ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতিও

প্রকাশিত: ০২:৫৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি  হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতিও

গত সপ্তাহে অনেক বড় অর্থনৈতিক খবর ছিল। এর মধ্যে একটি তো সকলের জন্যই ছিল খারাপ। আর সেটা হচ্ছে অবরোধজাত অর্থনৈতিক কুফল। এ সম্পর্কে গত শুক্রবারের কলামে লিখেছি। লিখেছি কৃষকদের দুঃখের কথা। তারা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের ফসল কিভাবে মাঠেই নষ্ট হচ্ছে এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অর্থনীতির বড় বড় খাতের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করেছি। তখনও আমার ধারণা ছিল বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী অচিরেই প্রত্যাহার করা হবে। না, তা হয়নি। বরং এটা চলছে, চলছে সন্ত্রাসী এবং নাশকতামূলক ব্যাপক কর্মকা-। অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি হচ্ছে মানবিক ক্ষতি, যার কোন আর্থিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এ সপ্তাহের শুরুতে দেখা যাচ্ছে আরেক বিপদ। সেটা চাল নিয়ে। চাল ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কপি, আলু নয়। ঝিঙ্গা ও চিচিঙ্গা বুধবারে কিনলাম ৮০ টাকা কেজি দরে। এগুলো ইউরিক এ্যাসিডের রোগীর খাদ্য। অতএব উপায় নেই। কিন্তু তবু মানুষ না হয় সবজি কম খাবে। মাছও কম খাবে। কিন্তু চাল? চালের কী হবে? খবরে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় চালের সরবরাহ কমে আসছে। উত্তরবঙ্গ থেকে চালের ট্রাকের আগমন সংখ্যা দশ-বিশ শতাংশে নেমে এসেছে। স্টক দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যেই কেজিতে চালের দাম ৫-৮ টাকা বেড়েছে। এর ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। বহু কষ্টে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির হারটা ৫-৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। এর মধ্যে বড় অবদান ছিল খাদ্য খাতের। খাদ্যশস্য, শাক-সবজি ইত্যাদি মূল্য হ্রাসের ফলেই মূলত মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছিল। হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে- এতে কোন সন্দেহ নেই, অথচ গত সপ্তাহেই একটা ভাল খবর ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর। দেশীয় কোন ‘চিন্তার পুকুরের’ নয়, খোদ বিশ্বব্যাংকের যারা আবার দেশীয় পোষ্যদের অর্থায়ন করে। বিশ্বব্যাংক তার পূর্বের পূর্বাভাস বাদ দিয়ে এখন বলছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৭ শতাংশে উন্নীত হবে। উল্লেখ্য, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে অর্থনীতির উন্নয়নের গতি উর্ধমুখী আছে। কিন্তু হরতাল-অবরোধ এভাবে চলতে থাকলে এই প্রবৃদ্ধিতে যে বিঘœ ঘটাবে তাতে সন্দেহ নেই। কোন সুস্থ চিন্তার মানুষ অথবা দায়িত্বশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠী কী করে এটা চায় তা ভাবতেও অবাক লাগে। হরতাল-অবরোধজাত অর্থনৈতিক খবর বাদে গত সপ্তাহে একটা বড় খবর ছিল ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর)-এর ওপর। ঐ খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘কর আহরণে ৫ হাজার কোটি টাকার ফারাক।’ খবরের ভেতরে বলা হচ্ছে ‘এনবিআর’ বলছে গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৩-১৪তে শুধু আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর খাতেই রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৩ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। কিন্তু হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের দফতর বলছে, প্রকৃত অর্থে এই খাতে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে মাত্র ৩৮ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। বিশাল ফারাক। বলা হচ্ছে, ভ্যাট ও শুল্ক খাতের হিসাব যোগ করলে এই ফারাক আরও বৃদ্ধি পাবে। এ খবর পাঠ করে বোঝা কঠিন কে ঠিক কে বেঠিক। কিন্তু খবরটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তা বড় দুঃসংবাদ একদিকে, আরেকদিকে তা ‘এনবিআর’-এর ওপর কালো ছায়া ফেলে। এমতাবস্থায় জাতীয় রাজস্ব বিভাগ বছরের পর বছর যে হিসাব দিয়ে যাচ্ছে তার ওপরও সন্দেহ স্থাপন করা চলে। এটা কী তাদের সাফল্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলার ফল? এটা কী এ্যাকাউন্টিংয়ের ‘মিসম্যাচ’? না রিকনসিলিয়েশনের সমস্যা? হতে পারে হিসাবরক্ষকরাই ভুল তথ্য দিচ্ছেন। সাধারণভাবে হিসাবরক্ষক এবং নিরীক্ষকরা বড় রক্ষণশীল হন। তাঁরা নানা কারণে ছোট ছোট সমস্যাকে বড় করে দেখেন এবং তা কাগজে প্রকাশ করার চেষ্টা চালান। আমি জানি না আসল ঘটনাটা কী? টাকা তো এক-দুই টাকা নয়, ৫ হাজার কোটি টাকা। সরকারের টাকার টানাটানি আছে বলে আমার ধারণা। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছে। আমদানি-রফতানিতে প্রবৃদ্ধির হার আশানুরূপ নয়। এর প্রভাব রাজস্ব আদায়ে পড়বে। এটা হলে আয়কর আদায়েও বিঘœ ঘটবে, অথচ সরকারের টাকা দরকার বেশি করে। পদ্মা সেতুর কাজ হাতে। আমাদের অঙ্গীকার নিজের টাকায় আমরা পদ্মা সেতু করব। অতএব ৫ হাজার কোটি অনেক বড় টাকা। আমি মনে করি, যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টির ওপর নিরীক্ষা হওয়া দরকার, যাতে প্রকৃত চিত্র আমরা পাই। সপ্তাহের শেষের দিকের বড় খবর হঠাৎ করে একটা। কাগজে খবর হলো এক টাকা ও দুই টাকার নোট উঠে যাবে এবং পাঁচ টাকার নোট হবে সর্বনিম্ন সরকারী নোট। খবরটি মাঠে মারা গেল পরের দিনই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো সব মুদ্রা ও নোটই বাজারে চালু থাকবে। অর্থাৎ বর্তমানে যা যা বাজারে চালু আছে তা তাই চালু থাকবে। বাজারে কী কী ধাতব মুদ্রা ও কাগুজে নোট চালু আছে? বর্তমানে বাজারে ১. সরকারের ধাতব মুদ্রা হিসেবে বাজারে আছে এক পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা, এক টাকা ও দুই টাকার কয়েন। ২. সরকারের কাগুজে নোট বাজারে আছে এক টাকার ও দুই টাকার। ৩. বাংলাদেশ ব্যাংকের কাগুজে ৫ টাকার নোট ও ধাতব মুদ্রা এবং ৪. দশ টাকা, বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা, একশত টাকা, পাঁচশত টাকা এবং হাজার টাকার কাগুজে নোট আছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের। দেখা যাচ্ছে, পাঁচ টাকা এবং তদুর্ধ সব টাকা তা ধাতবই হোক আর কাগুজেই হোক এসব বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বে প্রচলিত। এর নিচের ধাতব মুদ্রাই হোক আর কাগুজে নোটই হোক এসব বাংলাদেশ সরকারের টাকা। যারই হোক টাকা অথবা পয়সা, ধাতবই হোক আর কাগুজেই হোক সব বাজারে চালু হয় বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি-জাতীয় দুটো বিভাগ আছেÑ একটা ইস্যু বিভাগ, আরেকটা ব্যাংকিং বিভাগ। এখানে উল্লেখ্য, মুদ্রা প্রচলনের বিষয়টি একটি আইনের অধীন। এটা কারও স্বেচ্ছাধীন নয়। আইনটির নাম সম্ভবত ‘কারেন্সি এ্যাক্ট’ অথবা ‘কয়েনেজ এ্যাক্ট’ যা সংসদের তৈরি। এসবে পরিবর্তন আনতে হলে সরকারী নির্দেশে হবে না। আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। তারপর তা কার্যকর করতে হবে। যেহেতু কোন আইনের বিধান পরিবর্তিত হয়নি তাই এক পয়সার ধাতব মুদ্রা থেকে দুই টাকার মুদ্রা