ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আখেরি মোনাজাত আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

আখেরি মোনাজাত আজ

ফিরোজ মান্না/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ শীতের রাতে বৃষ্টি, তার ওপর আবার বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের অবরোধ-হরতাল। এমন দুর্ভোগ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের পথে অন্তরায় হলেও কোন কিছুতেই এবাদত-বন্দেগি থেকে একটুও পিছু হটাতে পারেনি। প্রচ- শীত আর বৃষ্টির মধ্যেও মুসল্লিরা এবাদত- বন্দেগিতে ছিলেন মশগুল। তাঁরা সৃষ্টিকর্তার দিদার লাভের জন্য যে কোন দুর্ভোগ উপেক্ষা করতে পারেন। আজ রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত ৫০তম বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। শনিবার ভোর ৪টা থেকে প্রায় আধাঘণ্টার বৃষ্টিতে বিছানা ও কাপড়-চোপড়সহ মুসল্লিরা ভিজে যান। তাঁরা সকালে আগুন জ্বেলে ভেজা কাপড় শুকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে শুরু হয় থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এ সময় বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষায় অনেক মুসল্লি মাথার ওপর পলিথিন টানিয়ে নিচে জড়োসড়ো হয়ে সৃষ্টিকর্তার গুণগান করেন। বৃষ্টির কারণে এজতেমাস্থল কাদায় ভরে যায়। এমন বিপর্যায়কে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ‘আল্লাহর রহমত’ বলে বর্ণনা করেন। তাঁরা শীত, বৃষ্টি ও কর্দমাক্ত মাটি উপেক্ষা করে মনোযোগের সঙ্গে ইমান, আখলাক ও দ্বীনের বিভিন্ন বয়ান শোনেন। আজ সকাল ১০টা থেকে ১১ টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে এজতেমা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। এর আগে হেদায়েতি বয়ান করা হবে। তবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বিদের পরামর্শের ভিত্তিতে তবলীগ জামাতের দিল্লীর মারকাজের শূরা সদস্য হযরত মাওলানা সাদ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে জানানো হয়েছে। মোনাজাতে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার মানুষের সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনায় দোয়া করা হবে। আখেরি মোনাজাতে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশ নেবেন বলে আয়োজকদের ধারণা। শনিবার সকালেই টঙ্গী শহর এবং এজতেমাস্থল ও এর আশপাশ এলাকা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় মুসল্লিদের স্রোতে। যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। টঙ্গীর তুরাগতীর বিশ্ব এজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। শেষ দফায় ৩৪ জেলার মুসল্লি ৩৯ খিত্তায় অবস্থান নিয়ে এবাদত-বন্দেগি করছেন। বিদেশী নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকেই রবিবার সকালে শুরু হবে আখেরি মোনাজাত। মুসল্লিদের ভোগান্তি কমাতে এ পর্বেরও আখেরি মোনাজাতের সময় এগিয়ে আনা হয়েছে। মোনাজাতের আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়েতি বয়ান। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে মুসল্লিদের সুবিধার্থে রবিবার ভোর থেকে ওই এলাকায় যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পুলিশ। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। এবারের বিশ্ব এজতেমার উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রায় ১২ হাজার র‌্যাব ও পোশাকধারী পুলিশের পাশপাশি রয়েছে সাদা পোশাকে প্রায় ৩ হাজার গোয়েন্দা সদস্য। আকাশ ও নৌপথে রয়েছে র‌্যাবের সতর্ক নজরদারি। শনিবার বিশ্ব এজতেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল যৌতুকবিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ শরীয়ত মেনে তবলীগের রেওয়াজ অনুযায়ী এজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ আছর এজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর । কনের সম্মতিতে বর ও কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ওই বিয়ে। সকাল থেকেই অভিভাবকরা দম্পতিদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। বিয়ের পর বয়ান মঞ্চ থেকেই মোনাজাতের মাধ্যমে নবদম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করা হয়। এবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে এক শ’ বিয়ে হয়েছে। শনিবার ফজরের নামাজের পর থেকে বয়ান শুরু হয়। প্রথমে বয়ান করেন ভারতের হযরত মাওলানা শওকত আলী। এ সময় বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। পাশাপাশি ইংরেজী, উর্ধুসহ বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করা হয়। এছাড়া বাদ জোহর পাকিস্তানের মাওলানা মিয়া আনোয়ার হোসেন, বাদ আছর ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ জোয়াহের হোসেন ও বাদ মাগরিব ভারতের হযরত মাওলানা আহমদ লাট বয়ান করেছেন বলে জানান বিশ্ব এজতেমার মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার মোঃ গিয়াস উদ্দিন। গত দু’দিন