ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্যুতের পাইকারি দামের ওপর গণশুনানি

প্রতি ইউনিটে ২২ পয়সা বৃদ্ধির সুপারিশ বিইআরসির

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ২১ জানুয়ারি ২০১৫

প্রতি ইউনিটে ২২ পয়সা বৃদ্ধির সুপারিশ বিইআরসির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আন্তর্জাতিক নিম্নমুখী তেলের দরের মধ্যেই দেশে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) মঙ্গলবার বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানি করেছে। যদিও গ্রাহকরা সামগ্রিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় এখনই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপরও বিইআরসি ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ হারে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম ২২ পয়সা বৃদ্ধি করে চার টাকা ৮৯ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে, যা বর্তমানে চার টাকা ৬৭ পয়সা রয়েছে। আগামী ১ ফেব্রয়ারি থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে। যদিও গ্রাহক পর্যায়ে তখন থেকেই এর কোন প্রভাব পড়বে না। বিতরণ কোম্পানিগুলোকে পিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুত কিনতে বাড়তি দাম গুনতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য এবং সঞ্চালন ব্যয়ও এবার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আজ থেকে কমিশন ওই দাম বৃদ্ধির ওপর শুনানি করবে। পিডিবি গত ২ অক্টোবর পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৮৪ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। বর্তমানে পিডিবি বিদ্যুত বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে পাইকারি প্রতি ইউনিট বিক্রি করছে চার টাকা ৬৭ পয়সায়। আর ইউনিটপ্রতি ৮৪ পয়সা বাড়িয়ে ৫ টাকা ৫১ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করে সংস্থাটি। পিডিবির প্রস্তাবিত মূল্যহার বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। পিডিবির পাইকারি এ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে শুনানিতে অংশ নেয়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর আগে গত দু’বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে পিডিবি ২০ শতাংশ বিদ্যুত উৎপাদন প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছিল। তখন পিডিবির পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছিল- ২০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাবে। অথচ এ সময় পিডিবির বিদ্যুত উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশের কিছু বেশি। এক্ষেত্রে পিডিবি তাদের নতুন দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে ১০ শতাংশ কম প্রবৃদ্ধির অর্থ কোথায় গেল তা বলেনি। নতুন প্রস্তাবে পিডিবি ১২ শতাংশ বিদ্যুত উৎপাদনের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। অথচ এবারও বিদ্যুত উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে থাকবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে বিদ্যুত উৎপাদনই করা হবে না, প্রাক্কলিত ব্যয়ে সেই বিদ্যুতের দাম ধরে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করার প্রস্তাব অযৌক্তিক এবং বিভ্রান্তিকর। পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে তারা প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মতো লোকসান করবে। সরকার পিডিবিকে কোন ভর্তুকি দেয় না। পিডিবি তিন শতাংশ হারে সরকারের বাজেট বরাদ্দ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। এ কারণে প্রতি বছরই দেনার দায় বেড়েই চলেছে। ফলে দাম না বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। যদিও এই ঋণের অর্থ বা সুদ কোনটাই পরিশোধের নজির নেই। খাতা-কলমে ঋণ হলেও এটাকে ভর্তুকিই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা হিসেবে তেলভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রে ব্যবহƒত জ্বালানির উচ্চমূল্যকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছে। অথচ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৯ সালের পর বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম সব থেকে কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত ৬ বছরের ভেতর সর্বনিম্ন অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম কমে বর্তমানে ব্যারেলপ্রতি এসে দাঁড়িয়েছে ৪৭ ডলারে। ২০০৯ সালে এ দাম ছিল ১২২ ডলার। গত অক্টোবর থেকে দাম কমতে কমতে সর্বশেষ ৫০ ডলারের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। পিডিবিকে পাইকারি দাম বৃদ্ধির পক্ষে যদি আরও অধিকতর কোন যুক্তি যদি থাকে তা আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে বিইআরসিতে জমা দেয়ার জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান এ আর খান নির্দেশ দিয়েছেন। বিইআরসি সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত বর্ধিত মূল্য ঘোষণা করা হতে পারে। কার্যকর করা হবে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। বিইআরসির চেয়ারম্যান এ আর খানের সভাপতিত্বে কমিশনের সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, মো. মাকসুদুল হক ও রহমান মুরশেদ গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। পিডিবির পক্ষে প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধান প্রকৌশলী (পিএ্যান্ডডি) মিজানুর রহমান। এছাড়া কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম, বিজিএমইএ সচিব কাজী শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশসহ বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানি, ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) প্রতিনিধি দল গণশুনানিতে অংশ নেয়নি। বিপিসিকে কমিশন থেকে চিঠি দিয়ে তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বিপিসি গণশুনানিতে অংশ না নেয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম হওয়ায় বিদ্যুতকেন্দ্রে কী দামে তেল পাচ্ছে তা জানাতে পারেনি পিডিবি। বিইআরসিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির গণশুনানি চলাকালে বাইরে গণঅবস্থান করে বিক্ষোভ করেছে বাম মোর্চা। মোর্চাভুক্ত সংগঠন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মাহবুব) ও গণসংহতি আন্দোলনের নেতারা গণঅবস্থানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, গত আট মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। আজ বুধবার সকাল ১০টায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সঞ্চালন মাসুলের ওপর এবং দুপুর ২টায় ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) খুচরা মূল্য বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
×