পর্যন্ত সবই বাজারে চালু থাকবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এসবের মধ্যে নিম্নতম মূল্যের ধাতব মুদ্রাগুলোর বাজারমূল্য এখন কার্যত নেই। বাজারে এক পয়সা, দুই পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সার ব্যবহার নেই। কিন্তু পঞ্চাশ পয়সার মুদ্রা এখনও কাজে লাগে। সরকারের অনেক বিল যেমন টেলিফোন, বিদ্যুত ইত্যাদি বিল এখনও পয়সায় হয়। ব্যাংকের সুদের হিসাবে এখনও পয়সার হিসাব আছে। এগুলো বিলীন হয়ে যায়নি। অবশ্য সময়ের প্রশ্ন। ধীরে ধীরে অনেক কিছুই হবে। অর্থনীতির নিয়মেই সব হবে। যাক আশার কথা টাকা-পয়সা সংক্রান্ত একটা বিভ্রান্তির অবসান হয়েছে। ব্যাংকের ওপর একটা ভাল খবর দেখলাম গত সপ্তাহে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে চিঠি লিখেছে ব্যাংকের মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা করতে। এটি করতে হলে হাইকোর্টে বিশেষ বেঞ্চের দরকার। উল্লেখ্য, হাজার হাজার মামলা হাইকোর্টে বড় বড় ঋণগ্রহীতারা রিট করে আটকে রেখেছে। ব্যাংক তার অনাদায়ী ঋণের টাকা আদায়ে মামলা করে বিশেষ আদালতে অর্থাৎ অর্থঋণ আদালতে। চতুর ঋণগ্রহীতারা একটা রিট করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রাখে। এর একমাত্র সমাধান বিশেষ বেঞ্চ যে বেঞ্চ শুধু ব্যাংকের মামলা দেখবে। এর যদি ব্যবস্থা হয় তাহলে ব্যাংকের প্রচুর অনাদায়ী ঋণ আদায়ের পথ সুগম হবে। বলাবাহুল্য, যেসব মামলা অর্থঋণ আদালতে যায় সেই সমস্ত ঋণের বিপরীতে ব্যাংক পূর্বাহ্নেই সম্পূর্ণ ‘প্রভিশন’ করে রেখেছে। শতভাগ ‘প্রভিশন’ করা না থাকলে একটি ঋণকে ব্যাংক ‘ব্যাড এ্যান্ড লস’ শ্রেণীতে ফেলতে পারে না এবং মামলাও করতে পারে না। অতএব ব্যাংকের মুনাফা থেকে টাকা কেটে ‘ঋণক্ষতির’ সমান প্রভিশন রেখে তারপর মামলা করতে হয়। এমতাবস্থায় যদি অর্থঋণ আদালতে মামলার নিষ্পত্তি নির্বিঘœ হয়, যদি হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় তাহলে ঋণের টাকা আদায় সহজতর এবং দ্রুততর হবে। এতে পুরো ‘প্রভিশনের’ টাকা ব্যাংক ফেরত পাবে অর্থাৎ তার মুনাফা বাড়বে। মুনাফা থেকে পূর্বাহ্নে কেটে রাখা টাকা আবার মুনাফায় যোগ হবে। এতে সরকারের কী লাভ? লাভ আছে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে যে টাকার মামলাই অর্থঋণ আদালতে অনিষ্পন্ন আছে তার সিংহভাগ মামলা সরকারী ব্যাংকের। মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত হলে সরকারী ব্যাংকের মুনাফা বাড়বে। মুনাফা বাড়লে তার ভাগীদার হবে একমাত্র সরকার। সরকারের টাকার অভাব আছে বলে আগেই আমি উল্লেখ করেছি। এর খবর হচ্ছে বিশ্বব্যাংক তার দুটো ঋণ দিতে গড়িমসি শুরু করেছে। এই দুটো ঋণের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৮০ কোটি ডলার। ৮০ টাকা দরে এর পরিমাণ হবে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। আমরা যদি রাজস্ব বোর্ডের হিসাবের সঙ্গে (যার কথা আগে উল্লেখ করেছি) হিসাবরক্ষকের হিসাব মেলাতে পারি তাহলেই তো পেয়ে যাই ৫ হাজার কোটি টাকা। আর যদি হাইকোর্টে বেঞ্চ করে দ্রুত রিটগুলো নিষ্পত্তি করা যায় তাহলে আমার ধারণা ব্যাংকিং খাত থেকে এ বছরেই সরকার পেতে পারে আরও ৪-৫ হাজার কোটি টাকা। জানি না মাননীয় উচ্চ আদালত এর ব্যবস্থা করতে পারবে কিনা। করতে পারলে রাজস্ব টাকার টানাটানি থেকে বেশ কিছুটা মুক্তি পাবে। নতুন মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে প্রত্যাশা তিনি এ বিষয়টিতে সদয় দৃষ্টি দেবেন। এতে সরকার ও দেশ শুধু আর্থিকভাবে লাভবান হবে না, খেলাপী সংস্কৃতিও বাধাপ্রাপ্ত হবে। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×