ধরে প্রতিদিন ফজর থেকে এশা পর্যন্ত এজতেমা মাঠে ইমান, আমল, আখলাক ও দ্বীনের পথে মেহনতের ওপর আম বয়ান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বয়ানে তবলীগ মুরব্বিগণ বলেন, আল্লাহ’তায়ালা আপনাকে-আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং আল্লাহ’তায়ালা এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দুনিয়াতে যে একবার আসবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আল্লাহ পাকের এ সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন হবে না। দুনিয়া হচ্ছে ধোঁকার ঘর, এ দুনিয়া হচ্ছে ধোঁকার জীবন। মিছে এই দুনিয়ার আরাম-আয়েসের কথা ভুলে গিয়ে আখেরাতের কথা চিন্তা কর। দুনিয়ার জিন্দেগী ক্ষণস্থায়ী, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের দিল থেকে আসবাবের (সম্পদের) একিন বের না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার দিলে কুদরতি একিন পয়দা হবে না। এদিকে, এজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইলের মসজিদের তবলিগী মুরব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তবলিগী কাজে পাঠনো হবে। দ্বিতীয় পর্বে শনিবার সকাল পর্যন্ত এজতেমা ময়দানে হৃদরোগ ও বার্ধক্যজনিত রোগে ৭ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৪ জন মারা যান। এদের মধ্যে এজতেমা ময়দানে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মৌলভীবাজার জেলার জুরী থানার ভোগতারা গ্রামের দরবেশ আলীর ছেলে বশির মিয়া (৫৫), সকাল ৮টার দিকে নীলফামারী জেলার পলাশবাড়ি এলাকার মৃত বদর উদ্দিন খানের ছেলে গোলাম আজম খান (৬০) এবং ভোর রাত ৪টার দিকে বার্ধক্য জনিত কারণে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার টিকাশ্বর এলাকার মতলব আলী হাওলাদারের ছেলে আলী আজম হাওলাদার (৬৪) মারা যান। এছাড়াও একই রাতে ময়মনসিংহের আবুল হাশেম নামের অপর এক মুসল্লি মারা গেছেন। এ নিয়ে এবারের দ্বিতীয় পর্বের এজতেমায় আগত মোট ৭ মুসল্লি মারা যান। এর আগে প্রথম পর্বে মোট ১১ মুসল্লি মারা যান। অন্যদিকে, এজতেমা ময়দানে হৃদরোগে আক্রান্ত নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া এলাকার আফাজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল বারেক এবং সুনামগঞ্জ জেলার কাউয়ার বাজার এলাকার হাজি আব্দুল জব্বারের ছেলে হাজি আব্দুর রহমানকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এজতেমাস্থলে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আশপাশে বিভিন্ন খাবার দোকান ও হোটেলে শুক্রবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাবার পরিবেশন ও বিক্রির দায়ে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে মোট ১৫টি মামলা করেছে। এ সময় জরিমানা করা হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে ২৩ টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজতেমা উপলক্ষে এসব ট্রেনে দু’টি করে অতিরিক্ত বগি সংযোগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিআরটিসিও বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে অন্য বছরের ন্যায় এ বছরও বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করেছে। রাজধানীর গুলিস্থান, ফুলবাড়িয়া, কমলাপুর, মতিঝিল, ফার্মগেট, গাবতলী, মহাখালী, আজিমপুর থেকে এজতেমাস্থল পর্যন্ত বিশেষ বাস সার্ভিস চালু থাকবে। আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত কাকরাইল মসজিদ সংলগ্ন পয়েন্ট থেকে এজতেমাস্থল পর্যন্ত বিআরটিসি বাস চলাচল করবে। বিমানবন্দর থেকে বিদেশী মুসল্লিদের এজতেমাস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাস থাকবে। এ ছাড়া বিআরটিসি এজতেমা সার্ভিসের বাসগুলো আরিচা, পাটুরিয়াঘাট, মাওয়া, মিরপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ভৈরব, কুটি, চৌমহনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, বিরিশিরি, নেত্রকোনা, সোনাপুর, চরজব্বার, লক্ষ্মীপুর, কলমাকান্দা, মদন, মনোহরদী, মিরকাদিম, মোহনগঞ্জ, আখাউড়া, ময়মনসিংহ, সাইদাবাদ, জয়দেবপুর, গাবতলী থেকে মুসল্লিদের আনা-নেয়া করবে। এ ছাড়া কোন মুসল্লি দল যদি চায় বিআরটিসি তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় বাস দিয়ে এজতেমাস্থলে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে। আখেরি মোনাজাতের পরের দিন অর্থাৎ ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মুসল্লিদের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দেয়ার জন্যও বিআরটিসির বাস চলাচল করবে। আখেরি মোনাজাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালিগঞ্জ সড়ক, দুপুর পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া যান চলাচল বন্ধের কারণে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় কল কারখনার মালিক কর্তৃপক্ষ বিশ্ব এজতেমার জন্য একদিন কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক যাতে আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
×