ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লালবাগ বিস্ফোরণ ॥ বাড়ির মালিকসহ আটক ১

অন্যকে মারতে বানানো বোমায় নিজেই মরল বোমারু বাপ্পী

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

অন্যকে মারতে বানানো বোমায় নিজেই মরল বোমারু বাপ্পী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে মানুষ হত্যার উদ্দেশে রাজধানীর লালবাগে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে আহত ছাত্রদল নেতা মাহবুবুর রহমান বাপ্পী ওরফে বোমারু বাপ্পীর মুত্য হয়েছে। ভাগ্যের পরিণতি বটে! অন্যকে মারার জন্য তৈরি করা বোমায় নিজেই মারা গেলেন এই ছাত্রদল নেতা। নিহত এই নেতার বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় বোমাবাজিসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে। লালবাগের ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় বাড়ির মালিকসহ ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে অন্তত ২০ জনকে। অন্যদিকে বনানীর ছাত্র শিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে গ্রেফতারকৃত শিবিরের প্রশিক্ষিত ৫ বোমা তৈরি, মজুদ ও সরবরাহকারীকে ৫ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা বোমা তৈরির কারখানাটি ছাড়াও বোমা তৈরির অর্থদাতাদের তালিকা দিয়েছে। তালিকা অনুযায়ী অভিযান চলছে। গত ২১ নবেম্বর বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর লালবাগ থানাধীন ঢাকেশ্বরী এলাকার ৩১/২ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে আহত হয় চারজন। পুলিশ জানায়, ওই ফ্ল্যাটটি পরিবার বসবাসের আড়ালে বোমা তৈরির কারখানা বানানো হয়েছিল। বাড়িতে বোমা তৈরি করে মজুদ রাখা ছিল। বুধবার বোমা তৈরির সময় একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে মজুদ করে রাখা অন্য বোমাগুলোও বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে আহত হয় ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক বাপ্পী, তার বোন ঝুমুর বেগম (৩৫), বাপ্পীর ভাগ্নি আজিমপুর গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী হ্যাপি আক্তারসহ (১৩) ওই বাসায় বেড়াতে আসা হ্যাপির খালাত ভাই রিপন (৬)। আহতদের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। আহতদের মধ্যে বাপ্পীর হাতের কব্জি উড়ে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। বিস্ফোরণে বাড়িটির দ্বিতীয় তলার আসবাবপত্র, দরজা-জানালা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। আগুন ধরে গেলে পুড়ে যায় কাপড়চোপড়সহ ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্র। বৃহস্পতিবার ভোর চারটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাপ্পীর মৃত্যু হয়। তার পিতার নাম আব্দুল মান্নান। বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানাধীন দেবপুর গ্রামে। জন্ম ঢাকার কাঁটাবন এলাকায়। বাপ্পীর মৃত্যুর পর ঘটনার বিষয়ে নিহতের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কেউ মুখ খুলেনি। অনেকেই বাপ্পীকে লুকিয়ে দেখে চলে গেছেন। আত্মীয়স্বজনরাও বাপ্পীর পরিচয় দেননি। বাড়ির মালিক গ্রেফতারকৃত আবুল কাশেমের স্ত্রী সুফিয়া বেগম জানান, মাস দুয়েক আগে বাপ্পীর বোনজামাই চালক আব্দুল হাকিম মাসিক আট হাজার টাকায় দুই রুমের ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। চলতি মাস থেকে তারা বসবাস করছেন। বাপ্পী বোনের সঙ্গে থাকত। বিক্রমপুরের বাসিন্দা বাপ্পীর বোনজামাই আজিজুল হাকিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসির আরাফাত জনকণ্ঠকে জানান, নিহত বাপ্পীর বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় ২টি বোমাবাজি, যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও মারামারিসহ মোট ৫টি মামলা আছে। ৪টি মামলার চার্জশীটভুক্ত পলাতক আসামি ছিল বাপ্পী। আহত ছোট্ট শিশু রিপনের মা লিপি আক্তার জানান, তার স্বামীর নাম নাজিম উদ্দিন বাচ্চু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাবন মার্কেটে পাখির ব্যবসা করেন। এলিফ্যান্ট রোডে একই বাসায় ভাড়া থাকার সুবাদে বাপ্পীর বোন ঝুমুরের সঙ্গে সখ্য হয়। সেই সূত্র ধরেই ঝুমুরের মেয়ে হ্যাপি তার ছেলে রিপনকে তাদের