ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অস্বচ্ছ কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পিএসসি

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১০ জানুয়ারি ২০১৫

অস্বচ্ছ কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পিএসসি

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসির)। ২৯তম বিসিএসে প্রথম হয়েও এক প্রার্থীকে চাকরি না দেয়ার ঘটনা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই ৩৪তম বিসিএস নিয়ে শুরু হয়েছে মহাবিতর্ক। এ পরীক্ষার প্রিলিমিনারির পর এবার লিখিত পরীক্ষার সংশোধিত ফল নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সংশোধিত ফল প্রকাশের নজির নেই। তার পরেও হঠাৎ এভাবে ফল প্রকাশ করায় চাকরি প্রার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন, বিশেষ বিশেষ প্রার্থীর জন্য ‘কারসাজি’ করতেই এভাবে ফের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। তবে দুটি বিতর্কেই নিজেদের অবস্থানকে সঠিক ও আইনসিদ্ধ বলে দাবি করছে পিএসসি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একের পর এক অস্বচ্ছ ও বিতর্কিত পদক্ষেপে প্রশ্নের মুখে পড়েছে পিএসসির কর্মকা-। জানা গেছে, ২৯ বিসিএস নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় সর্বশেষ কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের পরই। ওই পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি পাননি কুমিল্লার আবদুল আউয়াল। তবে বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হওয়া বা চাকরি না পাওয়ার কারণ কোন কিছুই জানানো হয়নি তাঁকে। বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে তিনি তাঁর প্রথম হওয়ার তথ্যটি জানতে পারেন। এরপর ঘটনা প্রকাশ্যে আসে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের সূত্র ধরে। তবে তাঁর আগেই ঘটনা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। পিএসসি ঘটনার শুরু থেকে যে ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে তা হলো-আউয়ালের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রথম হওয়ার মতো নয়। অথচ এ বিষয়ে কোন তদন্ত করেনি পিএসসি। তদন্ত ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। কেবল তাই নয়, বার্ষিক প্রতিবেদনে আউয়ালের নাম আসায় পিএসসির দুজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ঠিক এমন অবস্থানেই প্রথমে আবদুল আউয়াল হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। আদালত তাঁকে সরকারী চাকরিতে নিয়োগের নির্দেশ দেন। তবে এই আদেশের সাড়ে ছয় মাস পার হলেও তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। উল্টো আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করে পিএসসি এবার বলছে, এটি এখন আদালতের বিষয়। আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। হলে সে অনুসারে পদক্ষেপ। আপাতত তাঁকে যে কোন সরকারী চাকরির পরীক্ষায়ও অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। এদিকে বরখাস্ত হওয়া একজন কর্মকর্তাও হাইকোর্টে তাঁকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে প্রতিকার চেয়েছেন। তিনি আদালতকে জানিয়েছেন, কম্পিউটার শাখা থেকে তিনি যে ফলাফল পেয়েছেন, তা-ই হুবহু পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। এখানে তাঁর কোন অনিয়ম নেই। কারণ কম্পিউটার শাখা থেকে তিনি যে ফলাফল পেয়েছেন সেখানে আউয়ালের প্রথম হওয়ারই তথ্য আছে।’ ভুক্তভোগী আবদুল আউয়াাল বলেছেন, ‘অন্য সব পরীক্ষার্থীর মতো আমিও আমার আবেদনপত্রের সব কাগজপত্র একসেট ফটোকপি করে রেখেছিলাম। আমার লিখিত পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছিল। কিন্তু ফল প্রকাশের আগে হঠাৎ একদিন আমার কাগজপত্র দেখতে গিয়ে দেখি, আবেদনপত্রের সব জায়গায় আমি আমার ঠিকানা নিজের জেলা কুমিল্লা লিখলেও এক জায়গায় বৃত্ত ভরাটে ভুল করেছি। তাতে জেলার জায়গায় কুমিল্লার একঘর ওপরে ছিল বান্দরবান, আমি ভুল করে সে বৃত্তটি পূরণ করেছি। আমি দেরি না করে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতরে ফোন করি। তাঁরা আমাকে একটি আবেদন করতে বলেন। আমিও ভুল সংশোধনের আবেদন করি। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, আমার রোল নম্বর স্থগিত তালিকায় রাখা হয়েছে। আউয়াল জানান, এরপর ২০১১ সালের ৫ মে পিএসসি থেকে চিঠি পাই। তাতে নিজ জেলার স্বপক্ষে সব কাগজপত্র নিয়ে পিএসসিতে যেতে বলা হয়। তিনি ওই বছরের ১৮ মে পিএসসিতে যান। সেদিন বোর্ডে ছিলেন পিএসসির তখনকার এক সদস্য ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। ‘তাঁরা আমার কাছে জানতে চান, কীভাবে এই ভুল হলো। আমি তাঁদের সব কাগজপত্র দেখাই। বলি, ওই দিন আমার বোন মারা গেছে। আমি খুব তাড়াহুড়া করে ফরম পূরণ করি। তাই এই ভুল হয়েছে। এরপর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সদস্য স্যারকে কানে কানে কিছু বলেন। এর পরই স্যার আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। বলেন, তুই কিভাবে চাকরি পাস আমি দেখে নেব। এরপর আমাকে বলেন, তুই লিখ। তোর হাতের লেখা পরীক্ষা করব। চার ঘণ্টা ধরে তাঁরা আমাকে মানসিক নির্যাতন করেন। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার আর চাকরি হবে না। কিন্তু বার্ষিক প্রতিবেদন দেখে জানতে পারি, আমি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি এবং পুলিশ ক্যাডার পেয়েছি। তখন আমি একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করি এবং হাইকোর্টে রিট করি। আদালত আমাকে নিয়োগ দিতে বলেছেন। কিন্তু পিএসসি এখন তা করেনি। কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আদালত আউয়ালের পক্ষে আদেশ দিলেও পিএসসি আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে গেছে। ফলে পুরো বিষয়টি এখন চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার অপেক্ষা। কমিশনের এক সদস্য বলছিলেন, কমিশন যেহেতু আদালতে তাদের অবস্থান বলতে চায় সেহেতু ওই নিয়োগ ঝুলে গেছে এটাই বলতে হবে। যদি আদালতের আদেশ অনুসারে কমিশন পদক্ষেপ নিত তাহলে এ বিতর্কের সুন্দর সমাধান হতো বলেও বলছেন ওই সদস্য। এ বিতর্ক নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে তখন নতুন জটিলতার জন্ম দিয়েছে ৩৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার বড় ধরনের সংশোধিত ফল। প্রিলিমিনারির ফলের বিতর্ক কাটলেও এবার লিখিত পরীক্ষার ‘সংশোধিত’ ফল নিয়েও চলছে বিতর্ক। দীর্ঘ ৯ মাস অপেক্ষা শেষে গত ১৮ ডিসেম্বর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এর কিছু দিন পরই হঠাৎ গত ৩০ ডিসেম্বর রাতে আবার ‘সংশোধিত’ ফল প্রকাশ করে পিএসসি। এ নিয়ে বিতর্ক এখন সর্বত্র। পিএসসির সাবেক একজন সদস্য জানান, বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার এভাবে সংশোধিত ফল প্রকাশের নজির বিরল। চাকরি প্রার্থীদের অভিযোগÑ ‘অনিয়ম’ ও ‘কারসাজি’ করতেই ফের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। জানা যায়, ২০১৩ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফলে কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করলে পিএসসি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। বিতর্কের জেরে পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিন দফায় প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশ করতে হয় পিএসসিকে। ৩৪তম বিসিএসের ফল নিয়ে পিএসসির বার বার বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে প্রার্থীদের জীবনের সঙ্গে প্রহসন হিসেবে দেখছেন চাকরিপ্রার্থীরা। প্রার্থীদের মনে এ পরীক্ষাটি এখন সন্দেহের পাত্র। আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে ৩৪তম বিসিএসের মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। তবে ফল প্রকাশের বিষয়ে বিতর্ক হলেও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও দেয়নি পিএসসি। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘১৮/১২/২০১৪ তারিখের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ১ নম্বর অনুচ্ছেদের শর্তানুযায়ী এবং একই প্রেস বিজ্ঞপ্তির ৩ অনুচ্ছেদে স্থগিতকৃত প্রার্থীদের জমাকৃত কাগজপত্র ও ফলাফল বিবেচনায় এনে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ১ নম্বর অনুচ্ছেদ নামে কোন অনুচ্ছেদ ছিল না। তবে শুরুতে বলা হয়, বিধি মোতাবেক কর্ম কমিশন এই ফল সংশোধন করার অধিকার রাখে। আর ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় ২৪ জনের ফল স্থগিতের কথা জানানো হয়। লিখিত পরীক্ষার সংশোধিত ফলাফলে প্রথম ফলে উত্তীর্ণ সাধারণ ক্যাডার পদের পাঁচ হাজার ৯২২ জন থেকে ৯৫৩ জনকে সাধারণ এবং কারিগরি বা পেশাগত (উভয়) ক্যাডার পদে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। আর কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডার পদে উত্তীর্ণ এক হাজার ৭৮০ জনের সঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন করে ১৪৪ জনকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়। ফলাফল স্থগিত ছিল এমন ২৪ জনের মধ্যে ১৯ জনকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়। সংশোধিত ফলে ১৪৪ জনকে নতুন করে অন্তর্ভুক্তি এবং ৯৫৩ জনকে সাধারণ ও কারিগরি (উভয়) ক্যাডারে উত্তীর্ণ দেখানোকে পিএসসির কারসাজি বলে প্রশ্ন তোলেন বঞ্চিতরা। পিএসসি চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ অবশ্য দাবি করছেন কোন অনিয়ম হয়নি। সব বিধি মোতাবেক হয়েছে। ৩৪তম বিসিএসের বিতর্ক নিয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কমিশন চাইলে যে কোন পরীক্ষার ফল পর্যালোচনা করে দেখতে পারে। এবার সেটা হয়েছে। সর্বোচ্চ যোগ্য প্রার্থী আমরা নির্বাচন করতে চাই। বিধি অনুসারেই হয়েছে তা। অন্যদিকে ২৯ বিসিএসর আউয়ালের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে চেয়ারম্যান বলেন, এটা এখন আদালতের বিষয়। আদালতে যেহেতু আছে সেহেহু এ নিয়ে কোন মতামত নয়।
×