ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাপস মজুমদার

জেগে উঠছে সুন্দরবন

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৫

জেগে উঠছে সুন্দরবন

বাংলাদেশের সুন্দরবন নিয়ে গল্পগাথা, রূপকথা, উপকথা, গল্প ও কল্পকাহিনীর বোধকরি শেষ নেই। সুন্দরী গাছের আধিক্য থেকেই হোক অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন, প্রাচ্যের এই রহস্যম-িত বনের অপরূপ সৌন্দর্য, অপার মহিমা, সর্বোপরি রহস্য-রোমাঞ্চের আদৌ কোন কূল-কিনারা পাওয়া ভার। অধিক কি বলব, এই বনের নামটাও যেনবা বড় বেশি মাধুুর্যম-িত, শ্রুতিসুখকর- সর্বোপরি সপ্তাশ্চর্যেরও ওপরে অবস্থানরত কোন অপ্সরার মদির সৌন্দর্যের রহস্যে অধরাপ্রায়। সে জন্যই বলেছি, এই বনকে ঘিরে রূপকথা-উপকথা-গল্পগাথা ও গুজবের কোন শেষ নেই। তবে এতে সর্বশেষ সংযোজন বোধকরি গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফারনেস অয়েল সাউদার্ন সেভেন নামে ট্যাঙ্কারের দুর্ঘটনাজনিত কারণে নদীতে উপচে পড়ে ছড়িয়ে যাওয়ায়। পাঠক, দয়া করে এরপর থেকে আপনার সংগ্রহে থাকা পুরনো জাতীয় পত্রিকাগুলো একটু কষ্ট করে উল্টে-পাল্টে দেখুন। এর পাশাপাশি স্মরণ করার চেষ্টা করুন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত এই দুর্ঘটনা এবং তজ্জনিত নদী দূষণ ও পরিবেশ দূষণের সমূহ সচিত্র বিবরণ। এক্ষণে তা সম্ভব না হলে, অনুগ্রহ করে একবার অন্তত ভাবুন অথবা মনশ্চক্ষে দেখার চেষ্টা করুন সেইসব ভয়াবহ বিবরণ-যেখানে বোধকরি সুন্দরবনের সমূহ ধ্বংস কল্পনা অথবা অস্তিত্বই প্রায় মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এর যে অনিবার্য পরিণাম ও পরিণতি অর্থাৎ, সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই শেষ পর্যন্ত বিপন্ন হবে, প্রকারান্তরে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সেই কথাটিই। তথাকথিত সুশীল সমাজের পাশাপাশি জনপ্রত্যাখ্যাত দল বিএনপি পর্যন্ত সুন্দরবন নিয়ে অপরাজনীতির সুযোগ হাতছাড়া করতে ছাড়েনি। বিএনপি তথাকথিত একটা বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে সুন্দরবনে নৌভ্রমণে এবং ফিরে এসে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছে সরকারে ঘাড়ে। সত্যি বলতে কি, আমরা পর্যন্ত এতসব কথাবার্তা ও বাখোয়াজে বিপর্যস্ত হয়ে রীতিমতো সংশয়-সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেছিলাম, সুন্দরবন বুঝি সত্যি সত্যিই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং সেহেতু আমরাও বুঝি পড়ে গেলাম সমূহ অস্তিত্ব সঙ্কটে! আসলে ‘গেল গেল’ কলরব তোলা বুঝি এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধির দুর্বিনীত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। দেশে কোন রকম কিছু হলেই তারা তারস্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন এবং নিজের কানে হাত না দিয়েই প্রাণপণ ছুটতে থাকেন চিলের পেছনে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিজের কান অক্ষত ও অক্ষুণœ রাখেন এবং চিলটিও ধরতে পারেন না। দুঃখজনক হলেও সত্য, তখন নিজেদের ব্যর্থতার জন্য আদৌ কোন দুঃখ বা অনুশোচনাও প্রকাশ করেন না। এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের স্বভাব হলো, তারা কখনও একটি গ্লাসে আধ গ্লাস পানি আছে বলেন না; বরং ঝড় তুলতে চেষ্টা করেন আধ গ্লাস পানি নেই কেন, তা নিয়ে। পাছে নিজের ভাগে কম পড়ে, সেই দুশ্চিন্তায়! পাঠক, ভুল বোঝার আদৌ কোন অবকাশ নেই। