলাদেশ

সকালে সব ক’টা পত্রিকা হাতে নিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আড়াই বছর বয়সের সাফির জামায়াত-বিএনপি জোটের দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কাতরাচ্ছে। সাফিরের বাবা-মা দু’জনই চিকিৎসক। গত রোবরার রাতে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় তাদের পরিবহন বাসে দুর্বৃত্তরা পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে বাসের দশজন আরোহী গুরুতরভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়। যাদের মধ্যে সাফির তো আছেই আরও আছে তার চিকিৎসক বাবা-মা। এই মুহূর্তে সাফিরের চিকিৎসক বাবা-মাও তাঁদের স্নেহের সন্তানের জন্য কিছু করতে পারছেন না। সন্তানের অবস্থা দেখে তাঁরা উভয়ই হতবিহ্বল। সাফিরকে ঘিরে তাঁদের অনেক স্বপ্ন ছিল। হয়তবা সব নিভে গেছে। শুধু একজন সাফিরের ছবি দেখেই দেশের মানুষ সকালে বাকরুদ্ধ হন না। প্রতিদিন আন্দোলনের নামে জামায়াত-বিএনপির সৃষ্ট ভয়াবহ সন্ত্রাসের কারণে অনেক সাফিরের জন্ম হচ্ছে। অনেক মা-বাবাই বাকরুদ্ধ হন। ফুটফুটে কিশোরী সাথী আক্তার আর যূথি আক্তার কলেজে ক্লাস করে বাসে তাদের বাসায় ফিরছিল। সংসদ ভবনের কাছে খেজুর বাগান এলাকায় তাদের বাস পৌঁছালে তাদের চলন্ত বাসে দুর্বৃত্তরা পেট্রোলবোমা ছুড়লে তারা দু’জনই গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে। প্রতিদিন টেলিভিশন খুললেই চলমান সন্ত্রাস নিয়ে সকলে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে কথা বলেন। এক দল এই সন্ত্রাসকে জায়েজ করার চেষ্টা করেন এই বলে বর্তমানে বিরোধী দলের একটি আন্দোলন চলছে সুতরাং যাঁরা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন তাঁদের তো কিছু অসুবিধা হতেই পারে! একটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলন করার অধিকার আছে কিন্তু তাই বলে তাদের আন্দোলনে সমর্থন আদায় করার জন্য পুড়িয়ে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, সাধারণ মানুষ, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা অথবা একজন দৃষ্টিহীন বৃদ্ধার একমাত্র কর্মক্ষম পুত্রটাকে একেবারে পুড়িয়ে মারতে হবে? যাঁর ডাকে দেশের বিরুদ্ধে এই নতুন উদ্যোমে যুদ্ধ সেই বেগম জিয়া হতে পারেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী অথবা দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দলের প্রধান কিন্তু সব শেষে তার বড় পরিচয় তো তিনি দুই সন্তানের একজন জননী। তাঁরও একজন কন্যা থাকতে পারত। এক রহস্যজনক পরিস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের গাড়িতে গুলি ছোড়া হলো। তিনি বেগম জিয়ার অফিস হতে ফিরছিলেন। এটি তার কাছের মানুষ ছাড়া অন্য লোকের পক্ষে তেমন জানা থাকার কথা না। আট থেকে দশজন দুর্বৃত্ত এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল বলে জানা গেছে। গাড়িতে গুলি ছুড়লে রিয়াজ রহমানের দেহের ওপরের অংশে লাগার কথা। ভাগ্যক্রমে কিভাবে যেন তা নিচের অংশে লেগেছে। তিনি দ্রুত গাড়ি হতে বের হয়ে গড়িয়ে রাস্তা পার হলেন। দুর্বৃত্তরা ইচ্ছা করলে তাঁর আরও বড় ক্ষতিও করতে পারত। করেনি। পুরো ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। এই হামলার রহস্য উন্মোচন হওয়া উচিত। রিয়াজ রহমান পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের একজন জাঁদরেল অফিসার ছিলেন। ছিলেন একাত্তরে দিল্লী হাইকমিশনে কর্মরত। একাত্তরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানী দূতাবাসের বাঙালী অফিসাররা পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছেন। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন গোপনে তিনি দিল্লী ছেড়ে করাচী চলে গেলেন। পরদিন পাকিস্তানের প্রত্যেকটি সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় এই সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। একজন ‘দেশপ্রেমিক’ পাকিস্তানী অফিসার কিভাবে ‘দেশদ্রোহীদের’ কব্জা হতে কৌশলে নিজ দেশে ফিরে এসেছেন। বিশ্বাস করতেন ২৫-২৬ মার্চের রাতে বাংলাদেশে দু’হাজারের বেশি মানুষকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করেনি। বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক জেনারেল খলিলুর রহমান তাঁর একাত্তরের স্মৃতিগ্রন্থে এসব ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় পাকিস্তান হতে ফিরে এসে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। তারপরও তাঁর ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার চাই। কোথা হতে তারা এসেছিল? কী বা তাদের উদ্দেশ্য? ক্ষমতার লড়াইয়ে কেউই অপরিহার্য নয়। বেগম জিয়া তাঁর দফতরে এখনও অবস্থান করছেন বলে তা চিন্তার কারণ। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ জন যাদের মধ্যে সাধারণ যাত্রী ১১ জন, আর পরিবহন শ্রমিক ১১ জন। তাদের সঙ্গে ৭ জন আছেন রাজনৈতিক কর্মী। ৩১ জনের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ১৫ জন। যানবাহন পুড়েছে ৫৭৫টি আর ভাংচুর করা হয়েছে ৩৭৯৫টি। চার দফা রেলে নাশকতা চালানো হয়েছে। শিবিরের উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘাতকরা বর্তমানে রাজধানীতে অবস্থান নিয়েছে বলে সংবাদপত্র খবর দিচ্ছে। বেগম জিয়ার অফিস থেকে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইতিমধ্যে তুলে নেয়া হয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলে বাড়ি যেতে পারেন। ধনুর্ভাঙ্গা পণ করেছেন তিনি তাঁর দফতরেই থাকবেন। এটি তাঁর ইচ্ছা। সাধারণত আদি কমিউনিস্টরা এমন ধারার জীবনযাপন করতেন। তিনি সাংবাদিকদের ডেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বাড়ি ফিরবেন না। তাঁর দাবি, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে এবং একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একাদশ সংসদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। মুস্কিল হচ্ছে তা সাংবিধানিকভাবে সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে শেখ হাসিনা আকুতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আসুন আমরা সব দল মিলে একটি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করি। তা করলে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রক্ষা হবে এবং প্রয়োজনে আর একটি সংসদ নির্বাচন করা যাবে।’ বেগম জিয়া শেখ হাসিনার সেই আহ্বানে পাত্তা তো দিলেনই না উল্টো বললেন, তারা নির্বাচনে তো যাবেনই না, এই নির্বাচনকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করবেন। তার সেই কর্মসূচীতে ১৪৮ জন মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যখন বেগম জিয়া একতরফা নির্বাচন করেছিলেন তখন বাংলাদেশের সব ক’টি রাজনৈতিক দল তা বর্জন করেছিল। এমন কি তাদের মিত্র জামায়াতও। অংশ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দল ফ্রিডম পার্টি। দশম সংসদ নির্বাচন তো বিএনপি ছাড়া যারা বর্জন করেছে তাদের প্রায় সবই ওয়ানম্যান পার্টি। অনেকে বলেন, হোন্ডা পার্টি। কর্নেল অলি ছাড়া নির্বাচনে বাকিদের জামানত থাকবে তেমন কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আর এখন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর তারা তো নির্বাচনই করতে পারবে না। গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন-টান্দোলন সব বাজে কথা। আসলে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা হতে বাঁচানো। কারণ এই মামলাটি বেগম জিয়ার জন্য খুবই দুর্বল। জামায়াতের যুদ্ধে শামিল হওয়ার কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হতে তাদের নেতাদের বাঁচানো। কেউ কেউ বলেন, বিএনপি একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনে জিতলে দেশে এমন কী লঙ্কাকা- ঘটবে? বেগম জিয়া তো ইতোমধ্যে বলেই দিয়েছেন, এরা সকলে রাজনৈতিক বন্দী। আর একদল সুশীল আছেন। এরা তামাদি রাজনৈতিক নেতা। অনেকে আবার নিজ দলে পরিত্যক্ত, একেবারে এতিম। কেউ কেউ মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এদের কোন লাভ নেই। নির্বাচনে দাঁড়ালে জামানত বাঁচানো অসম্ভব। লাভ একটাই। শেখ হাসিনাকে ফেলে দেয়া গেল। এদের কেউ কেউ আবার দেশে ও বিদেশে সার্বক্ষণিক গুজব ছড়াতে ব্যস্ত। শেখ হাসিনা সরকার পড়ে গেল বলে। তাহলে কে আসছে ক্ষমতায়? তৃতীয় শক্তি আর কী। খুলে বলেন না সেনাবাহিনী। ব্রিটেনের হাউস অব কমন্স তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বেগম জিয়াও তাই চান, তবে তা এখন আর সম্ভব নয়। একজন সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য একটি টিভি চ্যানেলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দলটির নব্বই ভাগ নেতাকর্মী নাকি সীমান্ত পাড়ি দেয়ার জন্য প্রস্তুত। শেখ হাসিনা এসব অর্বাচীনকে কেন যে রাস্তা হতে তুলে এনে সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন আল্লাহ্ মালুম। যুদ্ধের ময়দানে কমান্ডাররা কমান্ড পোস্টে অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বেগম জিয়া সম্ভবত এই যাত্রায় দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছেন তা তিনি আরও কিছুদিন তাঁর গুলশানস্থ অফিস থেকে পরিচালনা করবেন। আরও অনেক সাফিরকে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। দেশ আর জনগণ গোল্লায় যাক বেগম জিয়ার ক্ষমতা চাই। তাঁর দল এবং জোটের নতুন সেøাগান হোকÑ ‘চলুন আমরা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত বিধৌত বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাই।’ এমন অবস্থা হতে যদি পরিত্রাণ পেতে হয় তা হলে দেশের মানুষকেই গর্জে উঠতে হবে, যেমনটি ১৯৭১-এ উঠেছিল। দেশে এখন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এতে পরাজিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ২৪ জানুয়ারি, ২০১৫ লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক।
×