ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পরিবহনে ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকা ॥ ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার নামে দু দফায়-;###; জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ৫ হাজার বাস;###; ১ হাজার গাড়িতে আগুন ও ভাংচুর;###; হত্যা করা হয়েছে ৫৬ গাড়ি চালককে;###; ৫ জেলায় নাশকতা সবচেয়ে বেশি

জ্বালাও পোড়াও

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১২ জানুয়ারি ২০১৫

জ্বালাও পোড়াও

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিহত করার নামে দু’দফায় প্রায় দুই মাস সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় পরিবহন সেক্টরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ১২ হাজার কোটি টাকা। ১০ হাজারের বেশি যাত্রীবাহী বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার বাস। ভাংচুর করা হয়েছে পাঁচ হাজারের মতো যাত্রীবাহী গাড়ি। পেট্রোলবোমা মেরে, আগুন দিয়ে এমনকি নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৫৬ চালককে। নিহত ৪২ চালকের পরিবার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অনুদান পেয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিকদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। নতুন বছরের চার থেকে দশ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ৬০টি যাত্রীবাহী বাস জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। শনিবার গাইবান্ধায় অর্ধশতাধিক গাড়িসহ এ বছর ভাংচুর করা হয়েছে তিন শতাধিক বাস। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির হিসাব অনুযায়ী একদিন সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রথম দফায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরজুড়ে সারাদেশে তা-ব চালায়। এই হিসেবে এক মাসের বেশি সময় স্বাভাবিকভাবে আন্তঃজেলা রুটে বাস চলাচল করতে পারেনি। যার রেশ ছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বর্তমান সরকারে এক বছর উপলক্ষে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন পাঁচ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালনের ডাক দেয়। দ্বিতীয় দফায় সহিংসতা শুরু হয় ৬ জানুয়ারি থেকে। সব মিলিয়ে ৫০ দিনের বেশি সময় পরিবহন সেক্টরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ছাড়িয়ে গেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, গেল এক বছরে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবহন সেক্টর। রাজনৈতিক সহিংসতায় চরম লোকসানের মুখে মালিকরা। একদিন সারাদেশে বাস চলাচল বন্ধ থাকলে আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাসে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে মালিক সমিতির পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৬ জানুয়ারির পর থেকে আন্তঃজেলার সকল রুটে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হতে চলেছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে সারাদেশে গাড়ি চলাচল পুরোদমে স্বাভাবিক হওয়ার কথা জানান তিনি। দেশের উত্তরবঙ্গ ছাড়া আন্তঃজেলার প্রায় রুটেই বাস চলাচল স্বাভাবিক। অবরোধ আতঙ্ক ও এজতেমার কারণে যাত্রীসংখ্যা তুলনামূলক কম। বগুড়া, রংপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় পুলিশী নিরাপত্তায় গাড়ি চলছে। পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, ভাংচুরসহ পাঁচ জেলার মহাসড়কে নাশকতা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। পরিবহন ও যাত্রী নিরাপত্তায় সকল হাইওয়েতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ। আগামী তিন দিনের মধ্যে সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার কথাও জানিয়েছেন তাঁরা। সড়ক পরিবহন সমিতি নেতা এনায়েত উল্লাহ জানান, সরকারের পক্ষ থেকে মালিক-শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে শনিবার থেকে দেশের বেশিরভাগ জেলায় বাস চলাচল অনেকটাই ঠিক হয়েছে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চল, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে সকাল থেকে প্রায় ৮০ ভাগ বাস ছেড়ে যায়। যাত্রী কম হওয়ার কারণে শতভাগ গাড়ি চলতে পারছে না বলে জানান তিনি। গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী-সিরাজগঞ্জ-নোয়াখালীসহ কয়েকটি জেলার মহাসড়কে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির কর্মীরা গাড়ি ভাংচুর করাসহ নাশকতা চালাচ্ছে। তিনি জানান, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনী সহিংসতার পর মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের দেড় কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, হরতাল-অবরোধের যাঁরা ডাক দিয়েছেন তাঁদের কলকারখানা থেকে শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সচল আছে। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে গণপরিবহনকে টার্গেট করে নাশকতা চালানো হচ্ছে অথচ সর্বদলীয় লোকজন পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে জড়িত। এরপরও পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা কেন? এমন প্রশ্ন সবার। নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করে বলেন, পার্কিং বা গ্যারেজে মেরামত করতে দেয়া বাস জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। গাজীপুরে শ্যামলী পরিবহনসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এমন ঘটনা ঘটছে। এতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা প্রচ- ক্ষুদ্ধ। এমন ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মকা-ে হতাশা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। বাস ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়ায় মালিক-শ্রমিকদের বেশিরভাগই এখন গাড়ি চালানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। শুক্রবার পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আয়োজিত এক বৈঠকে অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিককে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সারাদেশে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীর গাবতলীতে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে শেষে তিনি এ কথা জানান। একই বৈঠকে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, অবরোধের কথা বলে পরিবহন বন্ধ রাখলে টিকেট কাউন্টার বন্ধ করে দেয়া হবে। কারণ সরকার যানবাহনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। তাই গাড়ি চালাতে হবে। অবরোধে জনসমর্থন নেই। মানুষ কথিত এই অবরোধ কর্মসূচী মানে না। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে, সরকার তা চেয়ে চেয়ে দেখতে পারে না। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে ঘরে বসে থাকবেন। রাস্তায় আপনার কর্মীরা জ্বালাও পোড়াও করবে। মানুষ হত্যা করবে। ভাংচুর করবে। তা হতে দেয়া হবে না। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। পরিবহন মালিকদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, আপনারা গাড়ি চালানোর প্রস্তুতি নিন। নিরাপত্তা দেবে সরকার। এ বৈঠকের পর শনিবার ভোর থেকে দেশের সকল হাইওয়েতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসারসহ হাইওয়ে পুলিশ। জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আদাজ জনকণ্ঠকে বলেন, মালিকরা ব্যবসার জন্য পরিবহন সেক্টরে বিনিয়োগ করেছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে পুঁজি হারানোর অবস্থা হয়েছে সবার। ব্যাংক লোন পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকেই। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি বড় বিষয় নয়। প্রয়োজনের তাগিদেই বাস চালানোর পক্ষে বাস মালিকরা। তিনি বলেন, সরকারের ক্ষতিপূরণের আশায় নয়, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই গাড়ি চালাতে শুরু করেছেন। এরপরও রংপুরসহ কয়েকটি রুটে পুলিশী নিরাপত্তায় গাড়ি চালানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যাত্রী কম থাকায় ৭০ ভাগ বাস নিয়মিত চলাচল করছে। তবে যাত্রী নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। গাড়ি চালানোর বিষয়ে সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ সকল রুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক আছে। সকাল থেকে কোথাও কোন অঘটনের খবর আসেনি। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন আছে এ কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আরও পুলিশী নিরাপত্তা বাড়ানো হলে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালানো সম্ভব হবে।
×