ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অতিথি পাখি ॥ অতিথি হয়ে থাকতে পারছে না

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৫

অতিথি পাখি ॥ অতিথি হয়ে থাকতে পারছে না

প্রচণ্ড শীতে স্ববাসে যখন বাঁচা-মরার প্রশ্ন দেখা যায়, দেখা দেয় খাদ্য ও আশ্রয়ের চরম সঙ্কট তখন শীতপ্রধান দেশের পাখিরা অতিথি হয়ে আসে আমাদের দেশে। অতিথি পাখি প্রায়শই আমাদের দেশে অতিথি হয়ে থাকতে পারছে না, তারা খাদ্যের জন্য শিকার হয় একশ্রেণীর শিকারির হাতে। পাখিরা মানুষের কাছে একসময় বিস্ময় হিসেবে থাকলেও আজ তা শৌখিন খাবারে পরিণত হয়েছে। এভাবে অতিথি পাখি শিকার করা হলে ভবিষ্যতে হয়ত এদের আসা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া শৌখিন শিকারিদের হাতেও মারা পড়ছে প্রতিবছর অনেক পাখি। আদিকাল থেকেই পাখিদের সাময়িক অন্তর্ধান ও পুনরায় আবির্ভাবের রেওয়াজ রয়েছে, যা আজও মানুষের কাছে রহস্যময়। ধারণা করা হয়, পাখিদের অভিপ্রায়ণ শুরু হয় প্রায় ৫ কোটি বছর আগে। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যখন শীতকালে পাখিদের তাদের স্ববাসে দেখা যেত না তখন মানুষ মনে করত পাখিরা শীতকালটা পানির নিচে ডুব দিয়ে অথবা সরীসৃপের ন্যায় গর্তে কাটায়। প্রতিবছর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের এ আসা-যাওয়ার কোন বিরাম নেই, ঠিক যেমনিভাবে তারা চলে আসে আবার তেমনিভাবে চলে যায়। এসব পাখি প্রতিবছর ঠিক একই স্থানে ভিড় করে। সুদূর ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা থেকে আগত পাখিদের পথে কোন পথ ভুল হয় না। বিজ্ঞানীরা পাখিদের দিকদর্শন ও দেশান্তরী নিয়ে আলোচনা করে চলেছেন। পাখিদের দিকনির্দেশ করতে সূর্য, তারা (নক্ষত্র), বাতাসের গতি, গন্ধ, ভূমির অবয়ব দেহজ গন্থির ক্ষরণ, বংশানুক্রমিক ও আলোক রশ্মিও আকর্ষণ প্রভৃতিকে দিকদর্শনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। পাখিদের কেউ কেউ দিনে আবার কেউ কেউ রাতের বেলায় এ দীর্ঘ পথে পাড়ি জমায়। তারা দীর্ঘ পথে পাড়ি জমানোর পূর্বে শরতের শুরুতে প্রচুর খাদ্য গ্রহণ করে শরীরে চর্বি সঞ্চয় করে। আবার মরুভূমির পথ পাড়ি দেয়ার সময় তারা তাপ এড়ানোর জন্য আকাশে ওড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে, ২শ’ প্রজাতির রয়েছে দেশান্তরী পাখি। প্রতিবছর বাংলাদেশের যেসব স্থানে পাখি আসে সে স্থানগুলো হচ্ছেÑ মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের লেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, ঢাকার পিলখানা, বালুচরা, মহেশখালী দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, (চর ওসমান) শাহীবানীচর, সন্দ্বীপ, হাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া, ডালচর, যামিরচর, মৌলভীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওড়, জোনাকচর, চরভাটা, শিবালয়, কামালপুর, হাল হাওড়, হাকালুকি হাওড়, চরকুকড়িমুকড়ি, বুড়িগঙ্গা নদী, আগুনমুখা, গলাচিপা, খেপুপাড়া, কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙ্গা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, হোয়াইকিয়ং, শাহপুরীরদ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চর নিজাম, চরমানিক, চরদিয়াল, চরমনতাজ, উড়িরচর, বায়ারচর, মুক্তাগাছার রৌয়াবিল, বড়বাইসা বিল, নেত্রকোনার কলমকান্দার হাওড়, কিশোরগঞ্জ হাওড়, সুনামগঞ্জ হাওড়,পঞ্চগড়ের ভিতরগড়, প্রভৃতি। হিমালয়, সাইবেরিয়া, আসাম, ফিলিপিন্স, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ পশ্চিম চীনের মালভূমি, রাশিয়া ফিনল্যান্ড তিব্বতের উপত্যকা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে প্রতিবছর শীতের প্রকোপে এরা এখানে আসে। এসব পাখির আগমনের প্রথম অবস্থায় পালক থাকে না। সেখানে অতিরিক্ত শীতের কারণে পালক পড়ে যায়। বাংলাদেশে এসে কিছুদিনের মধ্যে অনুকূল হাওয়ায় তাদের পালক গজায়। শীতে যেসব পাখি আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসে তাদের মধ্যে বালিহাঁস, চখাচখি, রাজহাঁস, মানিকজোড়, গাংকবুতর, নারুদ্দী, চীনাহাঁস, নাইরাল ল্যাঙ্গী, ভোলাপাখি, হারিয়াল, বনহুর, বুরলীহাঁস, সিরিয়া পাতিরী, পিয়াংচীনা, কবালী, যেনজি, প্রোভায়, নাইবাল, ডেলা ঘেনজি, গ্রাসওয়ার, গেন্ডাভার, বারহেড অন্যতম। এদের কেউ কেউ পুরো শীতকাল আমাদের দেশে কাটায়। বাকিরা আমাদের সীমানা সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে। এক জরিপ অনুযায়ী প্রতি বছর এখানে প্রায় এক লাখ পাখি আসে বলে জানা যায়। ঢাকা চিড়িয়াখানার এই লেকে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছরই পাখি আসছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক এখানকার পাখি গণনা করেন বলে কর্র্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়। এই লেক দুটো বেশ বৈচিত্র্যময় পরিবেশে সৃষ্টি। বিভিন্ন গাছপালায় ঘেরা থাকায় পাখিরা নিজেদের ইচ্ছামতো এখানে ঘুরাফেরা করতে পারে। কিছু কিছু পাখি আছে খাবারের অšে¦ষণে ও ভ্রমণের জন্য ইচ্ছেমতো দিনের বেলায় বিভিন্ন স্থানে যায়। আবার রাতে ফিরে আসে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানের চরাঞ্চল আবাদিভূমিতে পরিণত হওয়ায় অতিথি পাখিদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে যেসব পাখি জঙ্গলে ঠাঁই খুঁজত তারাও এ দেশে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই পাখি শিকার বন্ধ এবং পাখিরা যাতে নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া সবারই প্রয়োজন। লেখক : গবেষক, উপ-আঞ্চলিক পরিচালক, বাউবি
×