ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শেখ হাসিনার অবদান

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে  শেখ হাসিনার অবদান

বাংলাদেশে নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন। ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল এই অভূতপূর্ব আন্দোলন। সূচনাপর্ব থেকে নির্মূল কমিটি প্রধানত দুটি দাবির পক্ষে জনমত সংগঠিত করছে, যার একটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং অপরটি যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াত ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ। এই আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। নির্মূল কমিটি গঠনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলের নেতা। তখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। নির্মূল কমিটির ঘোষণার প্রতি মানুষের অকল্পনীয় সমর্থন দেখে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বিষয়টি সুনজরে দেখেননি। আমি তখন সরকারী মালিকানাধীন সংবাদ সাময়িকী সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক। বিচিত্রায় আওয়ামী লীগের সংবাদের দায়িত্বে ছিলেন তরুণ সাংবাদিক মোশতাক হোসেন। নির্মূল কমিটি গঠনের দুদিন পর মোশতাক বললেন, আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, শাহরিয়ার কবির বিচিত্রায় বসে এসব করছে ইনডেমনিটি ইস্যু ধামাচাপা দেয়ার জন্য। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি ছিলÑ ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করতে হবে। মোশতাকের কথা শুনে উদ্বিগ্ন হলাম। আমরা আগেই ঠিক করেছি আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন চাইব। মোশতাককে বললাম, আওয়ামী লীগের এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে হবে। মোশতাক জানাল, শেখ হাসিনার অবর্তমানে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর সঙ্গে আমরা কথা বলতে পারি। শেখ হাসিনার সঙ্গে জাহানারা ইমামের পরিচয় হয়েছিল নির্মূল কমিটি গঠনের প্রায় অর্ধ যুগ আগে। ১৯৮৬ সালে জাহানারা ইমামের কালজয়ী গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশের পরই আলোচনা ও প্রশংসার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। একদিন শেখ হাসিনা এই বইয়ে অটোগ্রাফের জন্য জাহানারা ইমামের বাড়িতে গিয়েছিলেন বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের নিজের বাড়িতে দেখে জাহানারা ইমাম কী পরিমাণ অভিভূত হয়েছিলেন পরে বহুবার সে কথা তিনি আমাদের বলেছেন। শেখ হাসিনা তাঁকে খালাম্মা ডাকতেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামালের প্রতি শেখ হাসিনার দুর্বলতা ও শ্রদ্ধা নির্মূল কমিটির আন্দোলনে তাঁর সহযোগিতার ভিত নির্মাণ করেছে। সূচনাপর্বে যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দৃঢ় সমর্থন আমাদের সাহস যুগিয়েছে। ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠনের পর ২৬ মার্চ গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের পক্ষে জনমত সংগঠনের কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করেছিলাম, ২৬ মার্চ পর্যন্ত তাদের সকল দলীয় কর্মসূচী স্থগিত রেখে গণআদালতের কর্মসূচীর পক্ষে কাজ করার জন্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেবারই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি এক মঞ্চে একত্রিত হয়ে নাগরিক সমাজের এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। জাহানারা ইমামের আন্দোলন বহুধাবিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এই আন্দোলনের আগে কেউ ধারণা করতে পারেননি শেখ হাসিনা, নির্মল সেন, বদরুদ্দীন উমর কিংবা আহমদ শরীফ, কবীর চৌধুরী, গাজীউল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রায় একই ভাষায় কথা বলছেন। জাহানারা ইমাম একটি কথা তাঁর ভাষণে প্রায়ই বলতেন, ‘আমাদের অনৈক্যের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা এত শক্তিশালী হতে পেরেছে।’ ’৯১-এর গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদের পতনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল জামায়াতের সমর্থন নিয়ে। জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদানের শর্তে। যে কারণে বিএনপির সরকার গঠনের পর পরই জামায়াত আত্মগোপনে থাকা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে, যার তখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছিল না। ১৯৯২-এর মার্চে গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের পক্ষে সারাদেশে যখন গণআন্দোলনে উত্তাল খালেদা জিয়ার সরকার নিরাপত্তার কথা ভেবেই গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। অপর দিকে গণআদালতের কর্মসূচীর বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। নির্মূল কমিটির ২৩ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচী ছিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিচার। কারণ ক্ষমতায় তখন খালেদা জিয়ার জামায়াতবান্ধব বিএনপি সরকার। যদিও বিএনপির অনেক নেতা, সাংসদ এমনকি ছাত্র সংগঠনের নেতারাও কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে আমাদের সমর্থন করেছিলেন কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল যে কোন মূল্যে গণআদালত প্রতিহতকরণের। ২৬ মার্চের এক সপ্তাহ আগেই বলা হলো গণআদালতের কর্মসূচী বেআইনী, সরকার এ ধরনের কোন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে দেবে না। গণআদালত প্রতিহত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ২৫ মার্চ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ সংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। বলা হলো কেউ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। ২৫ মার্চ বিকেল ৩টার দিকে আমরা বিরোধী দলের নেতার সরকারী ভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। জাহানারা ইমাম বললেন, সরকার যেভাবে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে গণআদালত কিভাবে হবে? এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে বেশি জানতেন শেখ হাসিনা। তিনি জাহানারা ইমামের কাছে জানতে চাইলেন, ‘গণআদালতে আপনারা কত মানুষ আশা করছেন?’ জাহানারা ইমাম বললেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে, আমরা চার থেকে পাঁচ লাখ জনসমাগম আশা করছি।’ আমাদের সামনেই শেখ হাসিনা প্রথমে ফোন করলেন আদমজী জুট মিলের শ্রমিক নেতা রেহানকে। বললেন, খালাম্মা আমার সামনে বসে আছেন। আগামীকাল আদমজী ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আপনারা পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক পাঠাবেন। এরপর তিনি টঙ্গী, জয়দেবপুর ও আরও কয়েকটি জায়গায় ফোন করে স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দিলেন। জাহানারা ইমামকে তিনি বললেন, আমি আপনাদের কর্মসূচীতে দু’লাখ লোকের দায়িত্ব নিচ্ছি। বাকিটা আপনারা অন্য দলগুলোকে বলুন। জাহানারা ইমামের আন্দোলনের গত ২৩ বছরে শেখ হাসিনা মাত্র তিনবার আমাদের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রথমবার তিনি এসেছিলেন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ’৯২-এর ৩ মার্চ জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রথম সমাবেশে। অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত দিয়ে হলেও বাংলাদেশের মাটিতে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। দ্বিতীয় ও শেষবার তিনি আমাদের মঞ্চে এসেছিলেন ’৯২-এর ১৪ অক্টোবর। এই সমাবেশে তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে আমাদের নিজেদের ভেতর যে মতবিরোধ হয়েছে কিছুটা আমি ‘জাহানারা ইমাম ও গণআদালত’ বইয়ে লিখেছি। সেবার তিনি নির্মূল কমিটির অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ১৯৯৮-এর মার্চে যখন আমরা ৭ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ মেলার আয়োজন করেছিলাম। এই মেলা উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর আমরা দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে তাঁকে স্মারকপত্র দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শেষ করে তিনি ’৭১-এর ঘাতকদের বিচার করবেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি সে কাজ আরম্ভ করছেন। ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপির জোট সা-ল-সা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নির্মূল কমিটির ওপর। সরকার গঠনের দেড় মাসের ভেতর আমাকে গ্রেফতার করেছিল। কারাগারে দেখেছি প্রতিদিন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হাত-পা ভেঙ্গে অর্ধমৃত অবস্থায় কারাগারের সেলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেতে। আমার ওপর কী ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে জেল থেকে বেরিয়ে উচ্চতর আদালতে জানিয়েছি। ঈদের দিন সব বন্দীকে বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খেতে দেয়া হয়। আমার স্ত্রী-পুত্র- কন্যা আমার জন্য খাবার এনে তিন ঘণ্টা জেল গেটে দাঁড়িয়েছিল তাদের দেখা করতে দেয়নি। এ খবর সব দৈনিকে বেরিয়েছিল। ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় এ নিয়ে সম্পাদক মাহফুজ আনাম বিশেষ সম্পাদকীয়ও লিখেছিলেন। কারাগারে থাকার সেই দুঃসহ দিনগুলোতে কিছু স্বস্তি ও সুখের মুহূর্তের কথাও মনে আছে। ঈদের আগের রাতে মায়ার ছেলে দীপু একটা প্যাকেট এনে দিয়ে বলল, আঙ্কল এটা নেত্রী পাঠিয়েছেন, আপনার জন্য ঈদের উপহার। খুলে দেখি একটা সাদা নকশা করা পাঞ্জাবি। খালেদা জিয়ার নির্যাতন সেলে শেখ হাসিনার মমতাভরা উপহার পেয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। জেল থেকে বেরুবার পর তিনি সুধাসদনে ডেকেছিলেন গ্রামের বাড়ি থেকে আনা পিঠা খাওয়ার জন্য। শুনেছেন, কারাগারে কী ধরনের অত্যাচার করা হয়েছে আমাদের ওপর। তখন তাঁকে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা মনে হয়নি। নিতান্তই একজন মমতাময়ী বোন, যে কোন মানুষের কষ্টের কথা জানলে যিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন। প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যই জামায়াতের জঙ্গী সন্ত্রাসীরা তাদের হিট লিস্টের এক নম্বরে রেখেছে শেখ হাসিনার নাম। জামায়াত জানে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা যাবে না, বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো যাবে না। যে কারণে জামায়াত এবং তাদের সহযোগী আন্তর্জাতিক প্রভুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, একই কারণে তারা বঙ্গবন্ধুর কন্যাকেও হত্যার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। জামায়াত ও জঙ্গীদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাস প্রতিহত করেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া সম্ভব। শেখ হাসিনার সহযোগিতা, উদ্যোগ ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। বিজয়ের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। তিনি বহুবার বলেছেন, জামায়াত কোন রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী সংগঠন। আমরা আশা করব তাঁর সরকার দ্রুত জামায়াত নিষিদ্ধকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ১৯ জানুয়ারি ২০১৫
×