ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হতাশাগ্রস্ত তরুণ প্রজন্ম মাদকের অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৮ জানুয়ারি ২০১৫

হতাশাগ্রস্ত তরুণ প্রজন্ম মাদকের অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়ছে

এমদাদুল হক তুহিন ॥ তরুণ প্রজন্মের একাংশ নানাভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে মাদকের সঙ্গে। মাদকের ভয়াল গ্রাস এখন সর্বত্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কৌশলে জড়ানো হয় অন্ধকার এই জগতে। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও জড়িয়ে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই। স্বপ্ন বুনে যাওয়া ও আকাশ ধরার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোন একটি কারণে ব্যর্থ হলে কিংবা সঠিক পন্থায় জীবনযাপনের কারণে অবজ্ঞার শিকার হলে অন্ধকার ওই মাদকের সমাজে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক কলহ, বেকারত্ব, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে মাদকের ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব ভূমিকার সুযোগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেমে ব্যর্থ ও হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে আধুনিকতার নামে ছাত্রছাত্রী উভয়েই বেছে নিচ্ছে অন্ধকার মাদকের ওই জগত। মাদক ও মাদকাসক্তির ভয়াল গ্রাসে নেশার জগতে তলিয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেশ কয়েকজন মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এমনটি। জানা যায়, মেস-বাসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্জন এলাকা, পাড়ায় নির্মাণাধীন ভবন কিংবা পরিত্যক্ত কোন নির্জন বাড়ি মাদক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেকটা অভয়ারণ্যের মতো। বেশিরভাগ সময় পার্টি কিংবা আড্ডা দেয়ার নাম করে চলে মাদকে বুদ হওয়া। নানা ধরনের মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, বিয়ার, মদ গাজাসহ নেশাজাতীয় সিরাপ ও ট্যাবলেট উল্লেখযোগ্য। আড্ডা বা এলাকা ভেদে প্রতিটি নেশা জাতীয় দ্রব্যের রয়েছে আলাদা আলাদা নাম, অনেক ক্ষেত্রে নামটি নিজেরাই তৈরি করে নেন; যেন অন্ধকার সমাজের বাইরের অন্য কেউ না বুঝেন-তারা গভীর অন্ধকারে তলিয়ে আছেন। সাহিত্যে গাঁজাকে গঞ্জিকা বললেও তাদের কেউ কেউ এর নাম দিয়েছে ‘জি’, নেশাজাতীয় সিরাপ ডেক্সপোটেনকে ‘ডি’, ইয়াবার প্রচলিত নাম বাবা বা গুটি হলেও কেউ কেউ একে ‘আফসোসের বড়ি’ বলে ডাকে। অন্যদিকে হেরোইনের প্রচলিত নাম ‘কালা’। হিরো কিংবা কালা দুটোকেই গলানোর মাধ্যমে নেশায় বুদ হয় তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র নীরব (ছদ্মনাম)। গ্রাম থেকে বহু কষ্টে উঠে আসায় প্রথম দুই বছর ছিলেন অনেকটা সহজ সরল, কোন প্রকার কলুষতাই এতদিন স্পর্শ করেনি তাকে। নীরব বলেন, অতিরিক্ত সহজ ও সরল হওয়া সত্ত্বেও বহু সার্কেলে মেশার সুযোগ হয়। আমার তুলনায় যারা অতিরিক্ত স্মার্ট ছিল তারা অবজ্ঞা করত। তখন বাধ্য হয়ে রাগে অভিমানে তাদের দেখিয়ে দেয়ার জন্যে আস্তে আস্তে নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। তখনও বুঝতে পারিনি এ ছিল এক ভয়াল জগত। নেশায় আসক্ত হয়ে ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। সব সময় অন্য রকম একটা অস্থিরতা কাজ করত নিজের মধ্যে। পরিবারের লোকজন সঙ্গত কারণে কোনদিন ধরতেও পারেনি ছেলে গভীর নেশায় আসক্ত। ধীরে ধীরে বন্ধুদের কাছ থেকেও আলাদা হয়ে যেতে শুরু করি। একাকিত্ব পেয়ে বসায় এবং আমার হৃদয়ে লালিত প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ায় সাধারণ জীবন থেকে বিচ্যুত হই। অস্থিরতা কাজ করায় কখন কি করতাম নিজেও জানতাম না। অনেকে অস্বীকার করলেও মূলত সিগারেট থেকেই এ জগতের শুরু। হাতে টাকা হলেই কোন না কোন মাদক সেবনে ব্যস্ত হয়ে উঠতাম। কখনও বারে, কখনও নির্মাণাধীন ভবনে, কখনও বন্ধুর বাসায়। এ জগতে বন্ধুর অভাব হয় না; নেশায় আসক্তরা নিজেদের স্বার্থেই মেধাবী-তরুণদের যোগ করে নেয় এজগতে, যাতে নেশা নিয়ে কেউ কিছু বলতে না পারে। ঢাকার অভিজাত পরিবারের সন্তান অরুণ (ছদ্মনাম)। ছোটবেলা থেকেই ঢাকার তেজকুনীপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে তার বসবাস। বয়স ১৮ ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেশায় জড়িয়ে যায়। ছোটবেলার অতি মেধাবী এই ছাত্রটি মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে খ্যাতি পায় গলির ক্যাডার। সকল ধরনের অনৈতিক কর্মসাধনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। মজার ও অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে তার গ-ির বাইরের অন্য কেউ বুঝতেই পারবে না সে মাদকে আসক্ত। তিনি বলেন, গলিতে খেলাধুলা শেষে বন্ধুদের অনেকেই বাসার ছাদে আড্ডা দিত। আমিও আড্ডা দিতে শুরু করি। ওখানে সিয়াম (ছদ্মনাম) মদ ও গাঁজা খেত। সেই থেকেই শুরু। আর নিজের মাদকের অর্থ যোগাতে বান্ধবীও জুটিয়েছি মাদকসেবী। সে এখন আমার বিবাহিত স্ত্রী। বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে দিলেও আমরা দুজন মিলে এখনও হিরোতে আসক্ত। টাকা বেশি থাকলে ইয়াবাও। তবে এখন আর আগের মতো কিছুই হয় না, ইচ্ছে করে ওই গলিও ছেড়ে দিয়েছি। একটা সময় ছিল প্রতিরাতেই মদ, গাঁজা, হিরো, বাবা কিংবা কোন সিরাপ সেবন করতে হতো। বেশিরভাগ সময় নির্মাণাধীন ভবন, বাসার ছাদ কিংবা বন্ধুদের বাসায় সবাই আড্ডার ছলে নেশায় বুদ হতাম। লিজা আক্তারের (ছদ্মনাম) চেহারায় আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে, ২০-এ পা দেয়া এই তরুণীকে দেখলে যেকোন পুরুষ প্রেমে পড়তে চাইবে। বছর খানেক আগে মহিলা হোস্টেলে থাকার সময় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নেশার জগতে পা রাখে । জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসত তার সঙ্গীকে। ফলে, ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে মরতেও বসেছিল। আরেক মাদকসেবী লিজার বিস্তারিত ঘটনা শোনার পর তাকে প্রেমের অভিনয়ে কৌশলে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। মাদকের টাকা যোগাতে লিজা নিজেও বহু ছেলের সঙ্গে ফোনালাপে প্রেমের অভিনয় করত। টানাটানা চোখ, বাহারী রঙে রাঙা লম্বা কেশ-ফেসবুক কিংবা ফোনে ছবি পাঠালেই অপর প্রান্তের পুরুষ পাগল হয়ে উঠত সাক্ষাতের জন্য। আর সেই সুযোগে লিজা বিভিন্ন কৌশলে টাকা আদায় করত। বিস্ময়কর হচ্ছে আদায়কৃত টাকা দিয়ে কাছের আরেক ছেলে বন্ধুকে নিয়ে নেশা ও আনন্দ ফুর্তিতে মশগুল হতো। নেশায় ডুবে থাকা সত্ত্বেও সর্বদাই মুখে হাসি লেগে থাকা লিজা জানান, প্রথম প্রেমিক আমাকে কষ্ট দেয়ায় আমার এই অবস্থা। যেদিন সে আমাকে ছেড়ে মিতালীর সঙ্গে প্রেম শুরু করল, আমার সব শেষ করে দিয়ে অনত্র চলে গেল; সেদিন রাতেই মরতে বসেছিলাম। কিন্তু আরেকজন মাদকসেবীর সঙ্গে পরিচয় হলে সেও একই রকম করতে শুরু করে। অগত্যা আমিও কৌশল অবলম্বন করে তাদের কাছ থেকে নেশার টাকা জোগাড় করতাম। বিন্তি ঢাকার একটি সরকারী কলেজে অনার্সে অধ্যয়নরত। লেখাপড়া শেষ হওয়ার কথা ছিল আরও বছর তিনেক আগে। অনার্সের পাঠই চুকিয়ে ওঠা হলো না তার। জীবন থেকে হারিয়েছেন সোনালী তিনটি বছর। শিক্ষাক্ষেত্রে নামে মাত্র অধ্যয়নরত। শিক্ষাজীবনের শেষ ফলটি এখন তার কাছে অনেকটা অধরা। তিনি জানান, উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়ায় পরিবারের কেউ তেমন খোঁজ খবর রাখতে পারতেন না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অতি সহজেই বহু গ-িতে মেশার সুযোগ হয়। মাদকের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের পরিচয় সূত্রেই নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া। নেশাজাতীয় সকল দ্রব্যের মধ্যে হিরো (কালা) বেশ ভাল লাগত। সহজেই সিগারেটের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়, তাছাড়া ইয়াবার (বাবা) মতো গলিয়েও খেতাম। নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যা হারিয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমার জীবন থেকে তিনটি বছর হারিয়ে গেছে। আত্মীয় স্বজনের চোখে আমার ছবি আর ভেসে উঠে না! বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ অধিক হারে তরুণ প্রজন্মের মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, সামাজিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তি, মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের একাংশ মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে ধ্বংসের ধারপ্রান্তে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একটি মুখ্য বিষয়। আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার, অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়ার কল্যাণেই ছেলেমেয়েরা হতাশ হয়ে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
×