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যে কোন রকম যান্ত্রিক যানবাহন তথা নৌযান চলাচলের আমরা ঘোর বিরোধী। এতে বনের নিবিড়-নির্জন পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিঘিœত হয় জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত লেখালেখি হয় ও হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তেলের ট্যাঙ্কার, কয়লা, রাসায়নিক সার অথবা অন্য কোন মালামালবাহী নৌযানের চলাচল তো বলাইবাহুল্য! তবে টনক যেন সবার নড়ে ওঠে শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কারের দুর্ঘটনার পর। এত বড় দুঃখ রাখি কোথায়? যে কোন দুর্ঘটনাই নিন্দনীয় ও অবাঞ্ছিত। কেননা এতে প্রাণহানিসহ সম্পদহানি ঘটে। তদুপরি ঘটে পারিপার্শ্বিক অবস্থার অবনতিসহ পরিবেশ বিপর্যয়। সে অবস্থায় কোন একটি দুর্ঘটনা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক, উত্তেজনা ও গেল গেল রব না তুলে এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের আওয়াজ তোলাই উত্তম নয় কি? যা হোক, এবার আসল কথায় আসি। সুন্দরবন যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্য তথা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং পরামর্শের সাহায্য চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানায় সরকার। সে প্রেক্ষিতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড থেকে নয়জন পরিবেশ বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সুন্দরবন সফরে আসেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী, পরামর্শক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। দলটি ২৩-২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনে সরেজমিন অবস্থান করে মাঠ পর্যায়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান চালায়। এ সম্পর্কে সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা জানিয়েছেন যে, ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা যা ধারণা করা হয়েছিল, তার তুলনায় অনেক কম হয়েছে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য মোটামুটি অক্ষুণ্ণ আছে। তবে তেলের জন্য কিছু অনুজীব উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির ক্ষতি হয়েছে কিনা, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দিতে অন্তত বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। জাতিসংঘের অধীনে বিদেশী বিশেষজ্ঞ দলের এই প্রাথমিক প্রতিবেদনে বিএনপিসহ একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হয়ত নাখোশ হবেন। সরকারও হয়ত আপাতত কিছুদিন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবে। যাতে মানুষ যথাশীঘ্র দুর্ঘটনার কথাটি ভুলে যায় বেমালুম। তারপর আবার যে কে সেই। রামরাজত্ব আর কাকে বলে- চালাও বনের ভেতর দিয়ে তেল, ডিজেল, মবিল, কয়লা, রাসায়নিক সারবাহী নৌযান। পথ যত সংক্ষিপ্ত, সহজ ও শর্টকাট হবে ততই লাভ। বন থাকল কি না থাকল, তাতে কিছুই যায় আসে না-না সরকারের, না জনগণের। সবাই যেন ব্যস্ত ঘরে নগদ লাভ তুলতে। দীর্ঘমেয়াদে দেশ ও দশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে না কেউই। আমাদের কথাকে অভ্রান্ত প্রমাণ করে সুন্দরবনের শ্যালা নদী দিয়ে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ব্যতিরেকে সব ধরনের নৌযান চলাচলে অনুমতি আবারও দেয়া হয়েছে ৭ জানুয়ারি থেকে। পাঠক, লক্ষ্য করুন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অযাচিত বিদেশী হস্তক্ষেপের মতো এখানেও প্রয়োজন হয়ে পড়ল জাতিসংঘের সনদ! বলছিলাম, সুন্দরবনের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতা নিয়ে। সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাঁদাবন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট-এ কথা পুরনো ও সর্বজনবিদিত। কিন্তু একে সুরক্ষা ও সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাই আমাদের নেই। এর সৌন্দর্যও দিনে দিনে ধ্বংস করছি আমরাই। একেবারে অপরিকল্পিতভাবে মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, সুন্দরী, কেওড়া ও অন্যান্য গাছÑ সর্বোপরি মৌচাক তথা মধু সংগ্রহ করে। চোরা শিকারিদের যথেচ্ছ অত্যাচারে চিত্রল হরিণ, ব্যাঘ্র প্রজাতি, ভোঁদড়, কুমির ও ডলফিনের জীবন যায় যায়। এর ওপর আবার রয়েছে অপরিকল্পিত ঘের নির্মাণ ও চিংড়ি চাষ। বিবিধ নৌযানের অবাধ বিচরণ ও যথেচ্ছ বিহার, অত্যাচার ও তেল নিঃসরণ তো আছেই। সুন্দরবন যে অদ্যাবধি টিকে আছে, এটাই তো ঢের আশ্চর্যের! সিডর-আইলার সমূহ বিপর্যয়ের পর আশঙ্কা করা হয়েছিল, সুন্দরবন টিকে থাকবে কিনা! গাছ শিকারিদের দুরভিসন্ধিতে মাঝে মধ্যে অগ্নিকা-ের ঘটনাও ঘটে যত্রতত্র। এতসব অত্যাচার-নির্যাতন, ব্যাপক বিধ্বংসী কার্যকলাপের পরও কিমাশ্চর্যম, টিকে আছে সুন্দরবন। কেমন করে সম্ভব এই টিকে থাকা! এখানেই সুন্দরবনের অপার রহস্য ও মহিমা। এখানেই নিহিত প্রকৃতির অপার দয়া ও দাক্ষিণ্য। সে কারণেই সুন্দরবন অনন্যসাধারণ এবং একামেবাদ্বিতীয়ম। এর অন্তর্নিহিত অস্তিবাচক প্রাণশক্তির কথাটি কেউই ভাবে না। মানুষের অত্যাচারে সঙ্কুচিত হয়ে বর্তমানে সুন্দরবনের আয়তন ঠেকেছে এক-তৃতীয়াংশে-প্রায় ৪১১০ বর্গকিমি। এর মধ্যে ১,৭০০ কিমি জলাভূমি। পর পর সংযুক্ত প্রায় ৪০০ নদীনালা খালসহ প্রায় ২০০ ছোট বড় দ্বীপ-উপদ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে। বনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতের পশিচমবঙ্গে। পরিকল্পিত বিধায় যাতায়াত ও সংরক্ষণের কারণে ভারতের অংশটি অপেক্ষাকৃত উন্নত। বনভূমিতে আছে ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি, প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। ভাবা যায়! ১৯০৩ সালে ডি. প্রেইন সুন্দরবনের গাছপালার ওপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ২৪৫ গণের অধীনে ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। বোধকরি এত জীববৈচিত্র্য ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য কোন দেশে, অন্য কোথাও নেই। সর্বশেষ একটি সুসংবাদ দিয়ে শেষ করি। ২৪ ডিসেম্বর তেল দুর্ঘটনাকবলিত স্থান জয়মনিঘোল এলাকার ছবিতে দেখা যায়, থকথকে কাদা ও পলিমাটি ভেদ করে গজিয়েছে বিকল্প শ্বাসমূল থেকে ‘সাইলা’। নধরকান্তি কচি দুটি পাতার কুঁড়ি শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ডানা মেলে উড়ে যেতে চাইছে আকাশে। আর তা দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সামুদ্রিক ও পরিবেশবিষয়ক সংস্থা নোয়ার বিশেষজ্ঞ মি. গ্যারি সিগিনাকা অস্ফুট কণ্ঠে বিড় বিড় করে বললেন, এ্যামেজিং! স্টিল দিস ফরেস্ট ট্রাইং টু সারভাইভ! এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে একশ্রেণীর স্থানীয় জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালরা রীতিমতো পূজা করে থাকে সুন্দরবনকে। বনবিবি কিংবা দক্ষিণ রায়কে রীতিমতো আরাধনা তথা সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে, যথাযথ সন্তুষ্টিবিধান না করে তারা কখনোই বনে প্রবেশ করে না। যে বন তাদের জীবন-জীবিকার অফুরন্ত উৎস, তারা সেই বন থেকে গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্ত যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই আহরণ করে থাকে। আর এ কারণেই টিকে আছে সুন্দরবন। আর আমরা কিনা তাকে সমূলে উৎখাত করতে চাই!
×