ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৫

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

এটা খুবই স্বাভাবিক যে, বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা বিপর্যস্ত এবং ক্রুদ্ধ। হতাশ হয়ত নয়, হতাশ হলে রাজনীতিতে টিকে থাকা মুশকিল। বিপর্যস্ত হওয়ার কারণ একটাই, তারা জানে না যে, কী কারণে শিশু হত্যা করতে হবে, বা মানুষ পোড়াতে হবে? কিন্তু, সদর দফতরের নির্দেশ। গত দুই সপ্তাহ তারা নিজেরা অর্থাৎ বিএনপি কর্মীরা, জামায়াত কর্মীরা শিশু-নারী হত্যা, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ হত্যায় অংশ নিয়েছে। এ জন্য অর্থ দিয়ে তারা পেশাদার সন্ত্রাসীদের নিয়োগ করেছে। তাদের আক্রমণে মারা গেছে প্রায় ৩০ জন। অগণিত আহত। বাস-ট্রাক পোড়ানো হয়েছে অনেক। এ সবই গণতন্ত্রের নামে। গণতন্ত্র যদি এমন হয় তাহলে অগণতন্ত্র কেমন? বিএনপি-জামায়াত ও তাদের মিত্র ফক্সওয়াগন পার্টিসমূহের সন্ত্রাসী আন্দোলনের সূত্রপাত ৭ দফা দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে। কিন্তু তার কথা সবাই ভুলে গেছে। এখন আলোচনা হচ্ছে, গণতন্ত্র রক্ষায় সংলাপ জরুরী এবং তারপর জরুরী নির্বাচন। বিএনপি-জামায়াত বা ‘২০ দলীয়’ জোটের এ্যাপলজিস্টরা বক্তৃতা-বিবৃতি ও টকশোর মাধ্যমে যে কথাটি বার বার বলছেন তা’হলো, বিএনপি-জামায়াত গণতন্ত্র রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী। তাদের শর্তে গণতন্ত্র রক্ষায় আলোচনায় বসতে হবে এবং তারা যে সব শর্ত দিয়েছে তা মানলেই আলোচনা অর্থবহ হবে এবং গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে। আর এই যে সন্ত্রাস চলছে [তাদের ভাষায় আন্দোলন] তার কারণ গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ। সাত দফা দাবির কথা এখন আর কেউ বলেন না। কিন্তু, এই দাবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক, সরকার আলোচনায় বসল। তখনই বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হবে আলোচনা হবে সাত দফার ভিত্তিতে। এই দফাগুলো নতুন কিছু নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই বিএনপি এসব দাবির কথা তুলছে। বেগম জিয়া ‘আন্দোলন’কে ‘বেগবান’ করার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে এখন তা তুলে ধরেছেন মাত্র। সুতরাং, সেই সাত দফা আগে আমাদের পর্যালোচনা করা দরকার। ভেবে দেখা দরকার এগুলো যৌক্তিক কিনা। আরেকটি বিষয় বিচার্য। সরকার তো সেই সাত দফা অগ্রাহ্য করেই নির্বাচন করেছে। সুতরাং, তারা যদি সংলাপে বসে তা’হলে তো সাত দফার দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করা হয়। ১৪ দলের নেতারা এটা বোঝেন না, এটি বললে ভুল হবে। কিন্তু বিএনপি এ্যাপলজিস্টরা যেভাবে বলেন তা অনেকের কাছে যৌক্তিক মনে হতে পারে। এর বিপরীতে যারা টকশোতে যান তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব দাবির অসারতা প্রমাণে ব্যর্থ হন। আগ্রহী শ্রোতা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শ্রোতারা তাতে নিমর্ষ হন। সে জন্য প্রথমে সেই সাত দফা ও তার যৌক্তিকতা নিয়ে পর্যালোচনা করা শ্রেয়। খালেদা জিয়া গত বছরের শেষ দিনে সাংবাদিক সম্মেলন করে সাত দফা ঘোষণা করেন। সেগুলো হলো ১. জাতীয় সংসদের নির্বাচন অবশ্যই একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে, যাতে সব রাজনৈতিক দল তাতে অংশ নিতে পারে এবং সব পক্ষের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সুযোগের সমতা নিশ্চিত হয়। ২. নির্বাচন