বাসায় নিয়ে যায়। দুপুরে তারা খাওয়াদাওয়া করছিল। আর এ সময় বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। তার ছেলে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে আশঙ্কা প্রকাশ করেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। হ্যাপি জানান, দুপুরে তারা ভাত খাচ্ছিল। এ সময় তার মামা বাপ্পী খাটের ওপর বসে কি করছিলেন। এ সময় বিস্ফোরণ ঘটে। লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় বাপ্পীর সঙ্গে তার বোন ঝুমুর ও ভগ্নিপতি আজিজুল হাকিমসহ অজ্ঞাত আরও ৪ থেকে ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। বাপ্পী সুস্থ হলে তার জবানবন্দী রেকর্ড করার কথা ছিল। চিকিৎসাধীনদের জবানবন্দী রেকর্ড করা হবে। ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ জানান, বাপ্পী বোমারু বাপ্পী হিসেবে পরিচিত। সে বোমাবাজির পাশাপাশি বোমা তৈরি, মজুদ ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত ছিল। চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচীতে নাশকতা চালাতেই বাসায় বোমা তৈরি করে মজুদ করছিল। এদিকে গত ২০ জানুয়ারি দিবাগত রাত চারটার দিকে রাজধানীর বনানী মডেল থানাধীন মহাখালী টিবি গেট এলাকার চ-ব্লকের ১৩৩/১ নম্বর আমিনুল ইসলাম ভিলা নামের পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ছাত্র শিবিরের একটি বোমা তৈরির কারখানা থেকে ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা তৈরির জন্য মজুদ রাখা দুই লিটার পেট্রোল, ১০ কেজি পাথরের কুচি, এককেজি গান পাউডার, ১২ টি নতুন স্কচটেপ, ৩ কেজি প্যারেক, ৩ বান্ডিল তুলা, ৪৮টি বোমার তৈরির কৌটা, জর্দা, ১২ টি ম্যাগাজিন, জিহাদী বই, ২৭ টি খাকি খাম ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী এবং অর্থদাতাদের নাম সংবলিত ছোটবড় চারটি রেজিস্টার উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেফতার হয় বনানী থানা ছাত্র শিবিরের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (২৩), জয়নাল আবেদিন (২০), আরিফুজ্জামান আরিফ (১৮), আতিয়ার রহমান (২২) ও খালিদ সাইফুল্লাহ (২০)। গ্রেফতারকৃতদের ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েই সেখানে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করে গ্রেফতারকৃত ছাত্র শিবিরের প্রশিক্ষিত বোমা প্রস্তুত, মজুদ, সরবরাহকারী ও বোমাবাজরা। এ ব্যাপারে বনানী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভুইয়া মাহবুব হাসান জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত অর্থদাতাদের নামের তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতার অভিযান চলছে। প্রসঙ্গত, গত ৫ জানুয়ারি বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কায় সমাবেশ করার অনুমতি না পেয়ে পরদিন থেকেই দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধের ডাক দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অবরোধে সারাদেশে ভাড়াটে বোমাবাজদের দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে অবরোধে বোমা আর পেট্রোলবোমা হামলায় সর্বশেষ পুরনো ঢাকার সরকারী কবি নজরুল ইসলাম কলেজের ছাত্র অভিসহ ৩১ জনের মৃত্যু হলো। এছাড়া গত বুধবার অবরোধে নাশকতা চালানোর উদ্দেশে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে আহত বাপ্পীর মৃত্যু হয়। অন্যদিকে গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে পুলিশভ্যানে বোমা হামলায় ১৪ পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনায় গত ১৮ জানুয়ারি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় অন্যতম বোমা হামলাকারী নড়াইল জেলার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা প্রশিক্ষিত বোমাবাজ, বোমা তৈরি, মজুদ ও সরবরাহকারী এবং ডজনখানেক মামলার আসামি ইমরুল কায়েস। এছাড়া পুলিশভ্যানে বোমা হামলার ওই ঘটনায় গত ১৯ জানুয়ারি আরেক বোমাবাজ খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনিও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। দুইটি ঘটনাস্থল থেকেই বোমা, পিস্তল, বুলেটসহ পেট্রোলবোমা উদ্ধার হয়। এ নিয়ে অবরোধ সংক্রান্ত ঘটনায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
×