ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ওষুধ প্রশাসনের প্রতিটি ধাপে অবৈধ লেনদেন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫

ওষুধ প্রশাসনের প্রতিটি ধাপে অবৈধ লেনদেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রায় প্রতিটি ধাপে অনৈতিক অর্থ লেনদেন চলে। বিভিন্ন কাজে ৫শ’ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায় হয়ে থাকে। ড্রাগ লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স প্রদান, ওষুধ নিবন্ধন, নমুনা পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ এবং রফতানি নিবন্ধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলে ঘুষ বাণিজ্যের ওপর। অধিদফতরের সঙ্গে উৎপাদনকারী বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ রয়েছে। কখনও টাকা পয়সা দিয়ে, কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও উপঢৌকন দিয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজ করিয়ে নিচ্ছে। বৃহস্পতিবার ধানম-ির মাইডাস ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ তথ্য জানায়। সংবাদ সম্মেলনে ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল, সংস্থাটির উপনির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের ও রিসার্চি এ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক মোঃ শাহনুর রহমান ও নাজমুল হুদা। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেন, গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং এই প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত হওয়ার পর অধিদফতরকে দেখিয়েছেন। নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন স্বীকার করে নিলেও টাকার অঙ্ক নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন ছিল। তিনি আরও বলেন, বিদেশে রফতানি করার জন্য উৎপাদিত ওষুধের মান ঠিক থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত ওষুধের মান ঠিক থাকে না। টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, সুশাসনের সবচেয়ে বড় অংশ হলো দায়িত্ব¡শীলতা। সেই দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে অধিদফতরে। যার এখানে বসে যে কাজ করা দরকার, সেই কাজ তাঁরা করছে না বা করতে পারছে না। প্রতিটি ব্যবসায়ে ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জনে অসদুপায় অবলম্বন করেন। এতে করে ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোও তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওষুধ প্রশাসনের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা, ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কমিটির অন্য সদস্যদের প্রভাবিত করার মতো ঘটনা এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভেজাল ও নকল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রতিককালে মাঠ পর্যায়ে জনবল বৃদ্ধি, ওষুধ পরীক্ষাগার পুনঃস্থাপন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে অভিযান জোরদারকরণ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণসহ বেশকিছু ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তা সত্ত্বেও এ খাতটিতে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়া অধিদফতরের কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি, অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন না করা, কর্মবণ্টনে স্বচ্ছতার ঘাটতি ও কর্মকর্তাদের পরিবীক্ষণ ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি ও ওষুধ প্রশাসনের সেবা কার্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়ে যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে এ অধিদফতরে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের আওতাধীন পাঁচ শ্রেণীর ওষুধ কোম্পানির মধ্যে (এ্যালোপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথি ও হারবাল) এ্যালোপ্যাথি ওষুধের বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, অনিয়ম ও দুর্নীতি গবেষণায় আওতাভুক্ত করা হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সুশাসন আলোচনার ক্ষেত্রে সুশাসনের বিভিন্ন নির্দেশকের (আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণ, সংবেদনশীলতা, সেবার ঘাটতি ও দুর্নীতি) ওপর ভিত্তি করে তথ্য সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত হয় বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এদিকে, যুগোপযোগী নীতি কাঠামো তৈরি সমন্বিত আইন প্রণয়ন, আইনের কার্যকর প্রয়োগ, জনবল ও দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতির অভিযোগে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১২ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে সংস্থাটি। টিআইবির সুপারিশসমূহ মেডিক্যাল ডিভাইস, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত করে, ওষুধ সংক্রান্ত কমিটিগুলোর গঠন ও কর্মপ্রক্রিয়া আইনে অন্তর্ভুক্ত ও সুনির্দিষ্ট করে, ওষুধের মূল্য নির্ধারণে গেজেট প্রকাশের সময়কাল সুনির্দিষ্ট করে এবং ওষুধ আইনে অপরাধের জরিমানা ও শাস্তির অসামঞ্জস্যতা দূর করে কঠোর দ-ের ব্যবস্থা রেখে একটি সমন্বিত একক আইন প্রণয়ন এবং এর কার্যকর প্রয়োগে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া কাজের পরিধি ও ভৌগোলিক আওতা বিবেচনায় প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি ওষুধ পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি ও অতিসত্ত্বর অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সকল পর্যায়ে জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করা দরকার। অর্গানোগ্রাম ও কর্ম-বিবরণ অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন এবং ওষুধ কারখানা পরিবীক্ষণের দায়িত্ব বণ্টনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ওয়েবসাইটে সকল প্রকার রেজিস্ট্রেশনের তথ্যসহ অন্যান্য তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা উচিত। ওষুধ প্রশাসনের কার্যক্রমে জন-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে টোল ফ্রি নম্বর বা হটলাইন চালু করতে হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতিরোধে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনার ব্যবস্থা ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য নৈতিক আচরণবিধি তৈরি ও বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। অন্যদিকে, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোতে বিশেষত ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি, মূল্য নির্ধারণ কমিটি, ব্ল্যাক লিস্ট অনুমোদন কমিটি এবং প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিতে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তি বন্ধ করতে হবে। যে সকল ওষুধ কোম্পানি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুত করে তাদেরকে চিহ্নিত করে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছ ও শক্তিশালী মনিটরিং কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করলে ওষুধ প্রশাসনের অনিয়ম কিছুটা লাঘব হতে পারে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
×