ঘোষণার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ, দক্ষ, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) প্রয়োজনীয় সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠপর্যায় থেকে পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তব্যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী আইন ও বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত এবং ভোটার তালিকার ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা সম্ভব হয়। ৩. নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হবে এবং প্রতিদ্বন্বী পক্ষগুলোর সম্মতিক্রমে গঠিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দায়িত্ব নেবে। ৪. নির্বাচনের উপযোগী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারিখ ঘোষণার পরপরই বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করতে হবে। ৫. নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরুর আগেই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালন করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট ও বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত সদস্যদের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে প্রত্যাহার এবং কর্তব্য পালন থেকে বিরত রাখতে হবে। ৬. সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ৭. বর্তমান সরকারের আমলে বন্ধ করে দেয়া সব সংবাদপত্র ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দিতে হবে। মাহমুদুর রহমানসহ আটক সব সাংবাদিককে মুক্তি দিতে হবে। [দৈঃ কালের কণ্ঠ ১.১.২০১৫] এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় মন্তব্য করা প্রয়োজন। কেননা, সাত দফার পটভূমি ২০১৪ সালের নির্বাচন। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেন, ‘অবৈধ এ সরকার আগে সাংবিধানিক প্রয়োজনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে আলোচনার অঙ্গীকার করলেও এখন তা মানছে না।’ [ঐ] সাংবাদিকরা জানতে চান এ অঙ্গীকার লিখিত ছিল কিনা। তিনি বলেন, না, সবার সামনে বলা হয়েছে সেটিই অঙ্গীকার। প্রথম কথা নির্বাচনের সাংবিধানিক প্রয়োজন ছিল বলে তিনি মনে করেন কিনা। তার বক্তব্যে মনে হয়, তিনি মনে করেনÑ ছিল। কারণ, তিনি বলছেন, সাংবিধানিক প্রয়োজনের কথা বলে অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তিনি যদি মনে করেন সাংবিধানিক প্রয়োজন ছিল না, বদলে সামিরক সরকার হলেও আপত্তি নেই, তা তা’ হলে অন্য কথা। এটি মানলে, আলোচনার প্রয়োজনও থাকে না। কিন্তু সাংবিধানিক প্রয়োজন ছিল বলে যদি মনে করেন তাহলে তিনি নির্বাচনে গেলেন না কেন? নির্বাচন তো তিনি বয়কট করেননি, সশস্ত্র পন্থায় নির্বাচন প্রতিহত করেছেন এবং নির্বাচন হওয়ার পর তাকে অবৈধ বলেছেন। সরকারকেও তারা অবৈধ মনে করেন। অবৈধ মনে করলে এত আলোচনার আহ্বান কেন? তারা যখন এতই শক্তিশালী তখন সরকারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেই হয়। বিএনপি যদি সশস্ত্রভাবে নির্বাচন প্রতিহত না করত এবং সরকার ও নির্বাচনকে অবৈধ না বলত, তা হলে সরকার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে এ কথাটা জোরালোভাবে বলা যেত। ১৪ দল এখন বলতেই পারে নির্বাচন ও সরকার যখন অবৈধ তখন আর অঙ্গীকার রাখা না রাখার কথা আসে কেন? আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না। বাঙালীর স্মরণশক্তি কম তাই এ কথা বলছি। ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের শেষ মুহূর্তে তিন দলীয় জোট একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছিল। ঐ অঙ্গীকারপত্রে খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা ও রাশেদ খান মেনন সই করেছিলেন। নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এল জামায়াতের সমর্থনে এবং স্বাক্ষরিত চুক্তিনামার প্রতিটি শর্ত ছুড়ে ফেলে দিল। লিখিত অঙ্গীকারনামা ছিল সেটি। তিনি লিখিত অঙ্গীকারনামা অস্বীকার করেন, তিনি যখন অপরের অঙ্গীকারের কথা বার বার আমাদের মনে করিয়ে দিকে চান, তখন ব্যাপারটা অদ্ভুত ও অযৌক্তিক ঠেকে। বিএনপি লিখিত অঙ্গীকারনামা মানেনি দেখে আওযামী লীগ অলিখিত অঙ্গীকারনামা মানেনি। এই রাজনৈতিক কৌশল বিএনপির কাছ থেকেই শেখা। সেই নির্বাচন প্রসঙ্গে আরেকটু বলতে চাই। নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত এ্যাপলজিস্টরা বার বার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলেছেন। নির্বাচনের পর বলেছেন, একতরফা নির্বাচন। ভোটারবিহীন নির্বাচন। অনেক লেফটিও সে কথা বলেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইইউ তাদের সমর্থন করেছে। এখনও বিএনপি-জামায়াত এ্যাপলজিস্টরা একই কথা বলছেন কিন্তু বিদেশী রাষ্ট্রগুলো সে কথা তুলছেই না। কেন? সে প্রসঙ্গটির বুঝতে হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে পর্যালোচনা করলে। (চলবে) দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? নির্বাচনের আগে সুশীল সুজনরা ও আমরা যারা নির্বাচনের পক্ষে ছিলাম তাদের অনেককে গালমন্দ করেছেন। যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী খুব বেশি টক শোতে যান না তিনিও সোচ্চার ছিলেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকী ছিলেন। রাষ্ট্রদূতরাও হুমকি ধমকি দিচ্ছিলেন। সুশীলদের হুমকি-ধমকিতে সরকার কর্ণপাত করেনি। পাকিস্তান, আমেরিকা, ইইউকে দিয়েও অনেক হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা কোন কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। তারা ভেবেছিল, আমেরিকা বাংলাদেশকে বাধ্য করতে পারবে তাদের কথা শুনতে। সেটি হয়নি। ৩-৪ তারিখেও তাই তারা নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়েছিল,সরকার কর্ণপাত করেনি। এটি তাদের আত্মম্ভরিতায় ঘা দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। কয়েক শ’ মানুষ হত্যা করেছে। ১০০০-এর বেশি যানবাহনে আগুন দিয়েছে। কিন্তু তারপরও নির্বাচন হয়েছে। এটি তাদের স্তম্ভিত করেছে। তারা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা বেশি বলেন তুলনা হিসেবে। কিন্তু একটি বিষয় বোঝা দরকার। বেগম জিয়া বাধ্য হয়েছিল নতুন নির্বাচন দিতে। কারণ, মানুষ ছিল রাস্তায়, প্রশাসনও নেমে এসেছিল রাস্তায়, তার হুকুম তামিল করার মতো কেউ ছিল না। তার পক্ষের মানুষজনও রাস্তায় নামেনি। ২০১৪ সালেও জামায়াত-বিএনপির পক্ষে ব্যাপকভাবে রাস্তায় মানুষ নামেনি, প্রশাসন সরকারের [নির্বাচন কমিশন] নির্দেশ মেনেছে, ১৪ দলের পক্ষের মানুষজনও প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিল, অন্তত শহরাঞ্চলে। সে কারণে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনপরবর্তী অবস্থা ও ২০১৪ সালের নির্বাচনপরবর্তী অবস্থা এক নয়। হলে নির্বাচনের পর পরই মানুষ রাস্তায় নামতেন এবং খালেদার মতো ১১ দিন পর নির্বাচন দিতে বাধ্য হতেন। সেটি তো হয়নি। সুতরাং যে সব সুশীল বাটপাড় ও এ্যাপলজিস্ট ১৯৯৬ সালে খালেদা প্রদত্ত নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন তা ধোপে টেকে না। ২০১৪ সালে বিএনপি জামায়াতের প্রবল নৃশংসতা ছিল ১৯৭১ সালের মতো। এসব ঘটনা ১৯৭১-এর স্মৃতিকে জাগরূক করেছিল। অতীত দিয়ে মানুষ বর্তমানকে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং তারা দেখেছেন যে, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯১, ২০০১Ñ সব সময় এরা সন্ত্রাস চালিয়েছে বিরোধীদের দমন করার জন্য, খুন করতে পিছপা হয়নি। এদের ক্ষমতায় আনলে আবার ২০০১ বা ১৯৭১ ফিরে আসতে পারে। সে কারণে যারা পেরেছেন তারা ভোট দিয়েছেন। এবং নির্বাচনের পরেও বিএনপির পক্ষে তারা মাঠে নামতে রাজি হননি। এটিই সার কথা। যা আজকাল উল্লেখ করতে সবাই ভুলে যান। নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রবল বিরোধিতা। সন্ত্রাসের পরও সরকার দৃঢ় থেকে তার লক্ষ্যে পৌঁছেছে। সরকার সব সময় বলেছে, তারা সংবিধান থেকে একচুলও নড়বে না। বিরোধীরা বলেছে, নড়তে হবে, সংবিধানের চেয়ে মানুষ ওপরে এবং নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হবে। মানুষ সার্বভৌম এ যুক্তি সঠিক। কিন্তু ভোটের হার দেখলে ৪২ ভাগের ওপর মানুষ তো এ তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে একমত নয়। এর অর্থ, ভোটের হার অনুযায়ী ৩৩ ভাগের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুতরাং, অন্তত এ ক্ষেত্রে সুশীল বাটপাড়দের এ যুক্তি সঠিক নয়। মাত্র কয়েকদিন আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, মাইনরিটি বিভিন্ন অজুহাতে মেজরিটির ম্যান্ডেট চ্যালেঞ্জ করবে, সেটি কোন কার্যকর পদ্ধতি নয়। তাদের কাজ অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো ও ‘এক্সপোজ’ করা। সন্ত্রাস বা মানুষ হত্যা প্রতিবাদ নয়, যেখানে বলা হচ্ছে মানুষের জন্য রাজনীতি। এর আগে অনেকবার লিখেছি, আবারও লিখতে হচ্ছে, সুপ্রীমকোর্টের রায় যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে না যেত তাহলে হয়ত খালেদা জিয়ার দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু সুপ্রীমকোর্টের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দুটি টার্ম ঐ ধরনের সরকার করা যেতে পারে যদি সংসদের সায় থাকে। দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংসদের সায় ছিল না। সুতরাং, আইনত সে সরকার আনা সম্ভব ছিল না। যদি নির্বাচনে আবার কেউ দুই-তৃতীয়াংশ সখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসে তাহলে হয়ত সংসদের সায় থাকতে পারে। তখন তা করা যাবে কিনা, তাও আইনজ্ঞদের বিষয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমেই তো তা পেতে হবে এবং নির্বাচনে আসতে হবে। জামায়াত-বিএনপির এত বাঘা বাঘা আইনজীবী এ বিষয়টুকু জানেন না এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু তবুও তারা এবং তাদের সহযোগী সুশীলরা কেন বার বার ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন এবং দিচ্ছেন? কারণ একটিই- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ বিচারের রায়ে জামায়াতের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছিলেন তারা থাকবেন না। ইতিহাসের কারণে তাদের সঙ্গে বিএনপির নেতাদের এক ধরনের সখ্য ও বোঝাপড়া আছে। পরের স্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে সেটি ক্ষীণ। কিন্তু জামায়াতের ৫ ভাগ ভোটের জন্য বিএনপি কেন নিজেদের সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করে তুলছে? কারণ, জামায়াতের অস্ত্র, অর্থ ও পেশীশক্তি। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। আইএসআইয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। ২০১৩-১৪ সালে রাস্তায় সন্ত্রাসে জামায়াত কিন্তু বড় ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধ ঠেকাতে নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে এবং করা হয়েছেও। বিএনপি-জামায়াতের কৌশল ছিল নির্বাচন ইস্যুতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাবে। নির্বাচন ঠেকানো যাবে। তারপর নির্বাচন কমিশন বদল ও লতিফুর টাইপের কাউকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে ২০০১ সালের মতো নির্বাচনে জেতা যাবে। এবং তখন মুক্তিযুদ্ধমনাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে। সুশীলদেরও তাতে সায় ছিল। কারণ, ঐ ধরনের শাসনে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদ পাওয়া সম্ভব এবং নিজেদের প্রভাবশালী করা সম্ভব। তাঁরা কখনও ভাবেননি, এ কৌশল বৃথা যাবে বিশেষ করে আমেরিকার সমর্থন সত্ত্বেও। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য সমাজের সম্পূর্ণ মেরুকরণ যা পরে আলোচিত হয়েছে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য প্রবল হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা ও সন্ত্রাস। নির্বাচনে সাধারণত দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। কিন্তু এখন পরিকল্পিতভাবে পুলিশ আনসারদের হত্যা করা হয়েছে, নির্বাচনী অফিসার হত্যা করা হয়েছে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, শিশুদেরও পুড়িয়ে মারা হয়েছে- এক কথায় কী হয়নি! এর রকম বর্বরতা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। সুশীলরা, টকাররা সহিংসতা যে গণতন্ত্রের শত্রু তা মাঝে মধ্যে উল্লেখ করেছেন, সহিংসতা শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়, তাও কখনও কখনও উল্লেখ করেছেন কিন্তু কখনও প্রকাশ্যে জোরগলার বলেননি। এই সহিংসতা বিএনপি-জামায়াত করছে। এটি কাম্য নয়। এটি নিন্দনীয় এবং যে-কোন আলোচনার পূর্বশর্ত সহিংসতা দমন। এ কথা এরা কখনও বলেননি। এ জন্যই তাঁরা সুশীল বাটপাড়। কেন তারা সামান্য এই প্রতিবাদটুকুও করলেন না বরং বলতে লাগলেন-শেখ হাসিনা একতরফা নির্বাচন করতে চান। গণতন্ত্র হুমকির মুখে ইত্যাদি। তাদের ভণ্ডমিটা দেখুন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন প্রচেষ্টা হচ্ছে একরতফা, একদলীয় নির্বাচন। প্রতিদিন মানুষ হত্যা, গাড়ি পোড়ানো যেন গণতন্ত্রের অংশ বা জামায়াত- বিএনপি নেত্রী খালেদার ভাষায়, ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’। ৪. নির্বাচন কেমন হয়েছিল দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন কেমন হয়েছিল–এ প্রশ্নের সরল উত্তর পাওয়া যাবে না। নির্বাচনের আগেই পরিবার, পাড়া, সমাজ, দেশ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। যদিও বলা হচ্ছিল নির্বাচনই দ্বন্দ্বের মূল কারণ, কিন্তু সেটা যে নয়, তা অচিরেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। নিছক নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে সে দ্বন্দ্ব অনেক আগে মিটে যেত। দ্বন্দ্ব ১৯৭৫ সাল থেকেই ছিল। পোশাকের আড়ালে যা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছিল। যুদ্ধাপরাধ বিচার ও দণ্ড কার্যকর করার পর দ্বন্দ্বটার আর কোন রাখঢাক নেই। এই দ্বন্দ্ব আদর্শগত। দুই আদর্শের লক্ষ্য ভিন্ন এবং সমান্তরাল, রেললাইনের মতো। জংশনে লাইন মিলতে পারে তখনই যখন লক্ষ্য হবে এক, পথ তখন ভিন্ন হলেও এ ধরনের দ্বন্দ্ব থাকবে না। এক পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। পুরনো মুসলিম লীগ, পিডিপি প্রভৃতি যারা করতেন তাদের উত্তরসূরিরা, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত যারা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, আমলা, এই সময় বড় বড় হয়ে ওঠা দুটিতে বড় প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, এনজিও-মিডিয়াদের একটি বড় অংশ, এতিম বামপন্থীরা, বিভিন্ন বর্ণের রাজনীতিবিদরা বিএনপির সমর্থক। ১৯৭৫-৯৫ এই সময়ের মধ্যে বিএনপির অর্থের ভিত্তিটা শক্তিশালী হয়েছে। এরা প্রচণ্ড আওয়ামীবিরোধী। এদের একটি বড় অংশ কথাবার্তায় খুব মার্জিত, বাংলাদেশের জন্য তারা উৎসর্গকৃত-এ রকম একটা পোশাক পরেছিল, এখনও পরে এবং সাধারণকে বিভ্রান্ত করে না, এ কথা স্বীকার করা যাবে না। তারা বলবেন, জিয়া ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ‘স্বাধীনতার ঘোষক’। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা আল বদর আবদুল আলীম বা আবদুল মান্নানকে ১৯৭১ সালের পর পরই মন্ত্রী করেন কিভাবে বা শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী? রাজাকার সবুর খান বা যাদু মিয়াকে তিনি কবর দেন জাতীয় সংসদে। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ২৪ ঘণ্টা পর পারলৌকিক রীতি প্রায় পালন না করতে দিয়ে টুঙ্গিপাড়ার মতো অজপাড়াগাঁয়ে পাঠিয়ে দেন। ধরা যাক। এসব কবর এখান থেকে সরাতে হবে। এ প্রস্তাব করলাম। কিন্তু উল্লিখিত সুশীলরা কি তা সমর্থন করে বিবৃতি দেবেন? দেবেন না। পার্থক্যটা এখানেই হয়ে যায়। নির্বাচনে যাতে ভোট না পড়ে এ জন্য জামায়াত-বিএনপি হত্যা থেকে নির্যাতন যা করার করেছে। সুশীলরা বিদেশীদের দরজায় অনবরত কড়া নেড়েছেন। মিডিয়া তার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যদি ভোটার সংখ্যা ১০ ভাগ হতো তা হলে তারা প্রমাণ করতে পারত যে সত্যিই এটি ‘প্রহসনের’ নির্বাচন। ৫৯ জেলার ১৪৭টি আসনে ১২টি রাজনৈতিক দলের ৩৯০ প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। ভোটার ছিল ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৩৮ জন। সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে কোন ভোট নেই। প্রায় মিডিয়াই এ কথা প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কেন ভোটাররা আসছে না তার কারণ তারা উল্লেখ করছিল না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা বাড়তে থাকে। একটি কেন্দ্রে জামায়াত-বিএনপি আক্রমণ করলে যৌথবাহিনীর গুলিতে দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনা শোনার পর ভোটকেন্দ্র ভরে ওঠে। আমি খুব আশাবাদী ছিলাম না। ৩০ ভাগ ভোট পড়লে তাতেই সন্তষ্ট ছিলাম। শাহরিয়ার অবশ্য বলেছিল, ব্রিটেনে ২১ ভাগ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় গেলে এখানে বিদেশীর কেন বেশি আশা করে? মিডিয়া প্রচার আমাদের আরও হতাশ করে তুলছিল। এমনকি মানস ঘোষ, দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক, আমাদের সুহৃদ, কয়েক ঘণ্টা পর পর ফোন করে জানতে চাচ্ছিলেন কি অবস্থা। রাতে শোনা গেল ৩৫ ভাগের ওপর ভোট পড়েছে। তারপর জানা গেল প্রায় ৪১ ভাগ। স্থগিত কেন্দ্রগুলোতে ভোটের পর সেই হার আরও বেড়েছে। ১৯৯১ সালে এ হার ছিল ৫৫.৪৫ ভাগ। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ২৬ ভাগ। সে সময়ও আওয়ামী লীগ বয়কট করেছিল। পার্থক্যটা হচ্ছে আওয়ামী বয়কটের পর ২৬ ভাগ। আর এখন বিএনপি-জামায়াত বয়কটের পরও ৪২ ভাগ। এর কারণ হচ্ছে নির্বাচনটিকে ভোটাররা নিছক ক্ষমতা বদলের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেনি। আদর্শের লড়াই হিসেবে, গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায়- ‘একাত্তরের নতুন রণাঙ্গন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে। যে কারণ, মার খেয়ে, সরে গিয়েও এবং যে হিন্দুদের ভোট দেয়ার কথা ছিল না, তারাও ভোট দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছে, এ দেশটা জামায়াত-বিএনপি, কিছু সুশীল বাটপাড় ও মিডিয়াকে শুধু লিজ দেয়া হয়নি। গাফ্ফার চৌধুরী বোধহয় আবেগ সামলাতে না পেরে, চারযুগ পর একটি কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন, যার শেষ স্তবকটি ছিল এ রকম- “নির্বাচবকে রুখতে তাহারা মানুষ মেরেছে পুড়ে ধ্বংস এবং রক্তের বান ছড়ায়েছে দেশজুড়ে। নারী-ধর্ষণ শিশু হত্যার ঘটায়েছে মহাপাপ। এরা নররূপী পশু, এরা বাংলার অভিশাপ ॥ এই অভিশাপ ঘোচাতেই আজ সুকঠিন সংগ্রাম দানবের সাথে যুদ্ধের তরে প্রস্তুতি অবিরাম ॥ সব ভয়ভীতি কাটিয়ে জাগুক বাংলার জনগণ এত নির্বাচন নয়, একাত্তরের নতুন রণাঙ্গন ॥’ ৫. বিএনপির এক নম্বর ও দু’নম্বর দাবির প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা তা উপর্যুক্ত বিবরণেই পাওয়া যাবে। তবে, হ্যাঁ, দুই ও তিন নম্বর দাবির ব্যাপারে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু শর্ত দিয়ে তো নয়। ১ নম্বর দাবি সাংবিধানিক ভাবেই বাস্তবায়িত করা যাবে না। সংবিধান সংশোধন করলেও। কারণ উচ্চ আদালত আবার তা বাতিল করবেন। এটি জানা সত্ত্বেও কেন বার বার এ দাবি তুলছে বিএনপি-জামায়াত? কারণ, তারা জানে আদর্শগত লড়াইয়ে তারা হেরে যাচ্ছে। তাই তত্তা¡বধায়ক সরকারকে আশ্রয় করে তারা এগুতে চায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মিডিয়া এবং বিএনপি-জামায়াত এ্যাপলজিস্টরা যা বলছিলেন এখনও তাই বলছেন। সেই সময় দেশজুড়ে সহিংসতা চলছিল এবং মিডিয়া পরোক্ষে গণতন্ত্রের নামে তাদের সন্ত্রাস সমর্থন করছিল। এবার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু হলে মিডিয়া ও সেই সুশীলরা ঠিক একই কথা বলছেন। কারণ, পরিস্থিতি তো ২০১৪ সালের মতো। আমি ঐ সময়ের কিছু উদাহরণ দেব, তার সঙ্গে আজ যারা মিডিয়াতে বক্তব্য রাখছেন সেখানে কোন অমিল খুঁজে পেলে জানাবেন। জামায়াত-বিএনপি ও সুশীলদের প্রকৃতি বাংলাদেশের সবেচেয়ে চালু পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোয় একটি সংবাদের শিরোনাম –“শুধু ‘একতরফা’ নয়, ‘প্রাণঘাতী’ নির্বাচন।” তারা বোঝাতে চেয়েছে উর্ধকমার শব্দ দুটি তাদের নয়। কিন্তু তারা শব্দ দুটি বেছে নিয়েছে কারণ তারা এমনটিই মনে করে। প্রতিবেদনের প্রথম প্যারাটি এ রকম-“ ‘একরতফা’ তকমার পাশাপাশি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইতিহাসের পাতায় ‘প্রাণঘাতী’ নির্বাচন হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পরিসংখ্যান বলছে, নির্বাচনের আগে এত বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা বাংলাদেশের কোন নির্বাচনের আগে ঘটেনি।” [০৫.১.২০১৪] কিন্তু এই প্রাণহানির কারণ কী? প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট নয়। এরপর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনের শেষ করেছে –‘এ পর্যন্ত নাগরিকদের জানমাল রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র খুব সফলতার পরিচয় দিতে পেরেছে বলে আমাদের প্রতীয়মান হয়নি।” (্ঐ) মূল বিষয়টি কী দাঁড়াল তাহলে? নির্যাসটি হলো-প্রাণঘাতী নির্বাচন হচ্ছে এবং এতে যারা আহত হচ্ছেন বা প্রাণ দিচ্ছেন রাষ্ট্র অর্থাৎ সরকার তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আচ্ছা, এই হত্যাগুলো কারা করেছে? প্রতিবেদনে তার কোন উল্লেখ নেই। সুশীলরাও অনবরত তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের কথাই বলে এসেছেন। মিডিয়াও কখনও উল্লেখ করেনি কারা এসব করছে। হ্যাঁ বলেছে, দুর্বৃত্তরা এসব করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নির্দেশে মিডিয়া ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি ব্যবহার করত না, লিখত ‘দুষ্কৃতকারী।’ কোন কোন সংবাদপত্র ও টিভি আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলেছে, ‘নির্বাচনবিরোধীরা।’ অধুনা মিডিয়ার দৌলতে অধিক পরিচিত ‘সুজন’ও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। এর প্রধান জনাব মজুদমদার সুশাসন চান দেখে সুজনের মতো এনজিও করেছেন। তো সুশাসনের প্রতিবন্ধক শুধু আওয়ামী লীগ? বিএনপি-জামায়াত নয়? তারা আবার একটি আলোচনাসভা করেছিলেন। সেখানেও ভায়োলেন্সের সমালোচনা করা হয়েছে এবং তা যে গণতন্ত্রবিরোধী তাও বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিরোধের মূল কারণ যে, যুদ্ধাপরাধ বিচার সে বিষয়ে একটি কথাও কেউ উল্লেখ করেননি। এমনকি কারা এর জন্য দায়ী তাও আলোচনায় আসেনি স্পষ্টভাবে। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রায় ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। টার্গেট করে পুলিশ, বিজিবি ও আনসারদের আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের অনেককে পিটিয়ে, পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পেট্রোলবোমা ছুড়ে শিশু, মহলিা, বৃদ্ধ, তরুণ, মধ্যবয়সীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এঁরা সব সাধারণ মানুষ, দরিদ্র। সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি অথচ তাঁদেরই পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কুপিয়ে মারা হয়েছে, গুলি করে মারা হয়েছে, পিটিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু কারা করেছে উল্লিখিত সুশীলরা জানেন না। কারণ, তারা বিরোধীদের সমর্থক দেখে প্রকাশ্যে তাদের নাম বলেননি। আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি-এগুলো করেছে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। এবং এর নির্দেশ দিয়েছেন এ দুটি দলের নেতারা। সাদেক হোসেন খোকা ওরফে ধোঁকা (নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ভাষায়) প্রকাশ্যে হত্যা করার কথা বলেছেন, অন্যারা গোপনে-এই যা তফাৎ। জামায়াত-শিবির-বিএনপির এবং ১৬ দলের (একত্রে ১৮ দল) কর্মীরা শিক্ষামন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী ৫৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে। পাকিস্তানের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৭ বছরে কোন নির্বাচনে এমনটি ঘটেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আছে। তবে, মাদ্রাসার সংখ্যা কম। নির্বাচনের কিছুদিন আগে শিক্ষাবর্ষ শুরুতে অন্য ছাত্ররা নতুন বই পেয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েকটি মাত্র ঘটনা আছে গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়ার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোড়ানো অনেকটা সেই ধাঁচের। চীনের শি হুয়াংতি কনফুসিয়াম এবং আরও অনেকের বই পুড়িয়েছিলেন। হালাকু খান বাগদাদের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছেন। রোমক এক সম্রাট আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ধ্বংস করেন। জার্মানির নাজিরা ব্যাপক হারে বই পুড়িয়েছিল। এখানে বিদ্যালয় কারা পোড়ালো? সুশীলরা জানেন না? জানলে নিশ্চয় বিবৃতি দিতেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের তথ্য ডাউনলোড করা যাচ্ছে না- সেটির নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। নির্বাচন একতরফা হচ্ছে সেটি নিয়ে হরেক রকম বক্তব্য, প্রতিবাদ করা হয়েছে. কিন্তু ৫৩১টি বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এদের কোন বক্তব্য, নিন্দা দেখিনি। বলেননি তারা যে, বিএনপি-জামায়াত চায় এ দেশে অন্ধকার যুগ ফিরে আসুক। জ্ঞান চর্চা বড় নয়, বড় হচ্ছে মাসল চর্চা।
×