ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জুম্মন লুসাইয়ের অশ্রুসিক্ত বিদায়

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২০ জানুয়ারি ২০১৫

জুম্মন লুসাইয়ের অশ্রুসিক্ত বিদায়

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪। মওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়াম। বিজয় দিবসের দিনে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন আয়োজন করেছিল একটি বিশেষ প্রীতি হকি ম্যাচ। তাতে অংশ নিয়েছিলেন সাবেক হকি খেলোয়াড়রা। অংশ নেয়া দল দুটি ছিল হকি ফেডারেশন সভাপতি একাদশ এবং হকি ফেডারেশন একাদশ। প্রীতি ম্যাচে ছিল প্রাণের মেলা। জীবনের শেষ হকি ম্যাচটি খেলেছিলেন জুম্মন লুসাই। ৫৯ বছর বয়সী লুসাই সে ম্যাচে দেখিয়েছিলেন তাঁর হকি স্কিলের পুরনো জাদু। শূটিং সার্কেলের ভেতর বল নিয়ে ঢুকে পড়েন লুসাই, রফিকুল ইসলাম কামাল পোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্টিক ছোঁয়ানোর জন্য। লুসাইকে বাধা দিতে চাইলেন জাতীয় দলের মালয়েশিয়ান কোচ গোবিনাথান কৃষ্ণমূর্তি, জুম্মন এমন এক ডজে বল বের করে নিলেন যে গোবিনাথান হতভম্ভ হয়ে গেলেন। খাজা রহমতউল্লাহর হ্যাটট্রিকে ৬-৪ গোলে জুম্মনের সভাপতি একাদশ হেরে যায় ওই ম্যাচে। ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫। বেলা ১২টা। জুম্মন লুসাই আবারও এসেছেন তাঁর চিরচেনা প্রাণপ্রিয় মওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়ামে। এসেছেন তাঁর সাবেক সতীর্থ-শুভানুধ্যায়ীরাও। তবে কোন ম্যাচ খেলতে নয়। জুম্মনকে শেষ বিদায় জানাতে। হকি স্টেডিয়ামে জুম্মন যে জীবিত অবস্থায় আসতে পারেননি। বাংলাদেশের হকি-জগতের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র আগের দিন চলে গেছেন না-ফেরার দেশে! সকাল ১০টায় জুম্মনকে প্রথমে নেয়া হয় তাঁর প্রিয় ক্লাব আবাহনী লিমিটেডে। সেখানে আবাহনী ক্লাবের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। ওড়ানো হয় শোকের চিহ্ন কালো পতাকা। আবাহনী ক্লাবের খেলোয়াড় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এলাকাবাসী জুম্মনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পরে হকি স্টেডিয়ামে আনা হলে হকি ফেডারেশনও তাঁর সম্মানে কালো পতাকা প্রদর্শন করে। এখানে তাঁকে শেষ বিদায় জানান বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠক, খেলোয়াড়, হকি ফেডারেশনের কর্মকর্তা, সাবেক খেলোয়াড় এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। অশ্রুসজল নয়নে তাঁর জুম্মনের নিথর মুখটা শেষবারের মতো দেখেন। তখন সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিস্থিতির। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি বাদল রায়, কাজী নাবিল আহমেদ, এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম চেঙ্গিস। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়, হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক খাজা রহমতউল্লাহ, সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও আবাহনীতে লুসাইয়ের ক্লাব সতীর্থ আশরাফুদ্দিন চুন্নুসহ অন্যরা। উল্লেখ্য, রবিবার বিকেল পৌনে ৪টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কৃতী এ হকি খেলোয়াড়। জুম্মনের কফিনে মুড়িয়ে দেয়া হয় জাতীয় পতাকা, আবাহনীর ক্লাব পতাকা এবং হকি ফেডারেশনের পতাকা দিয়ে। শেষবিদায় জানানো হলে সড়কপথে জুম্মনের নিজ শহর সিলেটের নয়াসড়কের বাসভবনে জুম্মনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। মঙ্গলবার দুপুরে সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে জুম্মনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন সেখানকার সর্বস্তরের ক্রীড়ামোদীরা। জানা গেছে, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জুম্মন লুসাইয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে আগামী বৃহস্পতিবার। জুম্মনের ভাই জুবেল লুসাই জানান, ‘দাদার স্ত্রী ও তিন ছেলে রিচার্ড, ক্যাউলিন ও ডেভিড ভারতের মিজোরাম থেকে রওনা হয়েছে। তারা না আসা পর্যন্ত দাদার মরদেহের শেষকৃত্য হবে না।’ জুম্মন লুসাইয়ের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোকবার্তায় বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দেশের ক্রীড়াঙ্গণের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। বাংলাদেশের একমাত্র হকি খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্ব একাদশে স্থান পাওয়া জুম্মন লুসাই ছিলেন অসামান্য প্রতিভাধর একজন ক্রীড়াবিদ। তাঁর দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনের সাফল্য শুধু তাঁকেই নয়, দেশকেও ক্রীড়াক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।’ বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে এ দেশের ক্রীড়াজগৎ জুম্মন লুসাইয়ের অবদান চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি শোকবার্তায় এই ক্রীড়াবিদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। জুম্মনের মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসা সাবেক হকি তারকা মাহবুব হারুন জানান, ‘জুম্মন লুসাইয়ের সঙ্গে আমার ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। আমার বাচ্চাদের উনি নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। একসঙ্গে খেলেছি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একসঙ্গে থেকেছি। একটি ঘটনা আমাকে এখনও নাড়া দেয়। ১৯৮৮ সালে জুম্মনের সঙ্গে আমার এ্যাজাক্সে খেলার কথা ছিল। আমি টোকেন জমা দিয়ে বিদেশে খেলতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে শুনি, জুম্মনকে আবাহনী ছাড়েনি। ওই একটি বছর আমরা আলাদা ক্লাবে ছিলাম। কিন্তু মন-প্রাণ ছিল একসঙ্গেই।’ সাবেক তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু বলেন, ‘জুম্মন হকি খেললেও সব খেলাই দেখতে যেত। আমরা যখন ফুটবল খেলতাম, জুম্মন গ্যালারিতে বসে আমাদের উৎসাহ দিত। ওকে কখনও ভুলতে পারব না।’ আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ বলেন, ‘জুম্মনকে যখন আবাহনীতে নিয়ে আসি, তখন সে আমাকে কথা দিয়েছিল কখনও আবাহনী ছেড়ে যাবে না। জুম্মন তার কথা রেখেছিল। জীবনের শেষ দিনটা সে আবাহনীতেই কাটিয়ে গেছে। জুম্মনের ঋণ কখনও শোধ হওয়ার নয়।’ জুম্মন লুসাইকে ‘পাহাড়ী’ বলে ডাকতেন তাঁর প্রিয় বন্ধু কিংব্যাক মোনেম মুন্না। প্রয়াত এই ফুটবলারের স্ত্রী সুরভী মোনেম বলেন, ‘মুন্না এবং জুম্মন ছিলেন এক আত্মা, এক প্রাণ। মুন্নার মৃত্যুর পর পাহাড়ী দা (জুম্মন) আমাদের নিয়মিত খবর রাখতেন। আমার ছেলেমেয়েরা পাহাড়ী আংকেল বলে ডাকত উনাকে। ওনার মৃত্যুতে একজন আপন মানুষ হারালাম আমরা।’ এছাড়া জুম্মন লুসাইয়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে আবাহনী সমর্থক গোষ্ঠী।
×